মেঘনা-যমুনায় ভাঙনের তীব্রতা আতঙ্কে নদীপারের বাসিন্দারা

বণিক বার্তা প্রতিনিধি, মুন্সিগঞ্জ ও সিরাজগঞ্জ

সিরাজগঞ্জে যমুনা নদীর তীরবর্তী গ্রামে দেখা দিয়েছে ভাঙন ছবি : নিজস্ব আলোকচিত্রী

মুন্সিগঞ্জে মেঘনা ও সিরাজগঞ্জে যুমনা নদীর পানি বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে বেড়েছে ভাঙনের তীব্রতা। এরই মধ্যে নদীতে বিলীন হয়েছে তীরবর্তী বেশ কয়েকটি গ্রামের ঘরবাড়ি ও গাছপালাসহ বিভিন্ন স্থাপনা। ভাঙনে সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে গজারিয়া ইউনিয়নের নয়ানগর। ঝুঁকিতে রয়েছে সেখানকার ৩০০ বছরের পুরনো মসজিদসহ চার শতাধিক ঘরবাড়ি। এছাড়া ভাঙনের ঝুঁকিতে থাকা সিরাজগঞ্জ সদর উপজেলার বয়কয়রা কমিউনিটি ক্লিনিকটি নিলামে বিক্রি করা হয়েছে। হঠাৎ ভাঙন দেখা দেয়ায় আতঙ্কে রয়েছেন নদীপারের বাসিন্দারা। যদিও জিও ব্যাগ ফেলে ভাঙন ঠেকানোর চেষ্টা করছে পানি উন্নয়ন বোর্ড (পাউবো)।

নয়ানগর গ্রাম ঘুরে দেখা গেছে, নয়ানগর শাহী জামে মসজিদের নিচ থেকে মাটি সরে কলাম বেরিয়ে এসেছে। মাটি সরে যাওয়ায় মসজিদ রক্ষা বাঁধের ব্লকসহ দেয়াল ধসে পড়েছে। বর্ষার পানি বাড়ার সঙ্গে বাড়ছে ভাঙনের তীব্রতাও। এছাড়া কয়েকটি ঘরবাড়ির সুরক্ষা দেয়াল ভেঙে পড়েছে নদীতে। বেশ কয়েকটি ঘরের নিচের মাটি সরে যাওয়ায় হেলে পড়েছে।

নদীপারের বাসিন্দারা জানান, ৮-১০ বছর আগেও নয়ানগর মসজিদ থেকে ৪০০ মিটার পশ্চিমে ছিল মেঘনা নদী। মাঝখানে ঘরবাড়ি ও ফসলি জমি ছিল। কয়েক বছর ধরে মেঘনার নীরব ভাঙন চলছে। মসজিদ থেকে উত্তর দিকে নয়ানগর সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় পর্যন্ত প্রায় এক কিলোমিটার এলাকার ঘরবাড়ি ও ফসলি জমি নদীতে বিলীন হয়ে গেছে। গত বর্ষায় ভাঙতে ভাঙতে সেটি মসজিদের কাছাকাছি এসে ঠেকেছিল। ঘূর্ণিঝড় রেমালের প্রভাবে নদীর পানি বেড়ে যায়। সে সময় স্রোতের কারণে আকস্মিক ভাঙন শুরু হয় নদীতীরবর্তী গ্রামগুলোয়। এরই মধ্যে নদীপারের তারা মিয়া, জাহাঙ্গীর মাস্টার ও রফিকুল ইসলামদের ঘরবাড়ি বিলীন হয়ে গেছে। বাড়ির তলদেশের মাটি সরে পেয়ারা বেগম, আওয়াল গাজী, আজি লারীর ঘর ভেঙে পড়েছে নদীতে। ভেঙে গেছে সুরক্ষা দেয়ালও। ভাঙনের ঝুঁকিতে পড়েছে নয়ানগর শাহী জামে মসজিটিও। দুদিন নদীতে বেশি পানি ছিল, তাতেই এত ক্ষতি। যদি ভাঙন চলতে থাকে, তাহলে চার শতাধিক ঘরবাড়ি নদীতে বিলীন হতে পারে।

বংশপরম্পরায় নয়ানগরে বাস করেন তারা মিয়া প্রধান (৭৫)। পরিবার নিয়ে দুটি ছোট ভাঙা ঘরে থাকতেন তিনি। মানুষের সাহায্যে সহযোগিতায় কোনো রকমে চলে তাদের সংসার। ২৮ মে একটি ঘর নদীতে বিলীন হয়ে যায়।

তারা মিয়া প্রধান বলেন, ‘বাপ-দাদার জমি চোখের সামনে ভাঙতে ভাঙতে শেষ হয়েছে। বসতভিটা ছিল সম্বল। সেটাও ভাঙছে। এরই মধ্যে একটা ঘর ভেঙে গেছে। সরকার ব্যবস্থা না নিলে আরেকটা ঘরও ভেঙে যাবে। ঠিকমতো খাবার জোটে না, নতুন ঘর করা বা জায়গা কেনারই সামর্থ্য নেই আমার।’

তবে ভাঙনকবলিত এলাকাটি পরিদর্শন করা হয়েছে। পাশাপাশি ক্ষতিগ্রস্তদের তালিকা করা হয়েছে বলে জানান গজারিয়া উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা কোহিনূর আক্তার। বণিক বার্তাকে তিনি বলেন, ‘আমরা এরই মধ্যে ছয়জন ক্ষতিগ্রস্তের নাম পেয়েছি। তাদের ঢেউটিন ও খাদ্যসহায়তা দেয়া হবে। ওই এলাকার ভাঙন ঠেকাতে স্থায়ী একটি পরিকল্পনা নেয়া দরকার। বিষয়টি পানি উন্নয়ন বোর্ডকে জানানো হয়েছে। ভাঙনের বিষয়টি ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষকেও জানানো হয়েছে।’

তাৎক্ষণিক ভাঙন ঠেকাতে সেখানে জিওব্যাগ ফেলার উদ্যোগ নেয়া হচ্ছে বলে জানিয়েছেন মুন্সিগঞ্জ পানি উন্নয়ন বোর্ডের নির্বাহী প্রকৌশলী তৌহিদুল ইসলাম। তিনি বলেন, ‘স্থায়ী বাঁধ নির্মাণে কারিগরি কমিটি গঠন করা হয়েছে। তারা কাজ শুরু করেছে। কমিটির তথ্য-উপাত্তের ভিত্তিতে বরাদ্দ চেয়ে মন্ত্রণালয়ে চিঠি পাঠানো পাঠানো হবে। বরাদ্দ পেলে সেখানে কাজ শুরু করা হবে।’

অন্যদিকে সিরাজগঞ্জে যমুনা নদীতে দ্বিতীয় দফায় পানি বাড়া অব্যাহত রয়েছে। পাশাপাশি অভ্যন্তরীণ, ফুলজোড়, ইছামতি, হুড়াসাগর, করতোয়া ও বড়ালসহ বিভিন্ন নদ-নদীতে পানি বাড়ছে। সদর উপজেলা, শাহজাদপুর ও কাজিপুরে দেখা দিয়েছে নদীভাঙন। এরই মধ্যে বাড়িঘর ও শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানসহ বিভিন্ন স্থাপনা বিলীন হয়ে গেছে।

স্থানীয় সূত্রে জানা গেছে, যমুনার তীরবর্তী কাওয়াকোলা, শাহজাদপুরের ব্রাহ্মণগ্রাম ও সৈয়দপুর, কৈজুরী ইউনিয়নের হাটপাঁচিল ও কাজিপুরের খাসরাজবাড়িতে ভাঙন অব্যাহত রয়েছে। এছাড়া রতনকান্দি-বাহুকা ও কাজিপুরের শুভগাছায় ঝুঁকির মধ্যে পড়ছে নদীর তীর রক্ষা বাঁধ।

এ ব্যাপারে পাউবোর নির্বাহী প্রকৌশলী মাহবুবুর রহমান জানান, খাসরাজবাড়িতে যমুনার চরাঞ্চলে ভাঙনকবলিত এলাকা পরিদর্শন করা হয়েছে। যমুনায় দ্বিতীয় দফায় পানি বাড়ায় কিছু কিছু জায়গায় ভাঙন শুরু হয়েছে। ড্রেজার দিয়ে নৌ-চ্যানেল প্রশস্ত করার চেষ্টা করা হচ্ছে। নদীর গতিপথ পরিবর্তনে খনন কাজ চলছে। আপাতত জিও ব্যাগ ফেলে ভাঙন ঠেকানো হচ্ছে।’

নদীভাঙন তীব্র আকার ধারণ করায় ঝুঁকিতে রয়েছে সদর উপজেলার কাওয়াকোলা ইউনিয়নের বয়কয়রা কমিউনিটি ক্লিনিক। গত বুধবার এটি নিলামে বিক্রি করা হয়েছে।

সিরাজগঞ্জ সদর উপজেলা স্বাস্থ্য ও পরিবার পরিকল্পনা কর্মকর্তা মো. জাহিদুল ইসলাম হীরা জানান, ভাঙনের কারণে যেকোনো কমিউনিটি ক্লিনিকটি নদীতে বিলীন হয়ে যেতে পারে। এ কারণে কর্মকর্তাদের সমন্বয়ে নিলাম বিক্রির জন্য কমিটি গঠন করা হয়। বুধবার প্রকাশ্যে নিলাম অনুষ্ঠিত হয়। ২৯ হাজার টাকায় ক্লিনিকের অবকাঠামো বিক্রি করা হয়েছে।

এই বিভাগের আরও খবর

আরও পড়ুন