৮৭ জেলা-উপজেলায় অনুপস্থিত আইসিটি কর্মকর্তা

স্মার্ট বাংলাদেশ নির্মাণে সরকারের প্রতিশ্রুতির সঙ্গে মাঠের চিত্রে মিল নেই

ছবি : বণিক বার্তা

নতুন অর্থবছর শুরু হয়েছে। অর্থমন্ত্রী গত ৬ জুন ‘টেকসই উন্নয়নের পরিক্রমায় স্মার্ট বাংলাদেশের স্বপ্নযাত্রা’ শিরোনামে ২০২৪-২৫ অর্থবছরের বাজেট সংসদে উপস্থাপন করেন। ২০৪১ সালের মধ্যে বাংলাদেশকে স্মার্ট বাংলাদেশে রূপান্তরের অভিপ্রায় সরকারের, যার স্তম্ভ হবে চারটি—স্মার্ট নাগরিক, স্মার্ট সরকার, স্মার্ট ইকোনমি ও স্মার্ট সোসাইটি। স্মার্ট বাংলাদেশের স্বপ্নযাত্রা পূরণ করতে হলে দেশের সর্বস্তরে তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তি খাতের (আইসিটি) বিস্তার অতীব জরুরি। বিশেষ করে তৃণমূলে প্রযুক্তির বিকাশ না ঘটলে স্মার্ট বাংলাদেশ গড়া সম্ভব নয়। 

স্মার্ট বাংলাদেশ গড়ার লক্ষ্যে জেলা ও উপজেলা পর্যায়ে স্থাপন করা হয় আইসিটি কার্যালয়। ই-সরকারের মাঠ প্রশাসনের সঙ্গে নিবিড় সম্পর্ক গড়ে তুলতে নিয়োগ দেয়া হয় প্রোগ্রামার বা জেলা আইসিটি অফিসার, সহকারী প্রোগ্রামার বা উপজেলা আইসিটি অফিসার, সহকারী নেটওয়ার্ক ইঞ্জিনিয়ার। কিন্তু বণিক বার্তার এক প্রতিবেদন জানান দিচ্ছে স্মার্ট বাংলাদেশ নির্মাণে সরকারের প্রতিশ্রুতির সঙ্গে মাঠের চিত্রে মিল নেই। জেলা ও উপজেলা আইসিটি কার্যালয়ে কর্মরত ৫০৭ কর্মকর্তার মধ্যে বর্তমানে ঢাকায় অফিস করছেন ৮৭ জন। তাদের অনেককে কাজের প্রয়োজনে সংযুক্ত করা হলেও বেশির ভাগই এসেছেন তদবির করে। তাদের আইসিটি অধিদপ্তরের প্রধান কার্যালয় কিংবা সরকারের অন্যান্য দপ্তরে সংযুক্ত করা হয়েছে। ফলে প্রায়ই ফাঁকা থাকছে তাদের দায়িত্বপ্রাপ্ত জেলা ও উপজেলা কার্যালয়গুলো। বিশেষ প্রয়োজনে অতিরিক্ত হিসেবে দায়িত্ব দিয়ে পার্শ্ববর্তী জেলা কিংবা উপজেলার আইসিটি অফিসারকে এনে কাজ সারা হচ্ছে।

প্রতিবেদনটিতে আরো উল্লেখ করা হয়, তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তি বিভাগের সূত্রমতে সরকারি অফিসগুলোয় আইসিটি কর্মকর্তার চাহিদার তুলনায় লোকবল কম থাকায় সব কার্যালয়ে আইসিটি অফিসার নিয়োগ সম্ভব হয় না। এর পরও সরকারি গুরুত্বপূর্ণ দপ্তরগুলোয় তারা এ সেবা দিয়ে থাকে; কর্মকর্তাদের ডেপুটেশনে পাঠানো হয়। পর্যাপ্ত লোকবলের অভাবে পার্শ্ববর্তী উপজেলার অফিসারকে দায়িত্ব দিয়ে কার্যক্রম পরিচালনা করতে হয়। তবে এতে খুব বেশি সমস্যা হয় না।

এ পরিস্থিতি দুটি গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্নের উদ্রেক ঘটায়। এক. যদি কোনো উপজেলায় আইসিটি কার্যালয়ের কাজ পার্শ্ববর্তী উপজেলার কর্মকর্তাকে দিয়ে সম্পাদন করানো যায় তাহলে ওই উপজেলায় কর্মকর্তা নিয়োগের প্রয়োজন রয়েছে কি? দুই. যদি তাদের আইসিটি অধিদপ্তরের প্রধান কার্যালয় কিংবা সরকারের অন্যান্য দপ্তরে সংযুক্ত করার প্রয়োজনীয়তা থাকে তাহলে উপজেলায় অফিসার হিসেবে নিয়োগের কারণ কী?

এর পেছনে যে কারণই দর্শানো হোক না কেন, এর ফলাফল খুব স্পষ্ট। তৃণমূলে প্রযুক্তির বিকাশ এতে ব্যাহত হচ্ছে এবং হবে। যার নেতিবাচক প্রভাব পড়বে রূপকল্প-২০৪১ পূরণে।

একদিকে কর্মকর্তার সংকট, অন্যদিকে উপজেলাগুলোয় দায়িত্ব পালন করতে আসা সরকারি কর্মকর্তাদের অনেকে তুলনামূলকভাবে আইসিটি বিষয়ে কম দক্ষ। তরুণ কর্মকর্তারা আইসিটির বিষয়গুলো কিছুটা বুঝলেও প্রবীণদের কাজগুলো আইসিটি কর্মকর্তাদেরই করে দিতে হয়। ফলে কোনো সহযোগী ছাড়া এক উপজেলায় কাজ করা কঠিন হয়ে পড়ে এবং যারা অতিরিক্ত দায়িত্ব পালন করেন তারা উপজেলার কাজগুলো পুরোপুরিভাবে করতে ব্যর্থ হন। তাদের দায়িত্ব পালনে নানা বেগ পেতে হয়। 

আইসিটি অধিদপ্তরের তথ্য অনুযায়ী, বর্তমানে প্রোগ্রামার পদের জন্য অধিদপ্তরে অনুমোদিত পদ রয়েছে ৬৪টি (প্রতি জেলায় একজন করে)। এর মধ্যে কর্মরত আছেন ৪২ কর্মকর্তা। প্রোগ্রামাররা মূলত জেলার আইসিটি অফিসার হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। এসব কর্মকর্তার মধ্যে আবার আটজন আইসিটি অধিদপ্তরের প্রধান কার্যালয়ে এবং পাঁচজন সরকারের বিভিন্ন দপ্তরে সংযুক্ত রয়েছেন। সে হিসেবে ৬৪টির মধ্যে বর্তমানে ৩৫ জেলা কার্যালয়েই কোনো অফিসপ্রধান নেই।

অন্যদিকে অনুমোদিত ৪৯২টি সহকারী প্রোগ্রামার পদের মধ্যে কর্মরত আছেন ৪৬৫ জন, যারা মূলত উপজেলা কার্যালয়ের দায়িত্ব পালন করে থাকেন। তাদের মধ্যে আবার ৩১ কর্মকর্তা প্রধান কার্যালয়ে ও ৩৫ জন সরকারের অন্যান্য দপ্তরে সংযুক্ত রয়েছেন। জেলার সহকারী নেটওয়ার্ক ইঞ্জিনিয়ারদের মধ্যে আটজন প্রধান কার্যালয় ও সরকারের বিভিন্ন দপ্তরে সংযুক্ত রয়েছেন। জেলার সহকারী নেটওয়ার্ক ইঞ্জিনিয়ারদের মধ্যে প্রধান কার্যালয় ও সরকারের অন্যান্য দপ্তরে সংযুক্ত রয়েছেন আটজন। প্রধান কার্যালয়ের পাশাপাশি এসব কর্মকর্তাকে মূলত এজেন্সি টু ইনোভেট (এটুআই), বিভিন্ন সিটি করপোরেশন, নার্সিং অ্যান্ড মিডওয়াইফারি অধিদপ্তর, ডিজিটাল সিকিউরিটি এজেন্সি, মন্ত্রিপরিষদ বিভাগ, বিভাগীয় কমিশনারের কার্যালয়, সরকারি কর্মকমিশন, স্থলবন্দর কর্তৃপক্ষ, জনশক্তি কর্মসংস্থান ও প্রশিক্ষণ ব্যুরো, বেসরকারি শিক্ষক নিবন্ধন ও প্রত্যয়ন কর্তৃপক্ষ (এনটিআরসিএ), বাংলাদেশ বিনিয়োগ উন্নয়ন কর্তৃপক্ষের কার্যালয়ে সংযুক্ত করা হয়েছে।

এর পেছনে দায়ী আইসিটি কর্মকর্তারাই যারা জেলা কিংবা উপজেলায় থাকতে চান না; সরকারি ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা, মন্ত্রী, এমপির সুপারিশে প্রধান প্রধান কার্যালয় কিংবা সরকারের বিভিন্ন দপ্তরে সংযুক্ত হয়ে ঢাকায় চলে আসেন। ফলাফলস্বরূপ পাঠপর্যায়ের কার্যক্রম পরিচালনায় ভোগান্তিতে পড়তে হয় জেলা-উপজেলার কর্মকর্তাদের। আইসিটি বিশেষজ্ঞদের মতে, জেলা-উপজেলাগুলোয় আইসিটি অফিসার না থাকায় সরকারের স্মার্ট বাংলাদেশ ভিশন নিয়ে গৃহীত বেশকিছু কার্যক্রম বাধার সম্মুখীন হবে।

তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তি খাতের অবকাঠামো উন্নয়নে এক দশকে ৬ হাজার ৭০ কোটি টাকার বেশি ব্যয়ে ২২টি প্রকল্প শেষ হয়েছে। সামনে ১৮ হাজার ৭৫১ কোটি টাকা ব্যয়ে ২২টি প্রকল্পের মাধ্যমে আইসিটি অবকাঠামো খাতকে আরো শক্তিশালী করতে চায় সরকার। এসব প্রকল্পের মধ্যে রয়েছে টেলিযোগাযোগ সুবিধাবঞ্চিত এলাকাগুলোয় কানেক্টিভিটি স্থাপন, এনহ্যান্সিং ডিজিটাল গভর্নমেন্ট অ্যান্ড ইকোনমি, আইটি ট্রেনিং অ্যান্ড ইনকিউবেশন সেন্টার নির্মাণ, জেলা পর্যায়ে আইটি ও হাই-টেক পার্ক স্থাপন, ডিজিটাল সংযোগ স্থাপন (ইডিসি) ইত্যাদি। আর এসব অবকাঠামোর স্থানীয় কর্তৃপক্ষ হিসেবে আইসিটি অধিদপ্তরের অধীনে কর্মরত জেলা ও উপজেলার আইসিটি কর্মকর্তারাই কাজ করে থাকেন।

সরকারের এসব প্রকল্প ও উদ্যোগ সফল করতে হলে শুরুতেই পর্যাপ্ত ও দক্ষ জনবল নিয়োগ করা প্রয়োজন। অবকাঠামো উন্নয়নের সঙ্গে প্রশিক্ষিত ও দক্ষ কর্মকর্তা অতি গুরুত্বপূর্ণ। পাশাপাশি পুরনো কর্মকর্তাদের যুগোপযোগী প্রশিক্ষণ প্রদানের ব্যবস্থা নিতে হবে। তবেই হয়তো স্থানীয় কর্তৃপক্ষ হিসেবে জেলা ও উপজেলার আইসিটি কর্মকর্তারা সরকারের স্মার্ট বাংলাদেশ গড়ার উদ্যোগকে জনগণের দ্বারপ্রান্তে পৌঁছে দিতে সক্ষম হবে। 

এই বিভাগের আরও খবর

আরও পড়ুন