ব্যবসায়িক পথচলায় অনেক ভুল করেছি বলে নতুন কিছু করার সাহস পাই

ছবি : বণিক বার্তা

৭৫ বছরেরও বেশি সময় ধরে ব্যবসা করছে দেশের অন্যতম শীর্ষস্থানীয় কনগ্লোমারেট আকিজ গ্রুপ। সেখ আকিজ উদ্দিনের হাতে গড়ে ওঠা এ প্রতিষ্ঠানের অন্যতম কর্ণধার আকিজ রিসোর্সের ম্যানেজিং ডিরেক্টর ও গ্রুপ সিইও শেখ জসিম উদ্দিন। নিজের শৈশব, ব্যবসায়িক পথচলা, শিল্প ও তরুণ উদ্যোক্তাদের নিয়ে সম্প্রতি বণিক বার্তার সঙ্গে কথা বলেছেন তিনি

আকিজ গ্রুপের বিশাল কর্মযজ্ঞের সঙ্গে আপনার সংশ্লিষ্টতা জানতে চাই।

বিল গেটসের একটা কথা আছে—গার্বেজ ইন, গার্বেজ আউট। বাবা একটা ভালো ব্যবস্থা তৈরি করে দিয়েছিলেন বলে ভালো জিনিস প্রবেশ করছে, ভালো জিনিস বের হচ্ছে। বাবা মারা যাওয়ার পর ব্যবসাটা আমি শুধু ডিজিটালাইজেশন করেছি, এর বেশি কিছু নয়। এক্ষেত্রে আকিজ গ্রুপের ব্যবস্থাপনা পরিচালক শেখ বশির উদ্দিনকেও কৃতিত্ব দিতে হয়। বাবার লিগ্যাসিটা তিনিই বয়ে নিয়েছিলেন। আমি প্রতিষ্ঠানকে আরো ভালো, গতিশীল ও সহজলভ্য করার চেষ্টা করেছি। সেজন্যই ডিজিটাল ট্রান্সফরমেশন আনা।

শুরুটা কেমন ছিল?

আমি ২০০৮ সালে কোম্পানিতে যোগ দিই। সে সময় কয়েকজনকে নিয়ে একটি এমআইএস (তথ্য ব্যবস্থাপনা পদ্ধতি) দল গঠন করে ওয়েবভিত্তিক ইআরপি শুরু করি। এখন আমাদের ইআরপির চতুর্থ সংস্করণ রয়েছে। শুরুতে ওয়েবভিত্তিক ছিল, এরপর মোবাইলে এসেছে। এখন আমরা কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার দিকে স্থানান্তর হচ্ছি। ডিজিটালাইজেশন শুরু করি আকিজ পার্টিকেল বোর্ড দিয়ে। সেখানে ফ্যাক্টরি অটোমেশন দিয়ে শুরু করে ম্যানেজমেন্ট অটোমেশনের দিকে আসা হয়েছে।

আকিজ রিসোর্সের পোর্টফোলিও সম্পর্কে জানতে চাই।

আইটি, শিপিং লজিস্টিকস, সিমেন্ট ও রড উৎপাদনের পাশাপাশি খাদ্যপণ্যের মধে ডাল, চাল, আটা রয়েছে। আরো রয়েছে ব্যাগ, রেডি-মিক্স, পাথর, বিটুমিন, অ্যাসফল্ট, লুব অয়েল। আগামীতে ফিডেও আসব আমরা।

আকিজ পরিবারের উত্তরসূরিরা সম্প্রতি স্বতন্ত্রভাবে ব্যবসার দিকে গেছেন। কেমন ছিল সে যাত্রা?

যাত্রাটা দারুণ ছিল। বাবা কোম্পানিকে এত সুন্দর করে কাঠামো দিয়ে গেছেন যে তিনি মারা যাওয়ার পর আমরা কোনো ভাই এটা অনুভবই করিনি যে তিনি আর নেই। আমরা যখন আলাদা হয়েছি, তখনো কোনো বিশৃঙ্খলা তৈরি হয়নি। কারণ কোম্পানিটা আগে থেকেই অবকাঠামোগতভাবে শক্ত ছিল এবং আমরা প্রত্যেকেই দারুণ করছি।

আকিজ রিসোর্সের কর্মসংস্থান ও পরিধি সম্পর্কে জানতে চাই।

ব্যবস্থাপনায় এক হাজারসহ মোট সাত হাজার মানুষ বর্তমানে কাজ করছেন এবং বার্ষিক টার্নওভার প্রায় ১০ হাজার কোটি টাকা। 

দেশ এখন স্মার্ট বাংলাদেশের দিকে যাচ্ছে। আপনারা এর সঙ্গে আগে থেকেই খাপ খাইয়ে নিয়েছেন। এর সঙ্গে জাতীয় চিন্তার কোনো সম্পৃক্ততা আছে কিনা?

আকিজ সবসময় উদ্ভাবনকেন্দ্রিক। আমার বাবা ১৯৮০ সালে জাপানে গিয়েছিলেন নতুন নতুন উদ্ভাবন দেখতে। বাংলাদেশের লোকজন এখন ইউরোপ থেকে যন্ত্রপাতি আনার চিন্তা করছে, যেটা আমরা আশির দশকে করেছিলাম। আমরা সবসময় প্রযুক্তির সঙ্গে যুগোপযোগী থেকেছি। ক্রেতাদের সর্বোচ্চ সুবিধা দেয়ার জন্যই আমাদের এসব প্রযুক্তি নিয়ে আসা।

আকিজ গ্রুপে কীভাবে ডিজিটাল প্রযুক্তি বাস্তবায়ন করেছেন?

বাংলাদেশে আগে টাইপরাইটার ছিল, এখন সবাই কম্পিউটারে কম্পোজ করে। কিন্তু অভ্যাসের কারণে আমরা ওই কম্পোজ পেপার প্রিন্ট করে তাতে স্বাক্ষর করি। অথচ চাইলেই আমরা ই-মেইলে অনুমোদন নিয়ে নিতে পারি। কভিড মহামারী আমাদের সবকিছু শিখিয়ে দিয়ে গেছে। বাসায় আমরা সবাই প্রযুক্তিকেন্দ্রিক থাকি, কিন্তু অফিসে প্রযুক্তিবিমুখ। এটা শুধু অভ্যাসের কারণেই। আমরা পেপারকে অটোমেটেড করেছি। এরপর একে ক্লাউডে নিয়ে গেছি। ক্লাউডে নেয়ার পর সবাই প্রবেশাধিকার পাচ্ছে। এরপর আমরা একে মোবাইলে নিয়ে এসেছি। এখন আমরা মোবাইল থেকে আরো কীভাবে সহজ করা যায়, তা ভাবছি। মুশকিলটা হলো আমরা বিষয়গুলোকে সহজভাবে ভাবি না।

ডিজিটালাইজেশন করতে গিয়ে আপনার অফিসের ডেস্ক কমিয়ে জনসম্পদের নতুন ব্যবহার বাস্তবায়ন করেছেন কীভাবে?

আমি আর্মি থেকে কৌশল, সরকার থেকে সিস্টেম আর স্কুল থেকে শৃঙ্খলা শেখার চেষ্টা করি। আজ থেকে কয়েক বছর আগে টেবিল ওয়ার্ক ছিল। এখন টেবিলের কাজ কম্পিউটারে হয়ে যাচ্ছে। তাহলে টেবিল কেন দরকার হবে? এখন আমাদের কোনো কিছুর অনুমোদনও নিতে হয় না। আমরা বাজেটে চলে গেছি। আগে থেকেই বাজেট হয়ে গেলে পরিকল্পনা নিয়ন্ত্রণ ও বাস্তবায়ন সহজ হয়ে যায়। তাহলে এখন আমার কর্মীরা কী করবেন? তাদের আমরা বিপি (ব্যবসায়িক অংশীদার) করেছি। তারাও এখন ব্যবসা বাড়ানোর চেষ্টা করছেন। প্রযুক্তির অভিযোজন করতে গিয়ে তো আমি আমার কর্মীদের বাদ দিতে পারি না।

এক্ষেত্রে এক পেশার কর্মী আরেক পেশায় কীভাবে খাপ খাওয়াচ্ছেন? 

আমরা তার দক্ষতা বাড়াতে কাজ করছি। তার ঝুলিতে নতুন নতুন দক্ষতা যোগ হচ্ছে। পারফরম্যান্সভিত্তিক বেতন দেয়ার মতো নতুন নতুন বিষয় নিয়ে আসছি। আমরা তিন-চার মাস ধরে এ অনুশীলনের মধ্য দিয়ে যাচ্ছি।

বাংলাদেশে নতুন নতুন ধারণার ক্ষেত্রে আমাদের একটা মানসিক বাধা থাকে। এর পরও আপনি আপনার কোম্পানিকে প্রযুক্তিনির্ভর করেছেন। এক্ষেত্রে অন্য কোম্পানি যদি আপনার ধারণা বাস্তবায়ন করতে চায়, কী ধরনের চ্যালেঞ্জ মোকাবেলা করতে হতে পারে?

আমরা নতুন কিছু দেখলে ভয় পাই, নতুন কিছু চেষ্টা করি না। জীবনে কোনো ঝুঁকি না নেয়াটাই সবচেয়ে বড় ঝুঁকি। ঝুঁকি নিলেই আমি জানতে পারব কী কী সমস্যা ছিল, না নিলে তো জানতে পারব না। পুরোটাই মনস্তাত্ত্বিক খেলা। ভয়কে জয় করাই তো আমাদের কাজ। কর্মীরা ভয় পাবেন, এটা স্বাভাবিক। কিন্তু উদ্যোক্তাদের কাজ তো পথ দেখানো, ভয় পাওয়া নয়। নেতৃত্বের গুণাবলিই হলো সবাই যখন ভয় পেয়ে পালিয়ে যেতে থাকবে, আমি তখন আলো নিয়ে দাঁড়িয়ে থাকব। নেতৃত্ব হলো স্বপ্নদর্শী; স্বপ্ন কখনো পরিষ্কার থাকে না। একে পরিষ্কার করে নিতে হয়।

এ ডিজিটালাইজেশনের কারণে আপনার কখনো কর্মী ছাঁটাই করতে হয়েছে কিনা?

করতে হয়নি। কর্মী ছাঁটাই কখন করতে হয়, যখন কোম্পানি ব্যর্থ হয়। আমি আমার কর্মীদের জাপানের উদাহরণ দিয়ে বলেছি, আমরা যত ডিজিটাল হব তত আমাদের পরিধি বাড়বে। আর পরিধি যত বাড়বে ততই তো আমার লোকবল দরকার হবে। আমার কর্মীরা যারা আমাকে ডিজিটাল করে দিলেন, তারা তো আমার সম্পদ। তাদের বাদ দিলে তো আমার ভুল হবে। আমরা সবসময় কর্মীবান্ধব। আমরা কর্মীদের দক্ষতা বাড়ানোয় বিশ্বাস করি, প্রবৃদ্ধিতে বিশ্বাস করি।

রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ, ডলার সংকট, মুদ্রাস্ফীতিসহ বৈশ্বিক বিভিন্ন প্রতিবন্ধকতায় আপনার দৃষ্টিতে প্রাতিষ্ঠানিক কিংবা জাতীয়ভাবে আমরা কী মোকাবেলা করলাম বা করছি?

প্রথম বিশ্বযুদ্ধ হয়েছে, দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ হয়েছে; পৃথিবীতে যুদ্ধ কখনো থামবে না। আমাদের যেটা করতে হবে তা হলো অভিযোজিত হতে হবে। ঘটনাগুলো সবসময় ঘটেছে, এখনো ঘটছে, ভবিষ্যতেও ঘটবে। এগুলো নিয়ে চিন্তিত হওয়ার কিছু নেই। আমরা সবকিছুতে ভয় পেয়ে যাই। অথচ কভিডের মতো মহামারী আমরা অনেক সহজে মোকাবেলা করেছি। ব্যবসা হচ্ছে একটা যাত্রা, এটা কোনাে গন্তব্য নয়। কেউ যদি ব্যবসাকে গন্তব্য হিসেবে দেখে, তাহলে তাকে চাকরি করতে হবে। যাত্রায় উঁচু-নিচু-ঢালু সব পথ থাকবে। বাজারেও এ রকম আপ-ডাউন থাকবে। কখনো ব্যবসা ভালো যাবে, কখনো মন্দ যাবে। বাজার নিয়ে চিন্তা না করে নিজেকে নিয়ে চিন্তা করার পরামর্শ দেব আমি সবাইকে। স্টিভ জবসের উক্তি দিয়ে বলি, আপনি নিজেই আপনার প্রতিযোগী, অন্য কেউ নয়।

এ মুহূর্তে শিল্পের কাঁচামাল সংকটের অবস্থা কী?

গ্যাস সংকটের কারণে আমার ৩০-৪০ শতাংশ উৎপাদন কম হচ্ছে। সক্ষমতার সম্পূর্ণ ব্যবহার আমি করতে পারছি না।

জ্বালানিতে আমাদের অনুসন্ধান নেই। বিপরীতে আমরা আমদানিনির্ভর হয়ে গেছি। আমরা কি তাহলে ঝুঁকির দিকে যাচ্ছি?

অ্যাসোসিয়েশনগুলো শুধু তাৎক্ষণিক সংকট বলে চলে আসে। আমরা দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনা করতে পারছি না। গ্যাস সংকট তো অনেক দিন ধরেই চলছে। কারো দিকে আঙুল তোলার আগে নিজেকে প্রশ্ন করা উচিত—আমি কী করছি? আমাদের সমস্যাগুলোও আমরা সরকারকে বোঝাতে পারছি না। আবার কী করলে সরকারের কী লাভ হবে, তাও বলতে পারি না।

আপনার ১৪ বছরের ব্যবসায়িক জীবনে কোনো ব্যর্থতা আছে?

এ ১৪ বছরে আমার ১৪ হাজার ব্যর্থতা আছে। আইনস্টাইনের একটা উক্তি আমার খুব পছন্দের। তিনি বলেছেন, তুমি যদি কোনো ভুল না করে থাকো, তাহলে তুমি নতুন কিছু করোনি। আমি ভুল করব, আবার শিখব। আমাদের সমস্যা হয়ে যায়, আমরা মনে করি প্রথমবারেই আমরা সবকিছু সঠিকভাবে করে ফেলতে পারব। আমরা ভুলকে নেতিবাচকভাবে দেখি। তবে লক্ষ রাখতে হবে ভুল যেন বড় কিছু হয়ে না যায়। কারণ প্রথমবার করলে ভুল হবে। কিন্তু ভুল যদি দ্বিতীয়বার করা হয়, তখন এটি ইচ্ছাকৃত। আমার ব্যবসায়িক পথচলায় অনেক ভুল করেছি বলে আমি নতুন কিছু করার সাহস পাই।

তরুণ উদ্যোক্তা, যাদের বড় আর্থিক সামর্থ্য নেই, তাদের ক্ষেত্রে আপনার কী পরামর্শ?

স্টার্টআপকে আমরা ফান্ডিংয়ের দিকে নিয়ে গেছি। স্টার্টআপের জন্য টাকা তিনভাবে নেয়া যায়। বিনিয়োগকারী কিংবা মালিক থেকে, ব্যাংক থেকে ও গ্রাহক থেকে। আকিজের সফলতা হলো আকিজ গ্রাহক থেকেই টাকা নিয়েছে। বাংলাদেশের অনেক কোম্পানির সবচেয়ে বড় সমস্যা হলো তারা ব্যাংক থেকে টাকা নিতে চায়। ব্যাংক থেকে টাকা নিলে সে ব্যবসা সেলফ সাসটেইনেবল হবে না। আপনি যদি ছাড় দিয়ে কম টাকায় পণ্য বিক্রি করেন, তাহলে গ্রাহক সংখ্যা হয়তো অনেক পাবেন, তবে তারা অনুগত হবে না। ব্যবসায়ী আর দুষ্কৃতকারীর মধ্যে পার্থক্য হলো একজন সেবা দিয়ে টাকা নেয়, আরেকজন বন্দুক ঠেকিয়ে টাকা নেয়। গ্রাহক একজনকে খুশিমনে দেয়, আরেকজনকে অখুশিমনে দেয়। একজনের কাছে বারবার আসে, আরেকজনের কাছে কেউ যেতে চায় না। এখানেই পার্থক্য। ব্যবসা যদি গ্রাহককেন্দ্রিক হয়, তারাই যদি ফান্ডিং করে, তাহলে ব্যাংকের কাছেও যাওয়া লাগে না। কারো যদি ব্যবসা করার সঠিক চিন্তা থাকে, তাহলে ব্যবসা করা পানির মতো সহজ। তবে আগে থেকেই উদ্ভাবিত পণ্য নিয়ে গবেষণা করতে হবে। গ্রাহক ওই পণ্য নেবে কিনা সে সম্পর্কে স্পষ্ট ধারণা থাকতে হবে।

এই বিভাগের আরও খবর

আরও পড়ুন