বাংলাদেশ ব্যাংকের রফতানি আয়ের হিসাব সংশোধন

নতুন হিসাবে রফতানি আয় কমেছে প্রায় ৩০%, বিওপির অনেক হিসাব-নিকাশ পাল্টে গেছে

রপ্তানি উন্নয়ন ব্যুরো চুপচাপ

নিজস্ব প্রতিবেদক

ছবি : বণিক বার্তা

রফতানি হওয়া পণ্যের মূল্য দেশে আসছিল না। এ রফতানির তথ্য নিয়েও রয়েছে অতিরঞ্জনের অভিযোগ। এ দুইয়ের প্রভাবে দেশের প্রকৃত রফতানি আয়ের তথ্য নিয়ে তৈরি হয়েছিল বিভ্রান্তি। বিষয়টি নিয়ে নিয়ন্ত্রক সংস্থাগুলোর বক্তব্যও ছিল পরস্পরবিরোধী। এমন অবস্থায় বাংলাদেশ রপ্তানি উন্নয়ন ব্যুরোর (ইপিবি) রফতানির তথ্য থেকে এক ধাক্কায় ১৩ দশমিক ৮০ বিলিয়ন বা ১ হাজার ৩৮০ কোটি ডলার বাদ দিয়েছে বাংলাদেশ ব্যাংক। দেশের ব্যালান্স অব পেমেন্টের (বিওপি) হিসাবায়ন করতে গিয়ে এ সংশোধন আনা হয়েছে। 

২০২৩-২৪ অর্থবছরের প্রথম ১০ মাসের (জুলাই-এপ্রিল) বিওপির পরিসংখ্যান গতকালই প্রকাশ করেছে কেন্দ্রীয় ব্যাংক। এতে গত অর্থবছরের এপ্রিল পর্যন্ত রফতানি দেখানো হয়েছে ৩৩ দশমিক ৬৭ বিলিয়ন ডলার। যদিও একই সময়ে ইপিবি রফতানি দেখিয়েছে ৪৭ দশমিক ৪৭ বিলিয়ন ডলার। অর্থাৎ ইপিবির তথ্য সংশোধন করে সেখান থেকে ১৩ দশমিক ৮০ বিলিয়ন ডলার বা ৩০ শতাংশের কাছাকাছি বাদ দিয়েছে বাংলাদেশ ব্যাংক।

এ বিষয়ে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের একাধিক কর্মকর্তা জানিয়েছেন, ইপিবি থেকে এতদিন রফতানির ভুল তথ্য দেয়া হয়েছে। একই পণ্য রফতানির তথ্য দেখানো হয়েছে একাধিকবার। এতে প্রকৃত তথ্যের সঙ্গে প্রকাশিত তথ্যের বড় ধরনের ব্যবধান তৈরি হয়ে যায়। এখন ইপিবিও তাদের রফতানির তথ্য সংশোধন করেছে।

তবে এ বিষয়ে ইপিবি বা বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের দায়িত্বশীল কারো আনুষ্ঠানিক বক্তব্য পাওয়া যায়নি। ইপিবির ভাইস চেয়ারম্যানের সঙ্গে একাধিকবার যোগাযোগের প্রয়াস চালিয়েও তার বক্তব্য পাওয়া সম্ভব হয়নি। 

বিওপির অনেক খাতেই রফতানি থেকে প্রায় ১৪ বিলিয়ন ডলার বাদ পড়ে যাওয়ার প্রভাব পড়েছে। মার্চ পর্যন্ত বিওপিতে দেশের বাণিজ্য ঘাটতি দেখানো হয়েছিল মাত্র ৪ দশমিক ৭৪ বিলিয়ন ডলার। কিন্তু এপ্রিলে এসে এ ঘাটতি ১৮ দশমিক ৬৯ বিলিয়ন দেখানো হয়েছে। এক ধাক্কায় বাণিজ্য ঘাটতি প্রায় চার গুণ বেড়ে যাওয়ার প্রভাবে উদ্বৃত্ত থেকে ঘাটতিতে রূপ নিয়েছে চলতি হিসাবের ভারসাম্য। মার্চ পর্যন্ত চলতি হিসাবে প্রায় ৫ দশমিক ৮০ বিলিয়ন ডলার উদ্বৃত্ত দেখানো হলেও এপ্রিলে এসে সেটি প্রায় ৫ দশমিক ৭৩ বিলিয়ন ডলারের ঘাটতিতে রূপ নিয়েছে।

তবে বিপরীত পরিস্থিতি দেখা যাচ্ছে দেশের ফাইন্যান্সিয়াল অ্যাকাউন্ট বা আর্থিক হিসাবের ক্ষেত্রে। গত দুই অর্থবছরেই আর্থিক হিসাবের বড় ঘাটতি নিয়ে উদ্বেগে ছিল বাংলাদেশ ব্যাংক। মার্চ পর্যন্ত অর্থবছরের নয় মাসে দেশের ফাইন্যান্সিয়াল অ্যাকাউন্টে ঘাটতি দেখানো হয়েছিল প্রায় ৯ দশমিক ২৬ বিলিয়ন ডলার। কিন্তু এপ্রিলে এসে আর্থিক হিসাবে ২ দশমিক ২৩ বিলিয়ন ডলার উদ্বৃত্ত দেখানো হয়েছে। আর এপ্রিল শেষে বিওপির মোট ঘাটতি দেখানো হয়েছে ৫ দশমিক ৫৬ বিলিয়ন ডলার।

এ বিষয়ে জানতে চাইলে বাংলাদেশ ব্যাংকের মুখপাত্র মো. মেজবাউল হক বণিক বার্তাকে বলেন, ‘রফতানির তথ্য আমরা ইপিবি থেকে পাই। সংস্থাটি এতদিন যে তথ্য বাংলাদেশ ব্যাংককে দিয়েছে, সেটির ভিত্তিতেই বিওপির হিসাবায়ন করা হয়েছে। ইপিবি এখন রফতানির সংশোধিত তথ্য দিয়েছে। এক্ষেত্রে কী ঘটেছে, সেটির ব্যাখ্যা ইপিবি দিতে পারবে। এক্ষেত্রে বাংলাদেশ ব্যাংকের কোনো দায় নেই।’

প্রতি মাসে দেশ থেকে পণ্য রফতানির তথ্য প্রকাশ করে ইপিবি। সংস্থাটির তথ্য বলছে, ২০২০-২১ অর্থবছরে দেশ থেকে ৩৮ দশমিক ৭৬ বিলিয়ন ডলারের পণ্য রফতানি হয়েছে। এক্ষেত্রে অর্থবছরটিতে রফতানি প্রবৃদ্ধি হয়েছে ১৫ দশমিক ১০ শতাংশ। ২০২১-২২ অর্থবছরে প্রথমবারের মতো দেশের রফতানি আয় ৫০ বিলিয়ন ডলারের মাইলফলক অতিক্রম করেছে বলে ইপিবির পক্ষ থেকে ব্যাপক প্রচার-প্রচারণাও চালানো হয়। অর্থবছরটিতে রফতানি দেখানো হয় ৫২ দশমিক শূন্য ৮ বিলিয়ন ডলার। রফতানিতে প্রবৃদ্ধি দেখানো হয় প্রায় ৩৪ দশমিক ৩৮ শতাংশ। এ ধারাবাহিকতায় ২০২২-২৩ অর্থবছরে রফতানি দেখানো হয় ৫৫ দশমিক ৫৬ বিলিয়ন ডলার। এক্ষেত্রে প্রায় ৬ দশমিক ৬৭ শতাংশ প্রবৃদ্ধি দেখানো হয়। 

ইপিবির তথ্য অনুযায়ী, সদ্য শেষ হওয়া ২০২৩-২৪ অর্থবছরের প্রথম ১১ মাসে (মে পর্যন্ত) ৫১ দশমিক ৫৪ বিলিয়ন ডলারের পণ্য রফতানি হয়েছে। আগের অর্থবছরের একই সময়ের তুলনায় রফতানি প্রবৃদ্ধি দেখানো হয়েছে ২ শতাংশের বেশি। 

যদিও ইপিবির দেয়া রফতানির তথ্যের সঙ্গে দেশে রফতানি মূল্যে হিসাবে আসা অর্থের হিসাব মিলছে না। এ পরিপ্রেক্ষিতে দেশের প্রকৃত রফতানি আয় কত—সেটি নিয়ে বিভিন্ন পক্ষ থেকে প্রশ্ন উঠছে। ইপিবি, জাতীয় রাজস্ব বোর্ড (এনবিআর) ও বাংলাদেশ ব্যাংকের মতো সংস্থাগুলো থেকেও পাওয়া যায় ভিন্ন তথ্য। আন্তর্জাতিক বিভিন্ন সংস্থা ও অর্থনীতিবিদরা সন্দেহ করছিলেন, অপ্রত্যাবাসিত হিসাবে থেকে যাওয়া বিপুল পরিমাণের রফতানি আয় পাচার হয়ে যাওয়া এ গরমিলের পেছনে বড় ভূমিকা রাখছে। 

বাংলাদেশ ব্যাংক, অর্থ মন্ত্রণালয় ও বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের দায়িত্বশীল একাধিক কর্মকর্তা জানান, এতদিন রফতানির তথ্য ফুলিয়ে-ফাঁপিয়ে প্রকাশ করা হয়েছে। এক্ষেত্রে একই পণ্য রফতানির তথ্য একাধিকবার অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে। এতে দেশে আসা রফতানি আয়ের (প্রত্যাবাসিত) সঙ্গে ইপিবির তথ্যের বিরাট তারতম্য তৈরি হয়। এ পরিপ্রেক্ষিতে সরকারের সংশ্লিষ্ট সব পক্ষকে নিয়ে একটি কমিটি গঠন করা হয়েছিল। সে কমিটির প্রতিবেদনের ভিত্তিতে ইপিবি রফতানির তথ্য সংশোধন করেছে। এপ্রিলের বিওপিতে বাংলাদেশ ব্যাংক রফতানি আয়ের যে তথ্য দিয়েছে, সেটিই প্রকৃত তথ্য।

এক মাসের ব্যবধানে বিওপির সব তথ্য ওলট-পালট হয়ে যাওয়ার বিষয়ে বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক গভর্নর ড. সালেহউদ্দিন আহমেদ বলেন, ‘আমরা প্রকৃত অর্থে জানি না রফতানির ক্ষেত্রে আসলেই কী ঘটেছে। এতদিন রফতানির যে তথ্য দেয়া হয়েছে, সেটি যদি ভুল হয়, তাহলে ভুলের সঙ্গে জড়িতদের অবশ্যই জবাবদিহিতার আওতায় আনা দরকার। এ ভুল ইপিবি করেছে, না অন্য কেউ সেটিও প্রকাশ করতে হবে।’

তিনি আরো বলেন, ‘রফতানির বিপরীতে জনগণের অর্থে সরকার নগদ সহায়তা দেয়। রফতানির পরিমাণ বেশি দেখিয়ে নগদ সহায়তা তছরুপ হয়েছে কিনা, সেটিও খতিয়ে দেখতে হবে। আবার রফতানি হওয়ার পরও ভুলের অজুহাতে অর্থ পাচারের তথ্য মুছে ফেলার সম্ভাবনাও আছে। প্রকৃত সত্য কী, সেটি তদন্ত করে স্বচ্ছতা নিশ্চিত করা দরকার। ভবিষ্যতে যাতে একই ভুল বা অপরাধের পুনরাবৃত্তি না হয়, সেটিও নিশ্চিত করতে হবে।’

এ বিষয়ে জানতে চাইলে এফবিসিসিআইয়ের সাবেক সহসভাপতি ও আওয়ামী লীগের শিল্প ও বাণিজ্য সম্পাদক সিদ্দিকুর রহমান বণিক বার্তাকে বলেন, ‘দেশের কোনো ইপিজেড থেকে কাপড় কিনলে সেটিকেও ইপিবি রফতানি হিসাবে দেখায়। সে কাপড় দিয়ে পোশাক প্রস্তুত করে বিদেশে রফতানি করলে সেটি দ্বিতীয় দফায় রফতানির খাতায় যুক্ত হয়। এ কারণে ইপিবি, এনবিআর ও বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্যের মধ্যে বড় ধরনের অসামঞ্জস্য তৈরি হয়। ইপিবি দেশের রফতানির যে তথ্য এতদিন দেখিয়ে আসছিল, সেটি প্রকৃত রফতানি নয়। ইপিবির তথ্যের ভিত্তিতে রফতানির আড়ালে ব্যবসায়ীরা টাকা পাচার করছেন বলে বিভিন্ন পক্ষ দোষারোপ করে আসছিল। বিকেএমইএ ও বিজিএমইএর কাছে রফতানির প্রকৃত তথ্য আছে।’

এই বিভাগের আরও খবর

আরও পড়ুন