‘‌প্রযুক্তিনির্ভর উজ্জ্বল ব্র্যান্ড হিসেবে দেশের ব্যাংক খাতে জায়গা করে নিয়েছে ঢাকা ব্যাংক’

আব্দুল হাই সরকার ছবি: ঢাকা ব্যাংক

২৯ পূর্ণ করে ৩০ বছরে পদার্পণ করল ঢাকা ব্যাংক পিএলসি। ব্যাংকটির চেয়ারম্যানের দায়িত্ব পালন করছেন আব্দুল হাই সরকার, যার হাত ধরে প্রতিষ্ঠা পেয়েছে দেশের অন্যতম কনগ্লোমারেট পূর্বাণী গ্রুপ। ঢাকা ব্যাংকের প্রতিষ্ঠাবার্ষিকী উপলক্ষে তিনি কথা বলেছেন বণিক বার্তার সঙ্গে। সাক্ষাৎকার নিয়েছেন হাছান আদনান

৩০ বছরে পদার্পণ করল ঢাকা ব্যাংক। দীর্ঘ এ যাত্রার শুরুটা কেমন ছিল?

স্বাধীনতা-পরবর্তী সময়ে আমি ব্যবসা শুরু করি। তখন দেশে ব্যাংক বলতে কেবল সরকারি ব্যাংককেই বুঝতাম। আর ব্যাংকারদের নাগাল পাওয়া ছিল বেশ কঠিন কাজ। ওই সময় রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংকগুলোয় টাকা তোলা কিংবা এলসি খোলার জন্য ঘণ্টার পর ঘণ্টা বসে থাকতে হতো। আশির দশকে সরকার বেসরকারি ব্যাংকের লাইসেন্স দেয়ার উদ্যোগ নেয়। তখন অন্য অনেকের মতো আমরাও আবেদন করেছিলাম। আমাদের আবেদনটি ছিল ‘ঢাকা ব্যাংক’ নামেই। কিন্তু সে সময় আমরা ব্যাংকের লাইসেন্স পাইনি। পরে ১৯৯৫ সালে সরকার ঢাকা ব্যাংকের লাইসেন্স দেয়। ওই বছরের ৫ জুলাই আমরা কার্যক্রম শুরু করি। সে হিসাবে ঢাকা ব্যাংকের বয়স ২৯ বছর পূর্ণ হলো। শুরু থেকেই সম্প্রসারণের ক্ষেত্রে আমরা রক্ষণশীল ছিলাম। আমাদের প্রতিটি পদক্ষেপ ছিল সতর্কতাপূর্ণ। চেয়েছিলাম একটি আধুনিক ব্যাংক প্রতিষ্ঠা করতে। সে প্রচেষ্টায় আমরা সফল হয়েছি। ৩০তম বর্ষে এসে আমরা বলতে পারছি, ঢাকা ব্যাংক প্রযুক্তিনির্ভর উজ্জ্বল ব্র্যান্ড হিসেবে দেশের ব্যাংক খাতে জায়গা করে নিতে পেরেছে।

ঢাকা ব্যাংককে আমরা কতটা টেকসই বলতে পারি?

যেকোনো ব্যবসা বা প্রতিষ্ঠানের ভালো ও মন্দ সময় থাকে। ঢাকা ব্যাংকের ক্ষেত্রেও এটি প্রযোজ্য। তবে আমরা সব সময় আইন ও রীতিনীতির মধ্যে থেকে কার্যক্রম পরিচালনা করতে চেয়েছি। এক্ষেত্রে আমরা সফলও হয়েছি। খারাপ সময়ে আমরা সরকার ও বাংলাদেশ ব্যাংকের সহযোগিতা পেয়েছি। করপোরেট সুশাসন মেনে ঢাকা ব্যাংক পরিচালিত হয়েছে। এ কারণে সব ধরনের প্রতিবন্ধকতা কাটিয়ে ঢাকা ব্যাংক সামনে এগিয়ে যেতে পেরেছে। 

ঢাকা ব্যাংকের আর্থিক সূচকগুলো বেশ স্থিতিশীল। টেকসই ব্যাংক হিসেবেও বাজারে আমাদের সুনাম আছে। যেকোনো ব্যাংকের সবচেয়ে বড় সম্পদ তার গ্রাহক। গ্রাহকদের আস্থার ফলেই আমরা আজকের অবস্থানে আসতে পেরেছি।

প্রায় তিন দশকের পথচলায় বড় অর্জন কোনটি বলে মনে করেন?

দেশের তৈরি পোশাক খাতসহ সব ধরনের শিল্প গড়ে ওঠার ক্ষেত্রে ঢাকা ব্যাংকের বড় অবদান আছে। রিয়েল এস্টেট, সিএসএমই, কৃষিসহ অন্য খাতগুলোর সম্প্রসারণেও আমরা ভূমিকা রেখেছি। বিশেষ করে বিদ্যুৎ উৎপাদনে ঢাকা ব্যাংকের অংশগ্রহণ একেবারেই সামনের সারিতে। দেশের অনেক বৃহৎ শিল্প গ্রুপ বা প্রতিষ্ঠানের শুরুটা ছিল এ ব্যাংকের অর্থায়নে। উদাহরণ হিসেবে আমরা সামিট গ্রুপের কথা স্মরণ করতে পারি। 

শিল্পায়নে ভূমিকা রাখার পাশাপাশি ঢাকা ব্যাংক দেশে খেলাধুলা ও সংস্কৃতির বিকাশে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখেছে। আমাদের ব্যাংকের হাত ধরেই দেশের নারী ফুটবল দল সাফল্যের শীর্ষে পৌঁছতে পেরেছে। শুধু ২০২৩ সালে আমরা সিএসআর (করপোরেট সামাজিক দায়বদ্ধতা) খাতে প্রায় ১৬ কোটি টাকা ব্যয় করেছি। ঢাকা ব্যাংক ফাউন্ডেশনের উদ্যোগে একটি আধুনিক হাসপাতাল নির্মাণের উদ্যোগ রয়েছে। 

ঢাকা ব্যাংক করপোরেট ব্যাংক হিসেবে বেশি স্বীকৃতি পেয়েছে। আগামীর পথচলার ধরন কী হবে?

কয়েক বছর ধরেই ঢাকা ব্যাংক সিএসএমই, রিটেইল ও কৃষি খাতে ঋণ বিতরণে গুরুত্ব বাড়িয়েছে। আগামীতে এ ধারা আরো বেশি ত্বরান্বিত হবে। এ মুহূর্তে ক্ষুদ্র ঋণ বিতরণে আমরা বেশি জোর দিচ্ছি। আমাদের মনে রাখতে হবে, গ্রাহকদের আমরা যে ঋণ দিই, সেটি জনগণের টাকা। একজন গ্রাহককে শতকোটি টাকা ঋণ না দিয়ে যদি তা ১০ জন গ্রাহককে দেয়া হয়, তাহলে সেটি বেশি নিরাপদ। 

২৯ বছরে ঢাকা ব্যাংক কতটুকু সম্প্রসারিত হয়েছে?

ঢাকা ব্যাংকের যাত্রা হয়েছিল ১০ কোটি টাকা পরিশোধিত মূলধন দিয়ে। গত ২৯ বছরে এ মূলধন বেড়ে ১ হাজার ৬ কোটি টাকায় উন্নীত হয়েছে। চলতি বছরের মার্চ পর্যন্ত আমাদের কাছে গ্রাহকদের ২৭ হাজার ১৫২ কোটি টাকার আমানত সুরক্ষিত ছিল। বিতরণকৃত ঋণের স্থিতি ২৫ হাজার ৫৯৭ কোটি টাকা। সব মিলিয়ে ঢাকা ব্যাংক এখন ৩৮ হাজার ৬৭৬ কোটি টাকা সম্পদের একটি প্রতিষ্ঠান। ইসলামী ব্যাংকিং শাখাসহ এখন পর্যন্ত ঢাকা ব্যাংকের শাখার সংখ্যা ১১৪। এসব শাখার পাশাপাশি ২৯টি উপশাখা, তিনটি এসএমই সর্ভিস সেন্টার, ৮৮টি এটিএম বুথ, ১১টি এডিএম ও দুটি অফশোর ইউনিট নিয়ে ঢাকা ব্যাংক কার্যক্রম পরিচালনা করছে। সর্বাধুনিক প্রযুক্তির দিক থেকে আমরা অত্যন্ত সমৃদ্ধ একটি ব্যাংক। এ কারণে গ্রাহক ব্যাংকে না এসে ঘরে বসেই ঢাকা ব্যাংকের সব সেবা উপভোগ করতে পারছেন। প্রযুক্তির সর্বোচ্চ ব্যবহার নিশ্চিত করে আমরা দেশের প্রান্তিক জনগোষ্ঠীর কাছে সেবা পৌঁছে দেয়ার লক্ষ্য নিয়ে কাজ করছি।

দেশের ব্যাংক খাতে খেলাপি ঋণ ক্রমান্বয়ে বাড়ছে। অনেক ব্যবসায়ী বলেন, তারা পরিস্থিতির শিকার। একজন ব্যবসায়ী হিসেবে আপনিও কি তাই মনে করেন?

দেশের ব্যাংক খাতে খেলাপি ঋণের ৮০ শতাংশই ইচ্ছাকৃত। বাকি ২০ শতাংশ পরিস্থিতির শিকার। ব্যাংক থেকে ঋণ নিয়ে ভিন্ন খাতে ব্যয় করার (ফান্ড ডাইভার্ট) কারণে খেলাপি ঋণ বাড়ছে। আমাদের অনেক ঋণখেলাপি আছেন, যাদের গুলশান এভিনিউতে পাঁচ-সাতটি বাড়ি আছে। কিন্তু তাদের কাছ থেকে আমরা টাকা আদায় করতে পারছি না। ঋণ পরিশোধের জন্য বিভিন্নভাবে চাপ তৈরি করলে খেলাপিরা আদালতে গিয়ে রিট করে দিচ্ছেন। আদালত কোনো বাছবিচার ছাড়াই স্টে অর্ডার দিয়ে দিচ্ছেন। এ কারণে খেলাপিরা ঋণ পরিশোধ না করেও ঘুরে বেড়াতে পারছেন। আমি মনে করি, স্টে অর্ডারের বিষয়ে কোনো সামাধানে আসতে পারলে ৮০ শতাংশ খেলাপি ঋণ আদায় করা সম্ভব।

রিটের বিষয়ে আপনার পরামর্শ কী?

অনেক ঋণখেলাপি ব্যাংকের টাকা মেরে সপরিবারে বিদেশে চলে গেছেন। পরিবার-পরিজন নিয়ে তারা ইউরোপ-আমেরিকায় ঘুরে বেড়াচ্ছেন। জামানতের সম্পদ বিক্রি কিংবা অন্য কোনো পদক্ষেপ নিতে গেলেই তাদের নিযুক্ত আইনজীবী কোর্টে রিট করে দিচ্ছেন। এটি তো হতে পারে না। রিট করতে হলে ঋণখেলাপিকে অবশ্যই আদালতে উপস্থিত থাকতে হবে—এমন আইন করা দরকার। তাহলে ঋণখেলাপিরা দেশে ফিরতে বাধ্য হবেন।

ব্যাংক কোম্পানি আইন সংশোধন করে ‘ইচ্ছাকৃত’ ঋণখেলাপিদের বিষয়ে কঠোর ধারা যুক্ত করা হয়েছে। বাংলাদেশ ব্যাংক এ ধরনের ঋণখেলাপিকে চিহ্নিত করতে ব্যাংকগুলোকে দায়িত্ব দিয়েছে। আপনাদের পক্ষে ‘ইচ্ছাকৃত’ ঋণখেলাপিদের তালিকা করা সম্ভব কি?

‘ইচ্ছাকৃত’ ঋণখেলাপিদের তালিকা তারাই করতে পারে। দেশের সব ব্যাংকের ঋণখেলাপির তালিকা বাংলাদেশ ব্যাংকের কাছে আছে। এখন তারা যদি সহযোগিতা চায়, তাহলে অবশ্যই আমরা করব। কে ইচ্ছাকৃত আর কে অনিচ্ছাকৃত সেটি আমাদের পক্ষে বলা দুরূহ হবে।

এই বিভাগের আরও খবর

আরও পড়ুন