তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তি অধিদপ্তর

নিজ কার্যালয় ফাঁকা রেখে ঢাকায় অফিস করছেন ৮৭ জেলা-উপজেলা কর্মকর্তা

আরফিন শরিয়ত

ছবি : বণিক বার্তা

তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তি (আইসিটি) খাতকে এগিয়ে নিতে জেলা ও উপজেলায় স্থাপন করা হয় আইসিটি কার্যালয়। ই-সরকারের মাঠ প্রশাসনের সঙ্গে নিবিড় সম্পর্ক গড়ে তুলতে নিয়োগ দেয়া হয় প্রোগ্রামার বা জেলা আইসিটি অফিসার, সহকারী প্রোগ্রামার বা উপজেলা আইসিটি অফিসার, সহকারী নেটওয়ার্ক ইঞ্জিনিয়ার। যদিও এসব কার্যালয়ের অনেক অফিসপ্রধানই এখন অফিস করছেন ঢাকায় বসে। মাঠপর্যায়ের কার্যালয়গুলো ফাঁকা রেখে তাদেরকে আইসিটি অধিদপ্তরের প্রধান কার্যালয় কিংবা সরকারের অন্যান্য দপ্তরে সংযুক্ত করা হয়েছে। 

খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, জেলা ও উপজেলা আইসিটি কার্যালয়ে কর্মরত ৫০৭ কর্মকর্তার মধ্যে বর্তমানে ঢাকায় অফিস করছেন ৮৭ জন। তাদের অনেককে কাজের প্রয়োজনে সংযুক্ত করা হলেও বেশির ভাগই এসেছেন তদবির করে। এর ফলে প্রায়ই ফাঁকা থাকছে তাদের দায়িত্বপ্রাপ্ত জেলা ও উপজেলা কার্যালয়গুলো। বিশেষ প্রয়োজনে অতিরিক্ত হিসেবে দায়িত্ব দিয়ে পার্শ্ববর্তী জেলা কিংবা উপজেলার আইসিটি অফিসারকে এনে কাজ সারা হচ্ছে।

মুন্সিগঞ্জ জেলার আইসিটি অফিসারের দায়িত্বে ছিলেন তানিয়া নূর। এখন তিনি ঢাকায় প্রধান কার্যালয়ে প্রোগ্রামার হিসেবে কাজ করছেন। তার কর্মস্থল মুন্সিগঞ্জে অতিরিক্ত দায়িত্ব পালন করছেন গজারিয়া উপজেলার আইসিটি অফিসার মো. কামরুজ্জামান। প্রধান কার্যালয়ে সংযুক্তির বিষয়ে জানতে চাইলে তানিয়া নূর বণিক বার্তাকে বলেন, ‘আমি আপনাকে এসব কথা বলতে যাব না। আইসিটি অধিদপ্তরের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারা আছেন, তাদের সঙ্গে কথা বলেন।’

আইসিটি অধিদপ্তরের তথ্য অনুযায়ী, বর্তমানে প্রোগ্রামার পদের জন্য অধিদপ্তরে অনুমোদিত পদ রয়েছে ৬৪টি (প্রতি জেলায় একজন করে)। এর মধ্যে কর্মরত আছেন ৪২ কর্মকর্তা। প্রোগ্রামাররা মূলত জেলার আইসিটি অফিসার হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। এসব কর্মকর্তার মধ্যে আবার আটজন আইসিটি অধিদপ্তরের প্রধান কার্যালয়ে এবং পাঁচজন সরকারের বিভিন্ন দপ্তরে সংযুক্ত রয়েছেন। সে হিসেবে ৬৪টির মধ্যে বর্তমানে ৩৫ জেলা কার্যালয়েই কোনো অফিসপ্রধান নেই। 

অন্যদিকে অনুমোদিত ৪৯২টি সহকারী প্রোগ্রামার পদের মধ্যে কর্মরত আছেন ৪৬৫ জন, যারা মূলত উপজেলা কার্যালয়ের দায়িত্ব পালন করে থাকেন। তাদের মধ্যে আবার ৩১ কর্মকর্তা প্রধান কার্যালয়ে ও ৩৫ জন সরকারের অন্যান্য দপ্তরে সংযুক্ত রয়েছেন। জেলার সহকারী নেটওয়ার্ক ইঞ্জিনিয়ারদের মধ্যে আটজন প্রধান কার্যালয় ও সরকারের বিভিন্ন দপ্তরে সংযুক্ত রয়েছেন। জেলার সহকারী নেটওয়ার্ক ইঞ্জিনিয়ারদের মধ্যে প্রধান কার্যালয় ও সরকারের অন্যান্য দপ্তরে সংযুক্ত রয়েছেন আটজন। প্রধান কার্যালয়ের পাশাপাশি এসব কর্মকর্তাকে মূলত এজেন্সি টু ইনোভেট (এটুআই), বিভিন্ন সিটি করপোরেশন, নার্সিং অ্যান্ড মিডওয়াইফারি অধিদপ্তর, ডিজিটাল সিকিউরিটি এজেন্সি, মন্ত্রিপরিষদ বিভাগ, বিভাগীয় কমিশনারের কার্যালয়, সরকারি কর্মকমিশন, স্থলবন্দর কর্তৃপক্ষ, জনশক্তি কর্মসংস্থান ও প্রশিক্ষণ ব্যুরো, বেসরকারি শিক্ষক নিবন্ধন ও প্রত্যয়ন কর্তৃপক্ষ (এনটিআরসিএ), বাংলাদেশ বিনিয়োগ উন্নয়ন কর্তৃপক্ষের কার্যালয়ে সংযুক্ত করা হয়েছে। 

জানতে চাইলে আইসিটি অধিদপ্তরের কর্মকর্তা আব্দুল্লাহ আল রহমান বণিক বার্তাকে বলেন, ‘উপজেলা পর্যায়ে সহকারী প্রোগ্রামাররা আইসিটি অফিসার হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন এবং জেলা কার্যালয়ে প্রোগ্রামার পদবির কর্মকর্তারা দায়িত্বে থাকেন। জেলা পর্যায় থেকে কোনো প্রোগ্রামার প্রধান কার্যালয় বা অন্য কোনো দপ্তরে সংযুক্ত হলে জেলায় দায়িত্বরত সহকারী প্রোগ্রামার অতিরিক্ত দায়িত্ব হিসেবে কাজ করেন। একই সঙ্গে অন্য উপজেলার একজন সহকারী প্রোগ্রামারকেও জেলার অতিরিক্ত দায়িত্ব দেয়া হয়। আর উপজেলা আইসিটি কার্যালয়ের কেউ কেন্দ্রে বা অন্য কোথাও সংযুক্ত হলে পার্শ্ববর্তী উপজেলার কর্মকর্তাকে অতিরিক্ত হিসেবে দায়িত্ব দেয়া হয়।’ 

অতিরিক্ত দায়িত্ব পাওয়া কর্মকর্তাদের কয়েকজনের সঙ্গে কথা হলে তারা জানান, উপজেলাগুলোয় দায়িত্ব পালন করতে আসা সরকারি কর্মকর্তাদের অনেকেই আইসিটির নানা বিষয় বোঝেন না। তুলনামূলক তরুণ কর্মকর্তারা কিছুটা বুঝলেও প্রবীণদের কাজগুলো আইসিটি কর্মকর্তাদেরই করে দিতে হয়। ফলে কোনো সহযোগী ছাড়া এক উপজেলায় কাজ করা কঠিন হয়ে পড়ে। আবার যারা অতিরিক্ত দায়িত্ব পালন করে তারা কোনো উপজেলার কাজই পুরোপুরিভাবে করতে পারেন না, নানা বেগ পেতে হয়। অনেক সময় তাদেরকে খুব স্পর্শকাতর বিষয়েও সিদ্ধান্ত নিতে হয়। 

জানা যায়, আইসিটি কর্মকর্তাদের বেশির ভাগই জেলা কিংবা উপজেলায় থাকতে চান না। অনেকেই সরকারি ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা, মন্ত্রী, এমপির সুপারিশে প্রধান প্রধান কার্যালয় কিংবা সরকারের বিভিন্ন দপ্তরে সংযুক্ত হয়ে ঢাকায় চলে আসেন। এতে পাঠপর্যায়ের কার্যক্রম পরিচালনায় ভোগান্তিতে পড়তে হয় জেলা-উপজেলার কর্মকর্তাদের। 

জানতে চাইলে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে তথ্যপ্রযুক্তি ইনস্টিটিউটের পরিচালক অধ্যাপক ড. বিএম মইনুল হোসেন বণিক বার্তাকে বলেন, ‘এমনিতেই আমাদের সাধারণ মানুষের মধ্যে ডিজিটাল সাক্ষরতার অভাব রয়েছে, তাছাড়া স্থানীয় পর্যায়ে কর্মরত সরকারি কর্মকর্তারাও বেশকিছু ডিজিটাল পদ্ধতির সঙ্গে পুরোপুরি অভ্যস্ত হয়ে ওঠেননি। এজন্য আইসিটি কর্মকর্তাদের সার্বক্ষণিক উপস্থিত থাকার প্রয়োজন আছে। তবে উপজেলা আইসিটি অফিসারকে কর্মস্থল থেকে সরিয়ে নিয়ে এলে যদি কার্যক্রম পরিচালনা করা সম্ভব হয়, তাহলে তো এ নিয়োগের প্রয়োজনই ছিল না। সেখানে এতদিন অতিরিক্ত জনবল দিয়ে রাখা হয়েছিল।’ 

সংশ্লিষ্ট উপজেলায় আইসিটি অফিসার না থাকায় সরকারের ডিজিটাল বাংলাদেশ বিনির্মাণ ও স্মার্ট বাংলাদেশ ভিশন নিয়ে গৃহীত বেশকিছু কার্যক্রম বাধার সম্মুখীন হবে বলে জানান এ আইসিটি বিশেষজ্ঞ। তিনি বলেন, ‘কর্মকর্তাদের যথসময়ে পর্যাপ্ত প্রশিক্ষণ ও সরঞ্জাম দিতে হবে। সরকারের ডিজিটাল উদ্যোগকে জনগণের দ্বারপ্রান্তে নিয়ে যেতে একই সঙ্গে তাদের এমন সুযোগ দিতে হবে, যাতে তারা জেলা-উপজেলা পর্যায়ে আইসিটি বিষয়ে স্বাধীনভাবে সিদ্ধান্ত নিতে এবং নতুন উদ্ভাবনের সঙ্গে সম্পৃক্ত হতে পারে।’

তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তি খাতের অবকাঠামো উন্নয়নে এক দশকে ৬ হাজার ৭০ কোটি টাকার বেশি ব্যয়ে ২২টি প্রকল্প শেষ হয়েছে। সামনে ১৮ হাজার ৭৫১ কোটি টাকা ব্যয়ে ২২টি প্রকল্পের মাধ্যমে আইসিটি অবকাঠামো খাতকে আরো শক্তিশালী করতে চায় সরকার। এসব প্রকল্পের মধ্যে রয়েছে টেলিযোগাযোগ সুবিধাবঞ্চিত এলাকাগুলোয় কানেক্টিভিটি স্থাপন, এনহ্যান্সিং ডিজিটাল গভর্নমেন্ট অ্যান্ড ইকোনমি, ১১টি শেখ কামাল আইটি ট্রেনিং অ্যান্ড ইনকিউবেশন সেন্টার নির্মাণ, ১২ জেলায় জেলা পর্যায়ে আইটি ও হাই-টেক পার্ক স্থাপন, শেখ কামাল আইটি ট্রেনিং অ্যান্ড ইনকিউবেশন সেন্টার স্থাপন, ডিজিটাল উদ্যোক্তা এবং উদ্ভাবন ইকো-সিস্টেম উন্নয়ন প্রকল্প, ১৪টি শেখ কামাল আইটি ট্রেনিং ও ইনকিউবেশন সেন্টার, শেখ রাসেল ডিজিটাল ল্যাব স্থাপন, ডিজিটাল সংযোগ স্থাপন (ইডিসি) ইত্যাদি। আর এসব অবকাঠামোর স্থানীয় কর্তৃপক্ষ হিসেবে আইসিটি অধিদপ্তরের অধীনে কর্মরত জেলা ও উপজেলার আইসিটি কর্মকর্তারাই কাজ করে থাকেন। এর মধ্যে জেলার দায়িত্বপ্রাপ্ত প্রোগ্রামাররা সরকারের ষষ্ঠ গ্রেডের এবং সহকারী প্রোগ্রামাররা নবম গ্রেডের কর্মকর্তা। 

সার্বিক বিষয়ে জানতে চাইলে তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তি বিভাগের সচিব মো. সামসুল আরেফিন বণিক বার্তাকে বলেন, ‘আমরা মাঠপর্যায় থেকে যাদের নিয়ে আসি তারা যে প্রধান কার্যালয়ে থাকে বিষয়টি তেমন নয়। সরকারি অফিসগুলোয় আইসিটি কর্মকর্তার চাহিদা থাকে অনেক। সবাইকে আইসিটি অফিসার দিতে পারি না, তারপরও সরকারি গুরুত্বপূর্ণ দপ্তরগুলোয় আমরা এ সেবা দিয়ে থাকি। তারা আমাদের কাছে চাইলে তখন আমাদের কর্মকর্তাদের ডেপুটেশনে পাঠিয়ে থাকি। আমাদের তো আর বেশি জনবল নেই, যার কারণে পার্শ্ববর্তী উপজেলার অফিসারকে দায়িত্ব দিয়ে কার্যক্রম পরিচালনা করতে হয়। এতে খুব বেশি সমস্যা হয় না। উপজেলার দায়িত্বপ্রাপ্ত আমাদের কর্মকর্তারাও বর্তমান প্রজন্মের। তারাও অনেক কিছু বোঝেন। সেজন্য খুব বেশি সমস্যা হচ্ছে না। তারপরও আমরা দক্ষ জনবল বাড়ানোর চেষ্টা করছি।’

এই বিভাগের আরও খবর

আরও পড়ুন