দেশের ‍বৃহৎ শিল্প এলাকা চট্টগ্রামে বিদ্যুৎ চাহিদা সবচেয়ে কম!

আবু তাহের ও সুজিত সাহা

ছবি : বণিক বার্তা

দেশের ভারী শিল্পপ্রতিষ্ঠানগুলোর বৃহদংশের অবস্থান চট্টগ্রাম বিভাগের জেলাগুলোয়। বিশেষ করে ইস্পাত, সিমেন্ট, জাহাজ ভাঙা শিল্প, পোশাক খাতের বড় বড় প্রতিষ্ঠান ছাড়াও এখানে গড়ে তোলা হয়েছে বৃহদায়তনের বেশ কিছু রফতানি প্রক্রিয়াকরণ অঞ্চল (ইপিজেড) ও অর্থনৈতিক অঞ্চল। এ অনুযায়ী সঞ্চালন কোম্পানি পাওয়ার গ্রিড কোম্পানি অব বাংলাদেশের (পিজিসিবি) নয়টি বিতরণ জোনের মধ্যে ঢাকার পর চট্টগ্রামে বিদ্যুতের চাহিদা সবচেয়ে বেশি হওয়ার কথা বলে মনে করছেন বিশেষজ্ঞরা। যদিও সংস্থাটির পরিসংখ্যান বলছে, শিল্পপ্রতিষ্ঠানের সংখ্যা বেশি হলেও চট্টগ্রাম জোনে বিদ্যুতের চাহিদা খুলনা, কুমিল্লা বা রাজশাহীর চেয়েও কম।

বিদ্যুতের প্রকৃত চাহিদা নিরূপণ না হওয়ার কারণেই পরিসংখ্যানে এমন অসামঞ্জস্য দেখা যাচ্ছে বলে অভিমত বিদ্যুৎ বিভাগসংশ্লিষ্ট ও বিশেষজ্ঞদের। প্রকৃত চাহিদা নিরূপণ করে বিদ্যুৎ সরবরাহ দেয়া গেলে এদিক থেকে চট্টগ্রামের অবস্থান ঢাকার পরেই দাঁড়াবে বলে মনে করছেন তারা। এ বিষয়ে জানতে চাওয়া হলে বিদ্যুৎ বিভাগ বা বিতরণ কোম্পানিগুলোর কাছ থেকে আনুষ্ঠানিক কোনো স্পষ্ট কোনো উত্তর পাওয়া যায়নি। 

পিজিসিবির তথ্য অনুযায়ী, সাম্প্রতিক মাসগুলোয় বিদ্যুতের চাহিদা ও বিতরণ সবচেয়ে বেশি ছিল ঢাকা জোনে। এর পরই রয়েছে যথাক্রমে খুলনা ও রাজশাহী জোনের অবস্থান। যদিও দুটি জোনেই শিল্পপ্রতিষ্ঠানের সংখ্যা চট্টগ্রামের চেয়ে তুলনামূলক অনেক কম।

চলতি বছরের ৩০ এপ্রিল দেশে সর্বোচ্চ বিদ্যুৎ উৎপাদনের রেকর্ড করে বাংলাদেশ বিদ্যুৎ উন্নয়ন বোর্ড (বিপিডিবি)। ওই দিন রাত ১১টায় সংস্থাটি বিদ্যুতের সর্বোচ্চ উৎপাদন রেকর্ড করেছিল ১৬ হাজার ৪৭৭ মেগাওয়াট। এর মধ্যে ঢাকা জোনে বিদ্যুতের সরবরাহ ছিল ৫ হাজার ৬৭৪ মেগাওয়াট। খুলনায় ও রাজশাহীতে হয়েছে যথাক্রমে ১ হাজার ৯৬৭ ও ১ হাজার ৮৭০ মেগাওয়াট। কুমিল্লা জোনে হয়েছে ১ হাজার ৫৫১ মেগাওয়াট। এর পরেই ছিল চট্টগ্রাম বিভাগের অবস্থান ১ হাজার ৪৪৮ মেগাওয়াট। এছাড়া ওই সময় বরিশাল, সিলেট, রংপুর ও ময়মনসিংহ জোনে বিদ্যুতের সরবরাহ হয়েছে যথাক্রমে ৫১২ মেগাওয়াট, ৩৬০, ৯৯১ ও ১ হাজার ২০২ মেগাওয়াট।

বিপিডিবির সদস্য (বিতরণ) মো. রেজাউল করিম বণিক বার্তাকে বলেন, ‘বিতরণের ভৌগোলিক এলাকা হিসেবে চট্টগ্রামের চেয়ে রাজশাহী অনেক বড়। সে কারণে সেখানে বিদ্যুতের চাহিদা বেশি হতে পারে। তাছাড়া চট্টগ্রামের বৃহৎ শিল্প-কারখানাগুলোয় পিক বা অফ-পিক আওয়ার বিবেচনা করে বিদ্যুৎ ব্যবহার করা হয়। এছাড়া অনেক ভারী শিল্প রয়েছে যাদের বিদ্যুতের ডিমান্ড অনেক বেশি, তবুও তারা কম ব্যবহার করে। এছাড়া চট্টগ্রাম ও কুমিল্লা দুটি জোন হয়ে যাওয়ায় সেখানে বিদ্যুতের চাহিদা ভাগাভাগি হয়ে যাওয়াও বড় একটি কারণ।’

চট্টগ্রামে জাহাজ নির্মাণ শিল্প, সিমেন্ট, রড, অ্যাঙ্গেল, ঢেউটিন, পলিমার, ভোজ্যতেল, সরকারি-বেসরকারি জ্বালানি পরিশোধনসহ কয়েক হাজার শিল্প-কারখানা। এছাড়া দুটি এক্সপোর্ট প্রসেসিং জোন (ইপিজেড) পাঁচটি বিসিক শিল্প নগরী, গার্মেন্টসও রয়েছে। এর বাইরে বিদেশী বিনিয়োগে গড়ে ওঠা চায়না ইপিজেড, কোরিয়ান ইপিজেডসহ বহু বড় বড় বেসরকারি শিল্প এলাকা রয়েছে। এসব শিল্প এলাকায় বড় আকারে বিদ্যুতের চাহিদা থাকলেও কয়েক বছর ধরে গ্যাস-বিদ্যুতের সংকটে অনেকেই ছোট পরিসরে ক্যাপটিভ পাওয়ার অনুমোদন নিয়ে আপৎকালীন সংকট মোকাবেলা করছে। যে কারণে এসব শিল্প-কারখানা গ্রিডে থেকে বিদ্যুৎ না নেয়ায় বিদ্যুতের চাহিদা কমেছে।

চট্টগ্রামের শিল্পোদ্যোক্তাদের অভিযোগ, এখানকার ভারী কারখানাগুলো চাহিদা অনুযায়ী বিদ্যুৎ সরবরাহ পায় না। দেশের ইস্পাত খাতের অন্যতম শীর্ষ শিল্পপ্রতিষ্ঠান বাংলাদেশ স্টিল রি-রোলিং মিলস (বিএসআরএম) কর্তৃপক্ষের একাধিক ভারী কারখানায় প্রতিদিন বিদ্যুৎ ব্যবহারের অনুমোদন রয়েছে প্রায় ৩০০ মেগাওয়াট। কিন্তু প্রতিষ্ঠানটি প্রতিদিন বিদ্যুৎ ব্যবহার করতে পারে ২২০-২৩০ মেগাওয়াট। 

বিএসআরএম কর্তৃপক্ষের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, আজ বিএসআরএমের মিরসরাই কারখানায় বিদ্যুৎ থাকবে না। বিএসআরএমের সবচেয়ে বড় এ কারখানা একদিন বন্ধ রাখলে উৎপাদন ব্যয় ব্যাপক মাত্রায় বেড়ে যায়। সংকট নিরসনে প্রতিষ্ঠানটি একটি কয়লাভিত্তিক নিজস্ব বিদ্যুৎ কারখানার অনুমোদন নিয়ে রাখলেও সেটি চালু রাখা যাচ্ছে না। এতে দীর্ঘমেয়াদি লক্ষ্য নিয়ে ইস্পাত পণ্য উৎপাদন বাড়ানোর পরিকল্পনা থাকলেও সেটি করা যাচ্ছে না। 

বিএসআরএমের উপব্যবস্থাপনা পরিচালক তপন সেনগুপ্ত বণিক বার্তাকে বলেন, ‘ভারী শিল্প-কারখানার নগরী সত্ত্বেও চট্টগ্রামে বিদ্যুৎ ব্যবহারের হার কতটুকু সেটি নির্দিষ্ট করে জানা নেই। তবে বেশ কিছুদিন ধরে চট্টগ্রামের শিল্পোদ্যোক্তারা চাহিদা অনুযায়ী বিদ্যুৎ পাচ্ছে না। ভারী শিল্পের ক্ষেত্রে নিয়মিত ও নিরবচ্ছিন্ন বিদ্যুৎ সরবরাহ জরুরি হলেও চট্টগ্রামের উদ্যোক্তাদের রেশনিংয়ের মাধ্যমে বিদ্যুৎ ব্যবহার করতে হচ্ছে। চট্টগ্রামের শিল্প জোনগুলোয় প্রতি সপ্তাহে বাধ্যতামূলকভাবে একদিন বিদ্যুৎ সরবরাহ বন্ধ রাখা হয়। এমনকি অন্যান্য দিনও লোডশেডিংয়ের কবলে পড়তে হচ্ছে শিল্প-কারখানাগুলোকে। এ কারণে উৎপাদন কমে যাওয়ার পাশাপাশি উৎপাদন খরচও বেড়ে যাচ্ছে। এতে প্রতিযোগিতামূলক বাজারে কাঙ্ক্ষিত লক্ষ্যমাত্রা অর্জনে বঞ্চিত হচ্ছেন উদ্যোক্তারা।’

শিল্প মালিকদের সংগঠনগুলোর ভাষ্যমতে, নিরবচ্ছিন্ন বিদ্যুৎ সরবরাহ না পাওয়ায় অনেকেই চট্টগ্রাম থেকে কারখানা স্থানান্তরের কথা ভাবছেন। দি চিটাগাং চেম্বার অব কমার্স অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রির সভাপতি ওমর হাজ্জাজ বণিক বার্তাকে বলেন, ‘গ্যাসের মতোই চট্টগ্রামে বিদ্যুতের সংকটও অনেক বেশি। দেশের সবচেয়ে ভারী শিল্প-কারখানা সমৃদ্ধ বন্দরনগরী চট্টগ্রাম হলেও এখানে বিদ্যুৎসহ বিভিন্ন ধরনের জ্বালানির অপ্রতুলতায় অনেকেই নতুন বিনিয়োগে উৎসাহিত হচ্ছেন না। এমনকি চট্টগ্রামের উদ্যোক্তাদের অনেকেই ঢাকাসহ দেশের বিভিন্ন এলাকার কৌশলগত কারণে কারখানা স্থানান্তর করছেন। শিল্পভিত্তিক অর্থনৈতিক কাঠামো গড়ে তোলার ক্ষেত্রে বিদ্যুতের ব্যবহার বাড়াতে চট্টগ্রামের প্রতি বিশেষ নজর দেয়া জরুরি। সেটি করা না গেলে সমুদ্রবন্দরের সুবিধাকে কাজে লাগানো যাবে না। এতে উৎপাদন, রফতানি ও কর্মসংস্থানের যে সুযোগের ব্যাপক সম্ভাবনা ছিল, তা থেকে পুরো দেশ বঞ্চিত হবে।’

দেশে বিদ্যুতের চাহিদা বাড়বে এমন প্রাক্কলন থেকেই বিভিন্ন বিদ্যুৎ উৎপাদন কেন্দ্র নির্মাণ ও অনুমোদন দেয়া হচ্ছে। বড় কয়েকটি কেন্দ্র এখন উৎপাদনেও আসছে গবেষণা প্রতিষ্ঠান সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগের (সিপিডি) এক হিসাব অনুযায়ী, দেশে বিদ্যুতের সক্ষমতার প্রায় ৪৭ শতাংশই অব্যবহৃত থাকছে। আবার চাহিদা পূরণের জন্য পর্যাপ্ত জ্বালানি আমদানির অর্থও নেই বিপিডিবির কাছে। এ কারণে বাধ্য হয়ে কখনো কখনো চাহিদার তুলনায় ২ থেকে আড়াই হাজার মেগাওয়াট পর্যন্ত লোডশেডিং করতে হচ্ছে বলে জানিয়েছেন সংশ্লিষ্টরা।

নাম অপ্রকাশিত রাখার শর্তে বিদ্যুৎ বিভাগের এক কর্মকর্তা বণিক বার্তাকে বলেন, ‘চট্টগ্রাম জোনে বিদ্যুতের প্রকৃত চাহিদা ১৭-১৮ হাজার মেগাওয়াট। সেখানে চাহিদা অনুযায়ী বিদ্যুৎ দেয়া যায় না। সেটি করতে গেলে সারা দেশে লোডশেডিং হবে। সেখানে নিরবচ্ছিন্ন সরবরাহ নিশ্চিত করা গেলে বড় আকারে বিদ্যুতের চাহিদা তৈরি করা যাবে।’

এই বিভাগের আরও খবর

আরও পড়ুন