খুচরো গল্প জমা থাকে ঘরের কোণে

মাহমুদুর রহমান

সিরিজের একটি দৃশ্যে মিশ্র পরিবার ছবি: আইএমডিবি

আমরা বাস করি ডিজিটাল যুগে। আমাদের বড় অংকের টাকা জমা থাকে ব্যাংকে। কম হলে মোবাইল ব্যাংকিংয়ে। কিন্তু একটা সময় ছিল, আমরা খুচরা পয়সা জমাতাম মাটির বিশেষ পাত্রে। এদেশে বলে মাটির ব্যাংক। বিদেশে কোথাও পিগি ব্যাংক আর ভারতের কোনো কোনো স্থানে বলে গুল্লাক। এ মাটির ব্যাংক পড়ে থাকে ঘরের এক কোণে। কিন্তু সেও পরিবারের অংশ। থাকে অনেকটা নিভৃতে। কোণে থাকার কারণে পরিবারের সবই আসে তার নজরে। তাই যতটা খুচরা পয়সা সে জমায়, ততটাই জমায় পরিবারের গল্প। আর এ ধারণা থেকেই নির্মিত ভারতীয় সিরিজ ‘গুল্লাক’।

মিশ্র পরিবারের গল্প নিয়ে এ সিরিজ। পরিবারের প্রধান সন্তোষ মিশ্র। বিজলি বিভাগে কাজ করেন তিনি। সৎ ও পরিশ্রমী মানুষ। তার স্ত্রী শান্তি মিশ্র। আমাদের পরিচিত আর দশটা মধ্যবিত্ত পরিবারের মায়ের মতোই তিনি। ‘হাম দো অওর হামারে দো’ স্লোগানের মতো তাদেরও সন্তান দুটি, আনন্দ মিশ্র ও আমান মিশ্র। এ চারজনই সিরিজের নিয়মিত মুখ। তাদের বাইরে আছেন বিট্টু কি মাম্মি। সুনিতা রাজওয়ার অভিনয় করেছেন এ চরিত্রে।

একদম সাধারণ পরিচিত মধ্যবিত্ত পরিবার আমাদের এ মিশ্র পরিবার। চার সিজন পার করে আসা গুল্লাক দেখিয়েছে মিশ্র পরিবারের প্রায় কুড়িটি ‘কিসসা’। সেখানে কখনো একই ঘরে থাকা নিয়ে দুই ভাইয়ের মধ্যে ঝগড়া হয়। কখনো দেখা যায়, ছেলেদের বাড়ি ফেরার অপেক্ষায় প্রিয় খাবার সামনে নিয়ে বসে আছেন বাবা-মা। কখনো বাবার চাকরি নিয়ে সমস্যা, কখনো বোকাটে ছোট ছেলেটি এলাকার সবচেয়ে ভালো ছাত্রে পরিণত হয়। দেয়ালে দেয়ালে সাঁটানো হয় তার পোস্টার।

গুল্লাকের চতুর্থ সিজন স্ট্রিম হলো এ মাসে। ২০১৯ সালে টিভিএফের ব্যানারে প্রথম আসে গুল্লাক। সিরিজটির পরিকল্পনা ও নির্মাণ ছিল শ্রেয়াংশ পাণ্ডের। গুল্লাক যখন আসে তখন ভারতীয় ওটিটি কেবল চলা শুরু করেছে। সে সময় জনপ্রিয়তা ছিল থ্রিলার সিরিজের। এর মধ্যে টিভিএফ এনেছিল মধ্যবিত্ত পরিবারের সাধারণ কিছু গল্প। মিশ্র পরিবারের কোনো গ্ল্যামার নেই। তারা অতি সাধারণ। সন্তোষ মিশ্র চরিত্রে অভিনয় করেছেন জামিল খান ও শান্তি মিশ্রর চরিত্রে গীতাঞ্জলি কুলকার্নি। দুজনই তথাকথিত গ্ল্যামার থেকে অনেক দূরের মানুষ। কিন্তু রীতিমতো জাত অভিনেতা। সে কারণেই পরিবারের ‘পাপা’ যখন ছেলেদের প্রতি রাগেন, বাজার করতে যান বা পাশের বাড়ির কারো সঙ্গে কথা বলেন তখন তা খুবই বাস্তব মনে হয়। একইভাবে ‘মাম্মি’ যখন ছেলেদের খামতি লুকান বা তাদের বকেন কিংবা নিজে কোনো বিষয়ে আপস করে নেন, তা-ও আমরা মেলাতে পারি নিজেদের সঙ্গে।

খুবই সাধারণ গল্প নিয়ে সাধারণ একটা সিরিজ। কিন্তু কী নেই এখানে? প্রথমেই বলা যায় এখানে আছে নস্টালজিয়া। শীতের সকাল, বাড়ির হাল হকিকত, ছোট ছোট ঝগড়া, ছোট ছোট আনন্দ নিয়ে এর যাত্রা। কিন্তু তার মধ্যেই থাকে বেড়ে ওঠার গল্প। আমরা দেখি আন্নু (আনন্দ মিশ্র) বড় হয়েছে কিন্তু এখনো তার চাকরি হয়নি। তা নিয়ে পরিবারে আছে চাপা দুশ্চিন্তা। পরিবারের বড় ছেলের চাকরিবাকরি না হলে কেমন অবস্থা হয় দর্শক তা নিজের সঙ্গে মিলিয়ে নিতে পারেন। এরপর আসে আমানের কথা। সে পড়াশোনায় খুব একটা ভালো না। বাড়ির কাজ, সংসারও বোঝে না। কিন্তু দিনশেষে এ সিরিজ দর্শককে দেখায় সময়ের সঙ্গে পরিবারের এ মানুষগুলো দায়িত্ব নিতে শিখে যায়।

আর তার জন্য দরকার হয় বাবা-মায়ের সমর্থন। কখনো মা বকেন তো বাবা সামলে নেন, কখনো উল্টো। বিট্টুর মা আমাদের প্রতিবেশী আন্টিদের প্রতিনিধি। আর এ সিরিজ কোনো না কোনো সময় নারী অধিকারের কথাও বলে। শান্তি মিশ্রর অসুস্থতা, তার রোজকার কাজ নিয়ে স্বামী সন্তোষ মিশ্র ও দুই ছেলের নানা রকম বিদ্রূপের এক সময় জবাব দেয় সে। আর তারপর পরিবারের বাকি তিনজন ঘরের কাজ ভাগ করে নেয়। করতে গিয়ে তারা বুঝতে পারে একটা পরিবারে নারীর ভূমিকা কেমন হতে পারে। আছে আমানের বেড়ে ওঠার সময়ের সমস্যাগুলো। প্যারেন্টিং, বয়ঃসন্ধিকালের কনফিউশন থেকে শুরু করে অর্থনীতি, দুর্নীতির কথাও আসে। লেবার ইউনিয়ন থেকে ঘুষ ও রাজনীতির আলাপও করেছেন নির্মাতারা। দেখানো হয়েছে নিজে সৎ থাকলে কোনো না কোনোভাবে চারপাশের মানুষ এক সময় তার কাছে হেরেই যায়।

টিভিএফের অধীনে এ সিরিজ পরিকল্পনা করেছিলেন শ্রেয়াংশ পাণ্ডে। প্রথম সিজনে পরিচালক ছিলেন অমৃত রাজ গুপ্তা। দ্বিতীয় ও তৃতীয় সিজনে পলাশ ভাসওয়ানি ও মোহসিন খান এবং চতুর্থ সিজন পুরোটার পরিচালক ছিলেন খোদ শ্রেয়াংশ। গুল্লাক হিসেবে কণ্ঠ দিয়েছেন শিবাঙ্কিত সিং পারিহার। ভারতের গণমাধ্যম টাইমস অব ইন্ডিয়া, হিন্দুস্তান টাইমস, এনডিটিভি, কোইমোইসহ সবাই এর প্রশংসা করেছেন ন্যারেটিভ ও সরলতার কারণে।

মিশ্র পরিবারের যে গল্পগুলো গুল্লাক দেখায় বা বলে, তার সঙ্গে দর্শক নিজেকে যুক্ত করতে পারে খুব সহজেই। আলাদা কোনো গল্প তো নয় মিশ্র পরিবারের। তাই গুল্লাক হয়ে ওঠে এ সময়ের একক পরিবারের জার্নাল।

এই বিভাগের আরও খবর

আরও পড়ুন