ঢাকা এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ে প্রকল্প

ক্ষতিগ্রস্তদের জন্য তৈরি ফ্ল্যাট পেতে চান সরকারি কর্মকর্তারা

শামীম রাহমান

ঢাকা এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ে প্রকল্পে ক্ষতিগ্রস্তদের জন্য নির্মিত আবাসিক ভবন ছবি: বাংলাদেশ সেতু কর্তৃপক্ষ

রাজধানীর প্রথম দ্রুতগতির উড়ালসড়ক ঢাকা এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ে নির্মাণ করা হচ্ছে বিমানবন্দর-মগবাজার-যাত্রাবাড়ীর মধ্যে। প্রায় ২০ কিলোমিটার দীর্ঘ এ উড়ালসড়ক নির্মাণের কারণে যেসব ব্যক্তি জমি হারিয়ে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছেন, তাদের পুনর্বাসনের জন্য ঢাকার উত্তরা আবাসিক এলাকায় ১ হাজার ৩৪৪টি ফ্ল্যাট নির্মাণ করেছে প্রকল্প বাস্তবায়নকারী সংস্থা বাংলাদেশ সেতু কর্তৃপক্ষ। প্রকল্পের ফ্ল্যাট বরাদ্দ নীতিমালা অনুযায়ী, কেবল ঢাকা এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ে প্রকল্পের ক্ষতিগ্রস্ত ব্যক্তিরাই ফ্ল্যাট বরাদ্দের জন্য আবেদন করতে পারবেন। ফ্ল্যাটগুলো তৈরি হওয়ার পর এ নীতিমালা সংশোধনের উদ্যোগ নিয়েছে সংস্থাটি। এতে ক্ষতিগ্রস্তদের জন্য নির্মিত ফ্ল্যাটগুলো বরাদ্দের জন্য যোগ্য হবেন বাংলাদেশ সেতু কর্তৃপক্ষ ও সেতু বিভাগের কর্মকর্তা-কর্মচারীরা।

ঢাকা এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ে প্রকল্পের ক্ষতিগ্রস্তদের পুনর্বাসনের জন্য এসব ফ্ল্যাট নির্মাণ করা হয়েছে উত্তরা মডেল টাউন (তৃতীয় ফেজ) সংলগ্ন বড়কাঁকর, বাউনিয়া ও দ্বিগুণ মৌজায়। এজন্য গড়ে তোলা হয়েছে একটি ‘পুনর্বাসন ভিলেজ’। এখানে দুটি ব্লকে ভাগ করে ১২টি ভবনে ফ্ল্যাটগুলো তৈরি হয়েছে। প্রতিটি ভবন ১৪ তলা। ব্লক-‘এ’র ফ্ল্যাটগুলো ১ হাজার ২৯৪ বর্গফুট আয়তনের। পার্কিং সুবিধাসহ প্রতিটি ফ্ল্যাটের দাম নির্ধারণ করা হয়েছে ৫৪ লাখ ১৪ হাজার টাকা। পার্কিং সুবিধা বাদে ফ্ল্যাটগুলোর দাম পড়বে ৫১ লাখ ১৪ হাজার টাকা। ব্লক-‘বি’তে নির্মিত ফ্ল্যাটগুলো ১ হাজার ৯০ বর্গফুট আয়তনের। পার্কিং সুবিধাসহ প্রতিটি ফ্ল্যাটের দাম নির্ধারণ করা হয়েছে ৪৩ লাখ ৪৪ হাজার টাকা। পার্কিং সুবিধা ছাড়া ফ্ল্যাটগুলোর নির্ধারিত দাম ৪০ লাখ ৪৪ হাজার টাকা।

সেতু কর্তৃপক্ষের তথ্য বলছে, ঢাকা এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ে প্রকল্পের পুনর্বাসন ভিলেজে নির্মিত এসব ফ্ল্যাটের পাশাপাশি বিদ্যালয়, মসজিদ, কমিউনিটি সেন্টার, কমিউনিটি মার্কেট, কমিউনিটি ক্লিনিক, খেলার মাঠ, সুয়ারেজ ট্রিটমেন্ট প্লান্ট, সেকেন্ডারি ট্রান্সফার স্টেশন, ইলেকট্রিক্যাল সাব-স্টেশন, অভ্যন্তরীণ সড়ক, ড্রেন, গভীর নলকূপসহ বিভিন্ন অবকাঠামো নির্মাণ করা হয়েছে। সব মিলিয়ে পুনর্বাসন ভিলেজটি নির্মাণে খরচ হয়েছে প্রায় ৮০০ কোটি টাকা। সাপোর্ট টু ঢাকা এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ে নামের আলাদা একটি প্রকল্পের মাধ্যমে এসব ফ্ল্যাট তৈরি হয়েছে।

ফ্ল্যাটগুলোর বরাদ্দের জন্য একটি নীতিমালাও তৈরি করেছে বাংলাদেশ সেতু কর্তৃপক্ষ। ঢাকা এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ে প্রকল্পের পুনর্বাসন ভিলেজে ক্ষতিগ্রস্তদের অনুকূলে ফ্ল্যাট বরাদ্দ নীতিমালার ধারা ২, অনুচ্ছেদ ১-এ বলা আছে, কেবলমাত্র ঢাকা এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ে প্রকল্পের জন্য ভূমি অধিগ্রহণের ফলে ক্ষতিগ্রস্ত ব্যক্তিগণ ফ্ল্যাট বরাদ্দের জন্য আবেদন করতে পারবেন। সম্প্রতি এ অনুচ্ছেদ সংশোধনের উদ্যোগ নিয়েছে বাংলাদেশ সেতু কর্তৃপক্ষ।

প্রস্তাবিত সংশোধনীতে বলা হয়েছে, ঢাকা এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ে প্রকল্পের জন্য ভূমি অধিগ্রহণের ফলে ক্ষতিগ্রস্ত ব্যক্তিগণ ফ্ল্যাট বরাদ্দের জন্য আবেদন করতে পারবেন। পরবর্তীতে অগ্রগণ্যতার ক্রম অনুযায়ী খালি থাকা সাপেক্ষে বাংলাদেশ সেতু কর্তৃপক্ষের চলমান প্রকল্পের ক্ষতিগ্রস্ত ব্যক্তি, বাংলাদেশ সেতু কর্তৃপক্ষের কর্মকর্তা-কর্মচারী, সেতু বিভাগের কর্মকর্তা-কর্মচারী, সড়ক ও জনপথ অধিদপ্তরের প্রকল্পের ক্ষতিগ্রস্ত ব্যক্তি এবং অবশিষ্ট ফ্ল্যাট উন্মুক্ত বিজ্ঞপ্তির মাধ্যমে বরাদ্দ দেয়া যাবে। নীতিমালা সংশোধনের প্রস্তাব অনুমোদন হলে ফ্ল্যাটগুলো বরাদ্দ পাওয়ার যোগ্য হয়ে উঠবেন সেতু কর্তৃপক্ষ ও সেতু বিভাগের কর্মকর্তা-কর্মচারীরা।

ফ্ল্যাট বরাদ্দ নীতিমালা সংশোধনের এ উদ্যোগটিকে ‘‌নীতিমালার লঙ্ঘন’ হিসেবে অভিহিত করেছেন ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশের (টিআইবি) নির্বাহী পরিচালক ইফতেখারুজ্জামান। তিনি বণিক বার্তাকে বলেন, ‘এ ধরনের ঘটনাগুলো হতাশাব্যঞ্জক। তবে এতে অবাক হওয়ার কিছু দেখি না। সরকারি কর্মকর্তা-কর্মচারীরা এমনিতেই নানা সুযোগ পেয়ে থাকেন। আমি মনে করি, ক্ষতিগ্রস্ত ব্যক্তিদের জন্য তৈরি করা এসব ফ্ল্যাট প্রকৃত ক্ষতিগ্রস্ত ব্যক্তিদেরই বরাদ্দ দেয়া উচিত।’ 

তবে এ নীতিমালা এখনো চূড়ান্ত হয়নি এবং আরো পর্যালোচনা করা হচ্ছে বলে বণিক বার্তাকে জানিয়েছেন সরকারের সেতু বিভাগের সচিব ও বাংলাদেশ সেতু কর্তৃপক্ষের নির্বাহী পরিচালক মনজুর হোসেন। বিষয়টি নিয়ে জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘সরকারি কর্মকর্তাদের ফ্ল্যাট দেয়ার ক্ষেত্রে এখন পর্যন্ত কোনো সিদ্ধান্ত হয়নি। সেতু কর্তৃপক্ষের সর্বশেষ ১১৪ তম বোর্ড সভা অনুষ্ঠিত হয় গত ২৫ জুন। আমরা প্রস্তাব তুলেছিলাম, অন্যান্য প্রকল্পের ক্ষতিগ্রস্তসহ আরো কিছু ধরন যুক্ত করে ফ্ল্যাট বরাদ্দ নীতিমালা সংশোধনের। সভায় সিদ্ধান্ত হয়েছে বিষয়টি আরো পর্যালোচনা করা হবে। পর্যালোচনা করে বিষয়টি সেতু কর্তৃপক্ষের পরবর্তী পরিচালনা পর্ষদ সভায় উপস্থাপন করা হবে।’

ফ্ল্যাট বরাদ্দ নীতিমালা পরিবর্তন সম্পর্কে তিনি বলেন, ‘‌‌ফ্ল্যাটগুলোয় আরো ক্ষতিগ্রস্ত ব্যক্তিকে সুযোগ করে দিতে অন্যান্য প্রকল্পের ক্ষতিগ্রস্তদেরও বরাদ্দের উদ্যোগ নেয়া হচ্ছে। এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ে প্রকল্পের কারণে যে পরিমাণ মানুষ ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে, তার বাইরেও অন্যান্য প্রকল্পের ক্ষতিগ্রস্তদের ফ্ল্যাট বরাদ্দের সুযোগ থাকায় এ পরিবর্তন আনা হচ্ছে।’

সেতু কর্তৃপক্ষের কর্মকর্তারা বলছেন, ১ হাজার ৩৪৪টি ফ্ল্যাট বরাদ্দের জন্য সেতু কর্তৃপক্ষের কাছে এখন পর্যন্ত আবেদন জমা পড়েছে ২৬১টি। এমন প্রেক্ষাপটে অবশিষ্ট ফ্ল্যাটগুলো ‘‌খালি থাকা সাপেক্ষে’ সেতু বিভাগ ও বাংলাদেশ সেতু কর্তৃপক্ষের কর্মকর্তা-কর্মচারীসহ বিভিন্ন প্রকল্পের ক্ষতিগ্রস্ত ব্যক্তিদের বরাদ্দ দেয়ার উদ্যোগ নেয়া হয়েছে। 

এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ে প্রকল্পে বেসরকারি জমির পরিমাণ কম হওয়ার কারণে ক্ষতিগ্রস্ত ব্যক্তির সংখ্যা কম হয়েছে বলে মনে করেন বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের (বুয়েট) পুরকৌশল বিভাগের অধ্যাপক ড. সামছুল হক। এক সময় প্রকল্পটিতে পরামর্শক হিসেবেও কাজ করেছেন তিনি। এ প্রসঙ্গে জানতে চাইলে অধ্যাপক ড. সামছুল হকবণিক বার্তাকে বলেন, ‘এ প্রকল্পের জন্য বেসরকারি জমি খু্ব বেশি অধিগ্রহণের প্রয়োজন পড়েনি। এ কারণে ক্ষতিগ্রস্ত ব্যক্তির সংখ্যা কম হতে পারে। তবে ফ্ল্যাটগুলো নির্মাণের আগে ক্ষতিগ্রস্ত মানুষের সংখ্যা নিয়ে যথাযথভাবে সমীক্ষা করা প্রয়োজন ছিল।’

বাংলাদেশ সেতু কর্তৃপক্ষের তথ্য বলছে, ঢাকা এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ে প্রকল্পের জন্য সব মিলিয়ে ২০৫ দশমিক ৮৬ একর জমি অধিগ্রহণ করতে হয়েছে। এর মধ্যে সরকারি জমি ১৭৬ দশমিক ৮৪ একর। সিংহভাগ সরকারি জমির মালিক বাংলাদেশ রেলওয়ে। মাত্র ২৯ দশমিক শূন্য ২ একর জমি ব্যক্তি মালিকানাধীন।

ক্ষতিগ্রস্তদের জন্য নির্মিত ফ্ল্যাটগুলোকে সেতু কর্তৃপক্ষ ও সেতু বিভাগের কর্মকর্তা-কর্মচারীদের বরাদ্দ দেয়ার উদ্যোগটি প্রতিষ্ঠান দুটির জন্য ‘‌কনফ্লিক্ট অব ইন্টারেস্ট’ তৈরি করেছে বলে মন্তব্য করেছেন নাগরিক সংগঠন সুশাসনের জন্য নাগরিকের (সুজন) সম্পাদক বদিউল আলম মজুমদার। এ সম্পর্কে তিনি বণিক বার্তাকে বলেন, ‘সেতু বিভাগের অধীনে এ নীতিমালা হয়েছে। এখানে তাদের গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা আছে। আমি মনে করি, তারা তাদের স্বার্থেই নীতিমালা পরিবর্তন করতে যাচ্ছে। এটা কোনোভাবেই গ্রহণযোগ্য নয়। এসব ঘটনাও কিন্তু এক ধরনের দুর্নীতি। দুর্নীতি মানে শুধু লুটপাট বা চুরি করা নয়; এ ধরনের ঘটনাগুলোও দুর্নীতির মধ্যে পড়ে। এই যে নিয়ম-নীতি, পদ্ধতি—এগুলো অপব্যবহার করে, নিজেদের স্বার্থ সিদ্ধি করা এটাও দুর্নীতি। এ ধরনের ঘটনা শুধু অগ্রহণযোগ্যই নয়, যারা নীতিমালা পরিবর্তনের উদ্যোগের সঙ্গে জড়িত, আমি মনে করি তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়া দরকার।’

এই বিভাগের আরও খবর

আরও পড়ুন