সিলেট বিভাগে বন্যায় মৎস্য খাতে ১৫০ কোটি টাকার ক্ষতি

নূর আহমদ, সিলেট

জাল দিয়ে মাছ আটকানোর চেষ্টা করেও শেষ রক্ষা হয়নি খামারিদের। ছবিটি সুনামগঞ্জের শান্তিগঞ্জ এলাকার ছবি: নিজস্ব আলোকচিত্রী

সিলেটের জকিগঞ্জ উপজেলার ক্ষুদ্র খামারি সজীব রহমান ব্যাংক থেকে ঋণ নিয়ে মাছ চাষ করেছিলেন। লাভের টাকা দিয়ে ঋণ পরিশোধ করার আশা ছিল তার। তবে সেটি আর হয়নি। সাম্প্রতিক বন্যায় তার জলাশয়ের সব মাছ ভেসে গেছে। উল্টো ঋণ নিয়ে এখন বিপাকে পড়েছেন এ খামারি।

শুধু সজীব রহমান নন, বন্যায় সিলেট বিভাগে প্রায় ৩০ হাজার পুকুর, খামার ও জলাশয়ের মাছ ভেসে গেছে। শুধু মৎস্য খাতেই ক্ষতি হয়েছে প্রায় ১৫০ কোটি টাকার। বন্যার পানি কমলেও অনেক এলাকা এখনো জলমগ্ন রয়েছে। সিলেট, সুনামগঞ্জ ও মৌলভীবাজারের বিভিন্ন অঞ্চলে এখনো আশ্রয় কেন্দ্র ছেড়ে যেতে পারেননি অনেকেই। থেমে থেমে বৃষ্টিপাত অব্যাহত রয়েছে।

সিলেট জেলা প্রশাসনের তথ্যমতে, নগরীর দুটি ওয়ার্ডসহ ১৩টি উপজেলা বন্যাকবলিত হয়ে এখনো কিছু মানুষ আশ্রয় কেন্দ্রে অবস্থান করছে। সর্বশেষ হিসাব অনুযায়ী, জেলার ৭৩৪টি আশ্রয় কেন্দ্রের মধ্যে ২৩৭টিতে বন্যাকবলিত মানুষ অবস্থান করছিল। ১২ হাজার ৪২৩ জন এখনো আশ্রয় কেন্দ্রে রয়েছে। ঘরবাড়ি বিধ্বস্ত হওয়ায় অনেকেই বাড়ি ফিরতে পারছেন না। বন্যায় সব খাতেই ক্ষতি হয়েছে। এর মধ্যে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে মৎস্য খাত।

সিলেট জেলা মৎস্য কর্মকর্তার কার্যালয় সূত্রে জানা গেছে, এবার দুইদফা বন্যার কবলে পড়ে সিলেট অঞ্চলের সীমান্তবর্তী এলাকাগুলো। চাইলেও অনেক খামারি মাছ আটকে রাখতে পারেনি। প্রথম দফায় একটু কম হলেও কয়েক দিন আগের বন্যায় একেবারেই ভেসে গেছে পুকুর, জলাশয় ও মৎস্য খামার।

জেলা মৎস্য কর্মকর্তা (অতিরিক্ত দায়িত্ব) সীমা রানী বিশ্বাস বণিক বার্তাকে বলেন, ‘জেলার ২১ হাজার ১১১টি পুকুর, দিঘি ও খামারের মাছ বন্যার পানিতে ভেসে গেছে। এতে পুরো জেলায় ৪৪ কোটি ৮৫ লাখ ৬৬ হাজার টাকার মৎস্যসম্পদের ক্ষতি হয়েছে। সিলেটের ১৩টি উপজেলার মধ্যে সবচেয়ে বেশি ক্ষতি হয়েছে জকিগঞ্জে। উপজেলার ৬ হাজার ৭৫৫টি পুকুর, দিঘি ও খামারের মাছ ভেসে গিয়ে ১৮ কোটি ৩৯ লাখ টাকার ক্ষতি হয়েছে। তবে তুলনামূলক কম ক্ষতি হয়েছে সিলেট সদর উপজেলায়। মৎস্য খাতে এ উপজেলায় ৩১ লাখ টাকার ক্ষতি হয়েছে।

মৎস্য সম্পদের ভাণ্ডার বলা হয় সুনামগঞ্জকে। বন্যায় এ অঞ্চলেও ক্ষুদ্র ও মাঝারি পর্যায়ের চাষীরা ব্যাপক ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছেন।

জেলা মৎস্য কর্মকর্তা মো. শামসুল করিম বণিক বার্তাকে বলেন, ‘বন্যার পানিতে জেলার ১২টি উপজেলায় অন্তত আট হাজার পুকুরের মাছ ও পোনা মাছ ভেসে গেছে, যা পরিমাণে ৫০০ টন হবে। মাছ ভেসে যাওয়ার পাশাপাশি প্রবল স্রোতে পুকুরের পাড়ধস, ভাঙনসহ অবকাঠামোগত ক্ষতি মিলে প্রায় শতকোটি টাকার ক্ষতি হয়েছে।

জেলার ক্ষুদ্র ও মাঝারি চাষীরা পড়েছেন বিপাকে। বিশেষ করে যারা ব্যাংক থেকে ঋণ বা ধারদেনা করে মাছ চাষ করেছেন, তাদের বেশির ভাগই সব হারিয়ে নিঃস্বপ্রায়। ক্ষতি পুষিয়ে পুনরায় মাছ চাষে ফেরা নিয়েও অনিশ্চয়তায় রয়েছেন ক্ষতিগ্রস্ত চাষীরা। এজন্য ঘুরে দাঁড়াতে সরকারের সহযোগিতাও চেয়েছেন তারা।

সুনামগঞ্জ সদর উপজেলার কাঠইর ইউনিয়নের শাখাইতি গ্রামের ক্ষুদ্র চাষী আব্দুল্লাহ মিয়া জানান, বড় দুটি পুকুরে এবার দুই লাখ মাছের পোনা ছেড়েছিলেন। লাভবান হওয়ার আশাও ছিল তার। তবে বানের জল তার সব ভাসিয়ে নিয়ে গেছে। বাজার থেকে জাল কিনে মাছ আটকানোর চেষ্টা করেও শেষ রক্ষা হয়নি।

সুনামগঞ্জ জেলা মৎস্য কর্মকর্তা মো. শামছুল করিম জানান, বন্যায় সুনামগঞ্জের মাছচাষীদের ব্যাপক ক্ষতি হয়েছে। ক্ষতির তালিকা প্রস্তুত করে ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের কাছে প্রস্তাব পাঠিয়েছেন তারা।

মৌলভীবাজার জেলা মৎস্য অধিদপ্তরের দেয়া তথ্যমতে, বন্যায় অন্তত ৫ কোটি টাকার মাছ ভেসে গেছে এ জেলায়। ১০ হাজারের বেশি চাষী ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছেন।

জেলা মৎস্য কর্মকর্তা মো. শাহনেওয়াজ সিরাজী বণিক বার্তাকে বলেন, ‘জেলার সাত উপজেলায় ১০ হাজারের বেশি মাছচাষী ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছেন। ১০৪ হেক্টর জমিতে ৭১৮টি পুকুর, জলাশয় ও দিঘির ২২৫ টন মাছ ভেসে গেছে। এতে ৪ কোটি ১৮ লাখ টাকার ক্ষতি হয়েছে। এছাড়া ৭৯ টন মাছের পোনা ভেসে গেছে, যার দাম ৭১ লাখ টাকা। সব মিলিয়ে ৫ কোটি টাকার ক্ষতি হয়েছে মৎস্য খাতে। ক্ষতিগ্রস্ত খামারিদের তালিকা তৈরি করে মন্ত্রণালয়ে পাঠানো হয়েছে। সহায়তার জন্য সুপারিশও করা হয়েছে।

অন্যদিকে হবিগঞ্জের নবীগঞ্জসহ বন্যায় জেলার মৎস্য খাতের ব্যাপক ক্ষতি হয়েছে। এ ব্যাপারে জেলা মৎস্য কর্মকর্তা মোহাম্মদ ওয়াহিদুল রহমান মজুমদার বলেন, ‘৩০০-৪০০ মৎস্য খামারের মাছ বন্যার পানিতে ভেসে গেছে। তবে ক্ষতির সঠিক হিসাব এখনো নির্ণয় করা হয়নি।’

সার্বিক বিষয়ে সিলেটের জেলা প্রশাসক শেখ রাসেল হাসান বণিক বার্তাকে বলেন, ‘বন্যায় শুধু পুকুরের মাছ ভেসে যায়নি। প্রায় সব খাতই ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। এখনো বন্যার পানি নেমে যায়নি। আশ্রয় কেন্দ্র ছাড়েনি বাসভাসিরা। সব খাতের ক্ষয়ক্ষতির নিরূপণ এখনো হয়নি। বন্যা পরিস্থিতির আরো উন্নতি হলে খাত ধরে সরকারি সহায়তার সুপারিশ করা হয়েছে। আশা করি ক্ষতিগ্রস্তরা এর সুফল পাবেন।’

এই বিভাগের আরও খবর

আরও পড়ুন