নিয়মিত করদাতাদের আজীবন পেনশনের আওতায় আনা হোক

আনোয়ার ফারুক তালুকদার

ছবি : বণিক বার্তা

জাতীয় সংসদে ৬ জুন পেশ হয়েছে ৭ লাখ ৯৭ হাজার কোটি টাকার বাজেট। বিগত বছরগুলোয় প্রলম্বিত করোনা, রাশিয়ার ইউক্রেন আক্রমণ, ইসরায়েলের ফিলিস্তিন আক্রমণের কারণে বিশ্বব্যাপী সরবরাহ ঘাটতি দেখা দেয়ায় দেশে দেশে মুদ্রাস্ফীতি বেশি থাকলেও তারা অর্থনীতির সঠিক সূত্র প্রয়োগ করে এবং যুগোপযোগী সিদ্ধান্ত গ্রহণ করে মুদ্রাস্ফীতি কাঙ্ক্ষিত মাত্রায় নামিয়ে আনতে পারলেও আমাদের দেশের মুদ্রাস্ফীতি দুই বছর ধরেই ৯ শতাংশের ওপরে রয়েছে। দ্রব্যমূল্যের কশাঘাতে নিম্ন আয়ের মানুষের জীবন যেখানে অতিষ্ঠ, সেই অবস্থায় নতুন সরকারের প্রথম বাজেট প্রকাশ করে নতুন অর্থমন্ত্রী। এটা অর্থমন্ত্রী হিসেবে তার প্রথম বাজেট।

বাজেট নিয়ে বিস্তারিত আলোচনার সুযোগ রয়েছে, কারণ বাজেট একটি বিশাল বিষয়। আমি বাজেটের একটি দিক নিয়ে আলোচনা করতে চাই। সেটা হলো বেসরকারি করদাতাদের পেনশন প্রাপ্তি নিয়ে। আমাদের দেশে বেশকিছু নিয়মতান্ত্রিক প্রতিষ্ঠান রয়েছে, যাদের করের টাকা নিয়োগকর্তা বেতনের সঙ্গে কেটে নিয়ে সরকারি কোষাগারে জমা করেন। সেই কর ক্ষেত্র বিশেষে আয়ের শতকরা ২৫ ভাগ হয়ে যায়। এবারের কর প্রস্তাবনায় সেই স্লাব বাড়িয়ে শতকরা ৩০ ভাগে উন্নীত করা হয়েছে। এতে নিয়মিত কর প্রদানকারীদের ওপর করভার ৭ শতাংশের বেশি পড়বে বলে হিসাবে দেখা যাচ্ছে।

একদিকে মূল্যস্ফীতির কশাঘাতে মানুষের জীবন অস্থির, অন্যদিকে করের বোঝা বাড়ানোর প্রস্তাব জনজীবনকে আরো দুর্বিষহ করে তুলবে। তারপর পরোক্ষ করের চাপ তো আছেই। যত আয়ের দরকার তার সবটাই আদায়ের ব্যবস্থা হচ্ছে যারা কথা বলতে পারে না তাদের কাছ থেকে। একটা কল্যাণমুখী রাষ্ট্র ব্যবস্থায় এটি কল্পনা করা যায় না। আমরা যেখানে দিন দিন কল্যাণমুখী রাষ্ট্রের কাছাকাছি যাব তা না হয়ে আমরা যেন তা থেকে বিচ্যুত হচ্ছি। কোথায় হবে ‘‌দুষ্টের দমন আর শিষ্টের পালন’ তা না হয়ে হচ্ছে উল্টোটা। আশা করি, সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের বোধোদয় হবে। মানুষের ওপর বোঝা না চাপিয়ে তা কমিয়ে আনার ব্যবস্থা করবেন।

অন্যদিকে আমাদের দেশে কর শনাক্তকরণ নম্বরধারীর সংখ্যা কোটির অধিক ছাড়ালেও নিয়মিত আয়কর রিটার্ন দাখিল করেন ৩৫ লাখের কিছু বেশি। দেখা যাচ্ছে, একটা বিরাট অংশ কর শনাক্তকরণ নম্বর থাকা সত্ত্বেও নিয়মিত কর প্রদান বা রিটার্ন করছেন না। যদিও সবার কর শনাক্তকরণ নম্বর থাকলেই কর প্রদানের উপযুক্ত হবেন তা নাও হতে পারে। অথবা কেউ কেউ আগে করযোগ্য আয় করতেন এখন হয়তো কর প্রদানযোগ্য আয়ের আওতায় নাও পড়তে পারেন। যারা কর প্রদান করেন না তাদের করের আওতায় আনার ব্যবস্থা করা দরকার।

কর প্রদানে ন্যায্যতার নীতি প্রয়োগ করা প্রয়োজন। অর্থাৎ যিনি বেশি আয় করবেন তিনি বেশি কর প্রদান করবেন। মানুষের ব্যয়যোগ্য আয় বিবেচনার নিয়ে করারোপ করা। দেখা যায়, আমাদের দেশে বহুদিন ধরে করের নিম্নসীমা সাড়ে ৩ লাখ থেকে ৪ লাখ টাকার মধ্যে রয়েছে। সেই নিম্নসীমাকে ৫ লাখ টাকায় উন্নীত করা প্রয়োজন। যেভাবে মূল্যস্ফীতি মানুষের ব্যয়যোগ্য আয়কে কমিয়ে ফেলছে তা বিবেচনার দাবি রাখে। এমনকি আমাদের সমপর্যায়ের অর্থনীতির দেশগুলোতেও করের নিম্নসীমা ৫ লাখ টাকার অধিক রয়েছে। সেই বিবেচনায় আমাদের প্রস্তাবটি কর্তৃপক্ষ আমলে নেবেন বলে আমাদের বিশ্বাস।

সামাজিক নিরাপত্তা এবং কর প্রদানে উৎসাহিত করার জন্য নিয়মিত করদাতাদের জন্য পেনশন সুবিধার বিষয়টি এই বাজেট থেকে শুরু করার জোর দাবি জানাচ্ছি। যারা বেসরকারি চাকরি করেন তাদের জন্য চাকরি শেষে সরকারি চাকরিজীবীদের মতো পেনশন সুবিধা থাকে না। তাদের জন্য সরকারের তরফ থেকে কর প্রদানের হার বা মোট কর প্রদানের হিসাবে অবসরকালীন সময়ে আজীবন পেনশন সুবিধা চালু করা হোক। বিভিন্ন উন্নত দেশে এ সুবিধা চালু রয়েছে। ফলে মানুষ স্বতঃপ্রণোদিত হয়ে কর প্রদান করে। যেমন যুক্তরাষ্ট্রের রয়েছে রাষ্ট্রীয় ব্যবস্থায় সামাজিক নিরাপত্তা, চাকরিভিত্তিক, আনফান্ডেড এবং ব্যক্তিগত পেনশন। রাষ্ট্রীয় ব্যবস্থায় সামাজিক নিরাপত্তা পদ্ধতির আওতায় রয়েছে যুক্তরাষ্ট্রের ৯৪ শতাংশ কর্মক্ষম লোক। গ্রাহকের কর ও ট্রাস্ট ফান্ডে জমা হওয়া অর্থ বিনিয়োগের মুনাফা থেকে এ পেনশন দেয়া হয়। এ পদ্ধতিতে বছরে চারবার ১ হাজার ৪১০ ডলার করে জমা অর্থাৎ ১০ বছরে ৫৬ হাজার ৬০০ ডলার জমা হলেই পেনশনের প্রাথমিক যোগ্যতা অর্জন করা যায়। এই একই পদ্ধতি অনুসরণ করে আমাদের দেশের করদাতাদের জন্য এই পেনশন ব্যবস্থা চালু করলে করের মাধ্যমে সরকারের আয় বৃদ্ধি পাবে এটা নিশ্চিত করে বলা যায়।

আনোয়ার ফারুক তালুকদার: সিনিয়র এক্সিকিউটিভ ভাইস প্রেসিডেন্ট ও সিএসবিও, ডাচ্‌-বাংলা ব্যাংক লিমিটেড

 

এই বিভাগের আরও খবর

আরও পড়ুন