প্রযুক্তি ভাবনা

ক্যাশলেস সোসাইটির জন্য ব্যক্তিগত ও জাতীয় পর্যায়ে তথ্যের নিরাপত্তা জরুরি

মো. মাহতাবুর রহমান

ছবি : বণিক বার্তা

‘ক্যাশলেস হওয়ার শর্তে’ ১৯টি তথ্যপ্রযুক্তির ব্যবসা গত ৬ জুন ২০২৪-২৫ অর্থবছরের বাজেটে করমুক্ত রাখার প্রস্তাব করেছেন অর্থমন্ত্রী আবুল হাসান মাহমুদ আলী। এরই মধ্যে অর্থমন্ত্রীর এ বক্তব্য বাজেটের ভালো দিক হিসেবে সুবিধাভোগীদের কাছে গ্রহণযোগ্য হয়েছে। এর আগে সাবেক অর্থমন্ত্রী আ হ ম মুস্তফা কামাল ২০২৩-২৪ অর্থবছরের বাজেট প্রস্তাবে ক্যাশলেস সোসাইটি গড়ার লক্ষ্যের কথা জাতীয় সংসদে প্রথম উপস্থাপন করেন। এরই ধারাবাহিকতায় বাজেট-পরবর্তী সংবাদ সম্মেলনে সাংবাদিকরা এ নিয়ে প্রশ্ন করলে অর্থমন্ত্রীর পক্ষে বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নর আব্দুর রউফ তালুকদার বলেছেন, ‘সরকারের লক্ষ্য হচ্ছে, ২০২৭ সালের মধ্যে ৭৫ শতাংশ ক্যাশলেস লেনদেন চালু করা’। 

একটি উদীয়মান ও সম্ভাবনাময় খাত হিসেবে তথ্যপ্রযুক্তি খাতের ২৭টি ব্যবসা ২০১১ সাল থেকে কর অব্যাহতির সুবিধা দিয়ে আসছে সরকার। ২০২০-২১ অর্থবছরে এ সুবিধার মেয়াদ শেষ হওয়ার কথা ছিল। যদিও সরকার এ সুবিধার মেয়াদ ২০২৪ সালের জুন পর্যন্ত বাড়ায়। তবে ২০২৪-২৫ অর্থবছরের বাজেটে আগামী তিন বছর যে ১৯টি ব্যবসা কর অব্যাহতির সুবিধা পাবে, তার মধ্যে অনেকগুলোই এ তালিকায় ছিল। ভবিষ্যতে যেসব ব্যবসা কর অব্যাহতির সুবিধা পাবে না সেগুলোর মধ্যে রয়েছে—নেশনওয়াইড টেলিকমিউনিকেশন ট্রান্সমিশন নেটওয়ার্ক (এনটিটিএন), আইটি প্রসেস আউটসোর্সিং, ওয়েবসাইট হোস্টিং, সার্চ ইঞ্জিন অপটিমাইজেশন সার্ভিস, ক্লাউড সার্ভিস এবং সিস্টেম ইন্টিগ্রেশন।

‘স্মার্ট বাংলাদেশ’ গড়ার স্বপ্ন নিয়ে এগোতে থাকা একটি দেশের তথ্যপ্রযুক্তির অবকাঠামো তৈরিতে ২০১১ সাল থেকে দেয়া কর অব্যাহতি একটি সঠিক ও সময় উপযোগী সিদ্ধান্ত। সেই সঙ্গে বিভিন্ন পক্ষের মতামতকে গুরুত্ব দেয়ার সংস্কৃতি তৈরি হওয়ার ক্ষেত্রেও এটি একটি অনুকরণীয় উদ্যোগ। অবশ্য কর অব্যাহতির তালিকায় এআই বেজড সলিউশন ডেভেলপমেন্ট, ব্লকচেইন বেজড সলিউশন ডেভেলপমেন্টের মতো উদীয়মান খাতকে প্রাধান্য দিলেও অপ্রত্যাশিতভাবে বাদ পড়েছে ক্লাউড সার্ভিসের মতো একটি অগ্রসরমাণ সেবা খাত। 

ক্লাউড সার্ভিসের ওপর নির্ভর করে ডাটা সিকিউরিটি, ডাটা অ্যানালিটিকস, ডাটাভিত্তিক সিদ্ধান্ত থেকে শুরু করে এআই-নির্ভর বহু উদ্ভাবনী সেবায় দেশীয় উদ্যোক্তারা এগিয়ে এসেছেন। দেশীয় উদ্যোক্তাদের নানা ক্লাউড সেবার জন্য যেখানে প্রণোদনার দাবি রাখে, সেখানে তা বন্ধ করে দেয়াটা বাস্তবিক নয় বলে সংশ্লিষ্টরা মনে করছেন। 

ক্যাশলেস সোসাইটি হওয়ার অন্যতম প্রধান অনুষঙ্গ হলো সহজলভ্য ইন্টারনেট সেবা। কিন্তু উল্লেখযোগ্যসংখ্যক মানুষের কর্মসংস্থান করা ইন্টারনেট সংযোগদাতা প্রতিষ্ঠান আইএসপিগুলোকে তথ্যপ্রযুক্তি সেবা খাতে (আইটিইএস) অন্তর্ভুক্ত করা হয়নি। এ নিয়ে বিভিন্ন পক্ষ ক্রমাগত দাবি জানিয়ে আসছেন। এমন প্রেক্ষাপটে ইন্টারনেটের মূল্য বৃদ্ধির আশঙ্কা করছেন সংশ্লিষ্টরা। এছাড়া বর্তমান বাস্তবতায় বাংলাদেশে ইন্টারনেটের মূল্যের সঙ্গে গ্রহণযোগ্য গতি নিশ্চিত করাটাও বেশ জরুরি। ভালো গতির ইন্টারনেট সেবা আমাদের ফ্রিল্যান্সারদের আরো উপার্জন বাড়াতে পারে, একই সঙ্গে ক্যাশলেস সোসাইটির সেবাকেও নিশ্চিত করবে।

এদিকে কেন্দ্রীয় ব্যাংক দেশের মধ্যে নগদ টাকায় লেনদেন কমাতে চায় এবং এ লক্ষ্যে নানা উদ্যোগও নেয়া হয়েছে। মোবাইল ফোনে কিউআর কোডভিত্তিক আর্থিক লেনদেনের জন্য ‘বাংলা কিউআর’ বাধ্যতামূলক করেছে বাংলাদেশ ব্যাংক। ‘বাংলা কিউআর’ সব ব্যাংক এবং মোবাইল ফাইন্যান্সিয়াল সার্ভিসের সেবাকে সহজ করেছে এবং ডিজিটাল লেনদেন সহজলভ্য হয়েছে। ক্যাশলেস বাংলাদেশ উদ্যোগের আওতায় নগদ টাকা ব্যবহার কমাতে ‘বাংলা কিউআর’-এর আগে ইলেকট্রনিক ফান্ড ট্রান্সফার সুবিধা চালু হয়েছে। রয়েছে ন্যাশনাল পেমেন্ট সুইচের অধীন এটিএম, পয়েন্ট অব সেলস, কার্ডে লেনদেন ও ইন্টারনেট ব্যাংকিং ফান্ড ট্রান্সফার ও রিয়েল টাইম গ্রোস সেটেলমেন্টের সুবিধা। এগুলো সবই ইন্টারনেট ব্যবহার করে নেয়া ব্যাংকিং সুবিধা। 

এছাড়া মোবাইল ফিন্যান্সিয়াল সার্ভিস (এমএফএস) লেনদেনের চিত্র বদলে দিয়েছে। পরিষেবা বিল পরিশোধ, মোবাইল রিচার্জ, টিকিট কেনা, শপিং মলে কেনাকাটা, অর্থ স্থানান্তর সেবা—এগুলো সাধারণ মানুষের হাতের মুঠোয় চলে এসেছে।

এরই মধ্যে ‘টাকা পে’ নামে বাংলাদেশ ব্যাংকের উদ্যোগে চালু করা হয়েছে জাতীয় ডেবিট কার্ড। এটি ন্যাশনাল পেমেন্ট সুইচ বাংলাদেশের (এনপিএসবি) মাধ্যমে পরিচালিত হয়, যা দেশের অভ্যন্তরে যেকোনো এটিএম বুথে সহজে ও দ্রুত লেনদেনের সুযোগ প্রদান করে। এছাড়া দেয়া হয়েছে ‘লেনদেন’ হোয়াইট লেবেল এটিএম ও মার্চেন্ট অ্যাকুইয়ারার (ডব্লিউএলএএমএ) এবং দুটি ডিজিটাল ব্যাংক যা ‘নগদ’ ও ‘কড়ি’ নামে নিবন্ধন পেয়েছে। এসব সুবিধা চালুর মাধ্যমে নগদ টাকা ব্যবহার কমে এলে এবং ডিজিটাল লেনদেন বাড়লে টাকা ছাপানোর খরচ কমার পাশাপাশি প্রতিটি লেনদেনের হিসাব থাকবে। আবার খুচরা টাকারও ঝামেলা ও সময়ের অপচয় কমিয়ে আনার পাশাপাশি জীবন আরো স্বচ্ছন্দময় হবে। 

এবারের বাজেটে অর্থমন্ত্রী ক্যাশলেস হলে করপোরেট প্রতিষ্ঠানের আয়কর ২ দশমিক ৫ শতাংশ কমানোর প্রস্তাব রেখেছেন। প্রস্তাবনা অনুযায়ী, অনিবন্ধিত কোম্পানির জন্য বিদ্যমান ২৭ দশমিক ৫ শতাংশ কমিয়ে ২৫ শতাংশ করপোরেট কর দিতে হবে। তবে এক্ষেত্রে শর্ত থাকবে সব ধরনের আয়, প্রাপ্তি, ৫ লাখ টাকা একক লেনদেন এবং ৩৬ লাখ টাকার বেশি বার্ষিক সব খরচ ও বিনিয়োগ ব্যাংক ট্রান্সফারের মাধ্যমে করতে হবে। 

একইভাবে তালিকাভুক্ত কোম্পানিগুলোর আয়কর ২২ দশমিক ৫ শতাংশ থেকে কমিয়ে ২০ শতাংশ করার প্রস্তাব দিয়েছেন অর্থমন্ত্রী। তবে এক্ষেত্রে শেয়ার অফ-লোডিং অর্থাৎ সাধারণ বিনিয়োগকারীদের শেয়ার অন্তত ১০ শতাংশ হতে হবে। এর কম হলে কোম্পানিকে ২৫ শতাংশ হারে আয়কর দিতে হবে। লেনদেনে ব্যাংক ট্রান্সফারের শর্ত মেনে চললে আয়করের হার হবে ২২ দশমিক ৫ শতাংশ। 

অর্থমন্ত্রী একক ব্যক্তির কোম্পানিকে উৎসাহ দিতে তালিকাভুক্ত নয় এমন কোম্পানিগুলোর মতো তাদের একই শর্ত মেনে চলার সাপেক্ষে করহার ২২ দশমিক ৫ শতাংশ থেকে ২০ শতাংশ করার প্রস্তাবনা দিয়েছেন। তাই সব ব্যবসায়িক লেনদেন ক্যাশলেস হওয়ার শর্তটি আরো স্পষ্ট হওয়া প্রয়োজন। কারণ লেনদেন সর্বোপরি ১০০ ভাগ ক্যাশলেস হওয়া বাস্তবসম্মত নয়। 

স্মার্ট বাংলাদেশের জন্য ক্যাশলেস সোসাইটি অবশ্যই জরুরি। কিন্তু লেনদেন ক্যাশলেস হওয়ার জন্য যে ব্যবসাবান্ধব পরিবেশ প্রয়োজন—ডিজিটাল লেনদেনের উল্লেখযোগ্য হারের কমিশন, আন্তঃব্যাংকিং লেনদেন নিষ্পত্তির সময় এবং প্রযুক্তিগত প্রতিবন্ধকতা—সব মিলিয়ে ক্যাশলেস হতে আরো মনস্তাত্ত্বিক উৎসাহের প্রয়োজনীয়তা আছে। একটি লেনদেনে যেহেতু অনেক পক্ষ জড়িত থাকে তাই সর্বোপরি ক্যাশলেস হতে হলে সব পক্ষকেই নগদ নোটের পরিবর্তে ব্যাংক ও ডিজিটাল মাধ্যমে আস্থা আনতে হবে। এখানে সরকার, ব্যবসায়ী ও ব্যক্তিগত সব লেনদেনই নির্ভরশীল। তাই সরকারকেও ক্যাশলেস হতে হবে, সেই সঙ্গে বাড়াতে হবে ব্যক্তিগত পর্যায়ে ডিজিটাল লেনদেন ও ব্যাংকের অন্তর্ভুক্তীকরণ।

প্রযুক্তিগত উৎকর্ষ এবং চতুর্থ শিল্প বিপ্লবের অগ্রগতিতে উন্নত বিশ্বে দ্রুত হারে বাড়ছে ক্যাশলেস লেনদেন। লেনদেনের স্বচ্ছতা ও নিরাপত্তা বৃদ্ধি, লাভজনক, খরচ সাশ্রয়ী ও দ্রুত অর্থনৈতিক অন্তর্ভুক্তির কারণে ক্যাশলেস সোসাইটি প্রয়োজনীয় ও গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠছে। এ ধারাবাহিকতায় কমছে মানবসম্পদের ব্যবহার। 

উন্নত বিশ্বে ডিজিটাল লেনদেনের পাশাপাশি কমে যাচ্ছে লেনদেনে হিউম্যান টাচ (মানবীয় স্পর্শ)। মানবসম্পদ ছাড়াই সম্ভব হচ্ছে সেবা ও বাণিজ্যিক কার্যক্রম পরিচালনা করা। এক্ষেত্রে আমাদেরও লক্ষ রাখতে হবে—তুলনামূলক স্বল্প খরচের মানবসম্পদকে বাদ দিয়ে ক্যাশলেস হতে গিয়ে আমাদের মূলধনি ব্যয় বেড়ে যেতে পারে এবং জনশক্তি পেশাগত প্রতিবন্ধকতার শিকার হতে পারে। ফলে একটি শক্ত ভিতের ওপর আমাদের একটি তথ্যপ্রযুক্তিভিত্তিক দেশ গড়তে হবে, যা ক্যাশলেস সোসাইটি তৈরিতে সহজে ভূমিকা রাখবে। 

ক্যাশলেস সোসাইটিতে উত্তরণের জন্য ব্যক্তিগত ও জাতীয় পর্যায়ে তথ্যের নিরাপত্তা জরুরি। ডিজিটাল লেনদেনের ক্ষেত্রে বিভিন্ন ধরনের ব্যক্তিগত তথ্য, যেমন ব্যাংক অ্যাকাউন্ট নম্বর, ডেবিট বা ক্রেডিট কার্ডের তথ্য, মোবাইল নম্বর এবং অন্য ব্যক্তিগত তথ্য ব্যবহার করা হয়। এ তথ্যগুলো নিরাপদে সংরক্ষণ ও ব্যবহারের জন্য যথাযথ সুরক্ষা ব্যবস্থা গ্রহণ করা অত্যন্ত প্রয়োজন। এ ধরনের ব্যক্তিগত তথ্য ফাঁস হলে ব্যক্তিগত গোপনীয়তা লঙ্ঘিত হয়, যা ব্যবহারকারীর সম্মান ও নিরাপত্তার জন্য হুমকি। ব্যক্তিগত তথ্যের নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে এনক্রিপশন পদ্ধতি, একাধিক ধাপের নিরাপত্তা যাচাইকরণসহ ব্যবহারকারীদের সচেতনতা বৃদ্ধিতে উদ্যোগ নেয়া জরুরি। নিরাপদ ক্যাশলেস লেনদেন ব্যবস্থার মাধ্যমে ব্যবহারকারীদের আস্থা বাড়ানো এবং অর্থনৈতিক নিরাপত্তা নিশ্চিত করা সম্ভব।

২০২৪-২৫ অর্থবছরের প্রস্তাবিত বাজেটে সুখী, সমৃদ্ধ, উন্নত ও স্মার্ট বাংলাদেশ বিনির্মাণের অঙ্গীকার করেছেন অর্থমন্ত্রী। ক্যাশলেস হওয়ার প্রণোদনা বাংলাদেশের স্মার্ট অর্থনৈতিক ক্ষেত্রে একটি গুরুত্বপূর্ণ পদক্ষেপ। তবে এর মধ্য দিয়ে যেন দেশের মানুষ স্বাবলম্বী হয় এবং সবার জন্য যেন কর্মসংস্থানের সুযোগ ঘটে সেটি সবাইকে মিলে নিশ্চিত করতে হবে। 

ডিজিটাল লেনদেনের মাধ্যমে দুর্নীতি হ্রাস, আর্থিক অন্তর্ভুক্তি, লেনদেনের সময় ও খরচ সাশ্রয়ের সুবিধা পাবে দেশবাসী। সঠিকভাবে এ উদ্যোগ বাস্তবায়ন হলে দ্রুতই বাংলাদেশ ডিজিটাল ও স্মার্ট পথে উল্লেখযোগ্য অগ্রগতি অর্জন করবে।

মো. মাহতাবুর রহমান: তথ্যপ্রযুক্তি উদ্যোক্তা ও প্রতিষ্ঠাতা, আইটেক সলিউশন

এই বিভাগের আরও খবর

আরও পড়ুন