বাজেটে কালো টাকা সাদা করার সুযোগ বহাল

দুর্নীতি উসকে দিতে পারে অপ্রদর্শিত অর্থ বৈধ করার সুযোগ

ছবি : বণিক বার্তা

জাতীয় সংসদে ২০২৪-২৫ অর্থবছরের বাজেট প্রস্তাবের পর থেকেই তুমুল আলোচনার কেন্দ্রবিন্দু হয়ে দাঁড়ায় ‘কালো টাকা সাদা করার সুযোগ’ প্রসঙ্গটি। এতে বলা হয়, বিনা প্রশ্নে ১৫ শতাংশ কর প্রদানের মাধ্যমে কালো টাকা সাদা করা যাবে। অর্থাৎ অপ্রদর্শিত অর্থ বৈধ করা যাবে। নানা তর্ক-বিতর্কের মুখেও সুযোগটি বহাল রেখেই সংসদে ৩০ জুন বাজেট পাস করা হয়েছে। 

একদিকে স্থাবর সম্পত্তি যেমন ফ্ল্যাট, অ্যাপার্টমেন্ট ও ভূমির জন্য নির্দিষ্ট কর এবং নগদসহ অন্যান্য পরিসম্পদের ওপর ১৫ শতাংশ কর পরিশোধ করে অপ্রদর্শিত অর্থ বৈধ করা যাবে। এমনকি দেশের প্রচলিত আইনে যা-ই থাকুক না কেন এক্ষেত্রে কোনো কর্তৃপক্ষ কোনো ধরনের প্রশ্ন তুলতে পারবে না। অন্যদিকে বৈধ আয়ে সর্বোচ্চ করারোপ করা হয়েছে ২৫ শতাংশ। যদিও বাজেট প্রস্তাবে অর্থমন্ত্রী সর্বোচ্চ করহার ৩০ শতাংশ নির্ধারণের প্রস্তাব করেছিলেন। কিন্তু যেখানে বৈধ আয়ে ২৫ শতাংশ কর আরোপ করা হয়েছে সেখানে অপ্রদর্শিত অর্থে ১৫ শতাংশ করারোপ অসম কর ব্যবস্থার চিত্রই ফুটিয়ে তোলে। এটি নিয়মিত করদাতাদের ওপর হওয়া এক ধরনের অন্যায্য আচরণ। এ নীতি হয়ে উঠতে পারে ‘দুষ্টের পালন, শিষ্টের দমন। হতে পারে এটি আগামী দিনে দুর্নীতি উসকে দেবে।

জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের (এনবিআর) তথ্য পর্যালোচনা করলে দেখা যায়, অপ্রদর্শিত অর্থ বৈধ করার এ পন্থায় খুব বেশি সাড়া পাওয়া যায় না। স্বাধীনতার পর থেকে বিভিন্ন সরকার কালো টাকা সাদা করার সুযোগ দিয়ে আসছে। এনবিআরের তথ্যানুসারে, কালো টাকা সাদা করার ঘোষণার মাধ্যমে এখন পর্যন্ত সব মিলিয়ে অপ্রদর্শিত প্রায় ৪৭ হাজার কোটি টাকা বৈধ করা হয়েছে। এর মধ্যে সর্বোচ্চ পরিমাণ কালো টাকা সাদা হয়েছিল ২০২০-২১ অর্থবছরে প্রায় ২০ হাজার কোটি টাকা। ওই সময় ১০ শতাংশ করারোপ করা হয়। ধারণা করা হয়, এক অর্থবছরে এত বিশাল অংকের টাকা সাদা হওয়ার পেছনে অন্যতম একটি কারণ ছিল করোনার প্রভাব। কর্মকাণ্ড ও যোগাযোগের শিথিলতার কারণে অর্থ পাচার হতে পারেনি; দেশের অভ্যন্তরেই সরাসরি বিনিয়োগ করা হয়। কালো টাকা সাদা করার ধারাবাহিকতায় ২০২২-২৩ অর্থবছরের বাজেটে এক বছরের জন্য পাচার করা টাকা ৭ শতাংশ হারে কর দিয়ে দেশে ফেরত আনার আইনি সুযোগ দেয়া হয়। তবে অর্থবছর শেষে দেখা যায়, এতে কোনো লাভ হয়নি। এ উদ্যোগ উল্টো নিয়মিত করদাতাদের নিরুৎসাহিত করে থাকে কর প্রদানে।

কর প্রয়োগের মাধ্যমে কালো টাকা সাদা করার সুযোগ পৃথিবীর অন্য অনেক দেশেও আছে। এক্ষেত্রে যেসব দেশ এর মাধ্যমে কর ফাঁকি ও অবৈধ অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ডে জড়িতদের চিহ্নিত করতে পেরেছে এবং তাদের বিরুদ্ধে শক্ত পদক্ষেপ গ্রহণ করেছে, কেবল তারাই সফল হয়েছে। অর্থাৎ কোনো রাজনৈতিক আপসে যায়নি। বাংলাদেশে এ সুযোগ দেয়া হবে বিনা প্রশ্নে ও বৈধ আয়ে প্রদানকৃত করের চেয়ে কম হারে কর প্রদানের মাধ্যমে। একদিকে কম করহার, অন্যদিকে আয়ের উৎস সম্পর্কে প্রশ্নও করা যাবে না। তাহলে এ সুযোগ প্রদানের উদ্দেশ্য কী? 

এ উদ্যোগের পেছনে বহুল প্রচারিত দুটি যুক্তি হলো, অর্থ পাচার আটকানো ও অপ্রদর্শিত অর্থ মূলধারার অর্থনীতিতে প্রবেশের সুযোগ করে দেয়া। এক কথায় রাজস্ব বাড়ানো। কিন্তু যারা দুর্নীতির মাধ্যমে সম্পদের পাহাড় গড়েছে তাদের লাগাম টেনে না ধরে কতটুকুইবা রাজস্ব আয় বাড়ানো সম্ভব এভাবে? তাও আবার বৈধ করদাতাদের চেয়ে কম কর প্রদানের মাধ্যমে? রাজস্ব আয় বাড়ানোর জন্য প্রয়োজন দুর্নীতি দমন করতে পারে এমন আর্থিক নীতি। এ নীতি সরকারের আর্থিক অব্যবস্থাপনাকে বরং স্পষ্ট করে তুলেছে। যে দেশের বাইরে কালো টাকা বা অপ্রদর্শিত অর্থ বিনিয়োগ করতে সক্ষম, সে কেনইবা ১৫ শতাংশ কর দিয়ে দেশে টাকা বৈধ করতে চাইবে? তাও আবার যখন দেশের বা বিদেশের কেউ ‘ওই’ দেশগুলোকে প্রশ্ন করে না অন্য দেশের কালো টাকার বিনিয়োগ প্রসঙ্গে কিংবা ওইসব দেশের ওপর মানবাধিকার বা দাতা সংস্থা কোনো ধরনের শর্তারোপ করে না প্রকল্প বাস্তবায়নের ক্ষেত্রে। কালো টাকার সঙ্গে কালো টাকার মালিকরাও বরং সেসব দেশে আশ্রয় পায়। ইদানীং সংবাদপত্রের পাতাজুড়ে এমন খবরের ছয়লাপ। 

সাম্প্রতিক বছরগুলোয় পাচার হওয়া অর্থ ফেরত আসার বদলে অর্থ পাচারের পরিমাণ ক্রমেই বেড়ে চলেছে। বাংলাদেশ অর্থনীতি সমিতি গত বছর মে মাসে বিকল্প বাজেট প্রস্তাবে উল্লেখ করে, ৫০ বছরে দেশ থেকে প্রায় ১২ লাখ কোটি টাকা পাচার হয়ে গেছে। ওয়াশিংটনভিত্তিক গ্লোবাল ফাইন্যান্সিয়াল ইন্টেগ্রিটির (জিএফআই) পরিসংখ্যানমতে, আন্তর্জাতিক বাণিজ্যের আড়ালে বাংলাদেশ থেকে ২০০৯-১৫ সময়কালে মোট অন্তত ৮২৭ কোটি ডলার পাচার হয়েছে, যা টাকার অংকে ৯১ হাজার কোটি টাকার বেশি। অর্থাৎ কেবল পণ্য আমদানিতে অধিক মূল্য ও পণ্য রফতানিতে কম দাম দেখানোর মাধ্যমে এ পরিমাণ অর্থ পাচার করা হয়েছে ওই সময়। অবশ্য টাকা পাচার পরিমাপের কোনো সর্বজনীন পদ্ধতি বা আন্তর্জাতিক মাপকাঠি না থাকায় টাকা পাচারের প্রকৃত চিত্র তুলে ধরাও মুশকিল। কিন্তু সংখ্যাটি যে বেশ বড় সে বিষয়ে সন্দেহের অবকাশ নেই।

‘বিনা প্রশ্নে’ কালো টাকা সাদা করার সুযোগ না থাকলে হয়তো বহালকৃত সুযোগের মাধ্যমে অবৈধ আয়ের উৎস ঠাহর করতে সুবিধা হতো। এটি অর্থ পাচার বন্ধে সহায়ক হতে পারত। বিশেষজ্ঞদের মতে, এ সুযোগ উল্টো দুর্নীতিতে সহায়ক হতে পারে। তাদের মতে, বৈধ প্রক্রিয়ায়ও কিছু টাকা অপ্রদর্শিত থেকে যেতে পারে। সেক্ষেত্রে এ অর্থ প্রদর্শনের জন্য অর্থের পরিমাণের ওপর করহার নির্ধারণ করলে অন্তত সেটি বৈষম্যমূলক ও অন্যায্য হতো না।

এই বিভাগের আরও খবর

আরও পড়ুন