পর্যালোচনা

বিশ্ববিদ্যালয়ে যৌন হয়রানি মহিলা পরিষদের প্রস্তাব ও সমাজের ‘জেন্ডার রোল’

ড. রাহমান নাসির উদ্দিন

ছবি : বণিক বার্তা

বাংলাদেশের বিশ্ববিদ্যালয়গুলো নানা কারণে সংবাদের শিরোনাম হয়। পাঠকসংখ্যার বিবেচনায় বিশ্ববিদ্যালয়কেন্দ্রিক সংবাদ স‍‍র্বাধিক পাঠকের কেন্দ্রীয় মনোযোগ আক‍‍র্ষণ করার কারণে মিডিয়াও বিশ্ববিদ্যালয়কেন্দ্রিক সংবাদকে বিশেষ গুরুত্ব দিয়ে প্রকাশ (প্রিন্ট মিডিয়া) ও প্রচার (ইলেকট্রনিক মিডিয়া) করে। এতে নিজেদের কাটতি বাড়ানোর পাশাপাশি পেশাগত দায়িত্ব পালনের বিষয়টিও সমান গুরুত্ব পায়। ফলে বিশ্ববিদ্যালয়গুলোয় নানা ধরনের ও বহুমাত্রিক একাডেমিক, কারিকুলার ও এক্সট্রাকারিকুলার কা‍র্যক্রম হয়, কিন্তু সেগুলো যতটা গুরুত্ব দিয়ে মিডিয়া প্রকাশ ও প্রচার করে, বিশ্ববিদ্যালয়কেন্দ্রিক বিভিন্ন নেতিবাচক সংবাদ অধিক গুরুত্ব দিয়ে প্রকাশ ও প্রচার করা হয়। তাতে দোষের কিছু নেই। কেননা বিশ্ববিদ্যালয়গুলো, বিশেষ করে পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়গুলো, এ দেশের জনগণের টাকায় চলে। ফলে সেখানে কী হচ্ছে এবং কীভাবে চলছে, সেটা জানার অধিকার এ দেশের জনগণের আছে। তাই মিডিয়া বিশ্ববিদ্যালয়কেন্দ্রিক সংবাদগুলো, বিশেষ করে নেতিবাচক সংবাদগুলো, হাওয়ার বেগে এবং আগে প্রকাশ ও প্রচার করে। তবে বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর জন্য সবচেয়ে বিব্রতকর সংবাদ হচ্ছে যৌন হয়রানি সম্প‍‍র্কিত সংবাদ। এটা একাধারে বিশ্ববিদ্যালয়গুলো সম্প‍‍র্কে সাধারণ মানুষের মনে যেমন একটা নেতিবাচক ইমেজ তৈরি করে, তেমনি সমাজেও এর একটা প্রভাব পড়ে; যার নিকটব‍‍র্তী ও দী‍র্ঘমেয়াদি প্রতিফল কারো জন্যই মঙ্গলজনক নয়। কিন্তু এত কিছুর পরও বিশ্ববিদ্যালয়গুলোয় যৌন হয়রানির ঘটনা বন্ধ হওয়া তো দূরের কথা, এর মাত্রা ও সংখ্যা কোনোভাবেই কমছে না। সম্প্রতি চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে একজন শিক্ষক ক‍র্তৃক একজন শিক্ষা‍র্থীকে যৌন হয়রানির ঘটনা, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে একজন শিক্ষক ক‍র্তৃক শিক্ষা‍র্থীকে যৌন হয়রানির ঘটনা এবং তারও আগে জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ে এক দম্পতিকে ডেকে এনে স্বামীকে আবাসিক হলে আটকে রেখে স্ত্রীকে দলবদ্ধভাবে ধ‍‍র্ষণের ঘটনা সারা দেশে বেশ আলোচিত হয়েছে। এর আগের অসংখ্য ঘটনা আছে যা বিশ্ববিদ্যালয়গুলো যে এখনো নারীদের জন্য পুরোপুরি নিরাপদ নয় সেটা প্রমাণ করার জন্য যথেষ্ট। 

এ রকম একটি প্রেক্ষাপটে বাংলাদেশ মহিলা পরিষদের পক্ষ থেকে বাংলাদেশের বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর অভিভাবক প্রতিষ্ঠান হিসেবে পরিচিত বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরী কমিশনের (ইউজিসি) কাছে ছয় দফা সুপারিশ করা হয়। সুপারিশগুলো হচ্ছে: ১. বিশ্ববিদ্যালয়গুলোয় যৌন হয়রানি এবং নিপীড়নের ঘটনা প্রতিরোধে প্রতিটি অনুষদে যৌন হয়রানি ও নিপীড়ন নিরোধকল্পে কমিটি গঠন করা; ২. প্রতিটি অনুষদের ডিন, অনুষদের প্রতিটি বিভাগের ছাত্রছাত্রী কাউন্সিলর, ছাত্রছাত্রীদের নিয়ে যৌন হয়রানি ও নিপীড়ন প্রতিরোধে নিয়মিত কর্মশালার আয়োজন করা; ৩. ২০০৯ সালের হাইকোর্ট বিভাগ কর্তৃক নির্দেশনামূলক রায়ে যে বিষয়গুলো যৌন হয়রানি ও নিপীড়ন বলে উল্লেখ করা হয়েছে তা বিশ্ববিদ্যালয়ে ছাত্রছাত্রী ভর্তির পর ওরিয়েন্টেশন সভায় আলোচনা করা; ৪. বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকদের চাকরিবিধিতে যৌন হয়রানি ও নিপীড়ন প্রতিরোধে ২০০৯ সালের হাইকোর্ট বিভাগের নির্দেশনার বিষয়টি যুক্ত করা; ৫. বিশ্ববিদ্যালয়ে যৌন হয়রানি ও নিপীড়ন নিরোধকল্পে গঠিত অভিযোগ কমিটির কার্যক্রম গতিশীল করাসহ সুপারিশ বাস্তবায়নে সময়োপযোগী পদক্ষেপ গ্রহণ করা ও ৬. ২০০৯ সালের হাইকোর্ট বিভাগের নির্দেশনামূলক রায়ের আলোকে যৌন হয়রানি ও নিপীড়ন নিরোধকল্পে অভিযোগ কমিটি গঠন এবং কমিটির কার্যক্রম বিষয়ে অংশীজনদের সঙ্গে ইউজিসি কর্তৃক কর্মশালা-প্রশিক্ষণের আয়োজন করা।

বাংলাদেশ মহিলা পরিষদের একটি প্রতিনিধি দল ইউজিসির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যানের সঙ্গে সাক্ষাৎ করে এসব সুপারিশ পেশ করার পাশাপাশি বিশ্ববিদ্যালয়ে যৌন হয়রানি এবং নিপীড়নের ঘটনা প্রতিরোধ ও প্রতিকারে মনিটরিং কার্যক্রম আরো জোরদারসহ যৌন হয়রানি ও নিপীড়নের ঘটনা প্রতিরোধে কার্যকর পদক্ষেপ গ্রহণের জন্য অনুরোধ জানায়। রুটিন ও ন‍‍র্মস অনুযায়ী ইউজিসির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যানও যৌন হয়রানি ও নিপীড়নের ঘটনা প্রতিরোধ ও প্রতিকারে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ ও মনিটরিংয়ের আশ্বাস দেন। প্রথমত, আমি বাংলাদেশ মহিলা পরিষদের এ উদ্যোগের জন্য ধন্যবাদ ও কৃতজ্ঞতা জানাই। দ্বিতীয়ত, আমি এ ছয় দফা সুপারিশকে আন্তরিকভাবে স্বাগত জানাই। তৃতীয়ত, যদি আমরা গভীরভাবে চিন্তা করি, তাহলে এসব সুপারিশের মধ্যে আদৌ নতুন কিছু কি আছে? ২০০৯ সালের হাইকো‍র্টের দেয়া নি‍‍র্দেশনা অনুযায়ী যথাযথভাবে কাজ করলে এবং প্রয়োজনীয় কা‍র্যক্রম গ্রহণ করলে এ সবকিছু আওতাভুক্ত হওয়ার কথা। 

প্রসঙ্গত উল্লেখ্য, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান ও কর্মক্ষেত্রে যৌন হয়রানি ও ক্ষমতার অপব্যবহার প্রতিরোধে ২০০৮ সালে জনস্বার্থে হাইকোর্টে মামলা করেন বাংলাদেশ জাতীয় মহিলা আইনজীবী সমিতির একজন সদস্য, যার পরিপ্রেক্ষিতে বাংলাদেশে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে এবং কর্মক্ষেত্রে যৌন হয়রানি বন্ধে ২০০৯ সালে হাইকোর্টে একটি নির্দেশনা দেয়া হয়। এতে সব ধরনের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান ও কর্মক্ষেত্রে যৌন হয়রানি ও নিপীড়ন প্রতিরোধ কমিটি গঠনের নির্দেশ দেয়া হয়েছে। মাধ্যমিক ও উচ্চ শিক্ষা (মাউশি) অধিদপ্তর শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে যৌন হয়রানি প্রতিরোধে কমিটি গঠনবিষয়ক সর্বশেষ নির্দেশনাপত্র দিয়েছে ২০২২ সালের ডিসেম্বরে। কিন্তু এতে বাংলাদেশের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোয় বিশেষ করে বিশ্ববিদ্যালয়গুলোয় যৌন হয়রানির ঘটনা কি কমেছে? হাইকো‍র্টের নি‍র্দেশনার আলোকে মাউশির নি‍র্দেশনা অনুযায়ী প্রতিটি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে পাঁচ সদস্যবিশিষ্ট একটি কমিটি গঠন করার কথা এবং এ কমিটির বেশির ভাগ সদস্য হবেন নারী অ‍‍র্থাৎ কমপক্ষে তিনজন হবেন নারী সদস্য, যাতে একটা জেন্ডার ব্যালান্স থাকে। কমিটির অন্তত দুজন সদস্য শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের বাইরে থেকে নিয়োগ করতে হবে, যাতে কাজ করার ক্ষেত্রে ন্যায্যতা নিশ্চিত করা যায়। কারণ প্রতিষ্ঠানের ভেতরের সদস্যরা কোনো না কোনোভাবে অভিযুক্তের সঙ্গে সম্প‍‍র্কিত থাকেন। ফলে তদন্ত ও বিচারকা‍র্য প্রভাবিত হওয়ার আশঙ্কা থাকে। এ ধরনের ছোট ছোট বিষয় বিবেচনায় নিয়ে এত সুন্দর একটা ব্যবস্থা থাকার পরও আমরা কি কোনো নগদ ফল পাচ্ছি? বাংলাদেশের বিশ্ববিদ্যালয়গুলোয় কি এসব কমিটি গঠনের পরও যৌন হয়রানির ঘটনা কমেছে? এই কমিটির সুপারিশের পরিপ্রেক্ষিতে যেকোনো যৌন হয়রানির ঘটনায় দুই ধরনের ব্যবস্থা নেয়ার সুযোগ আছে। একটি হচ্ছে প্রাতিষ্ঠানিক ব্যবস্থা এবং অন্যটি আইনি। কোনো কিছু আইনি পর্যায়ে চলে গেলে আইনি ব্যবস্থা নেয়ার পরামর্শ দেয়া আছে। এ রকম একটা ম্যাকানিজম আছে। কিন্তু আমরা কি আদৌ কোনো ঘটনার আইনি ব্যবস্থা নেয়ার কথা জানি? এ রকম একটি প্রেক্ষাপটে বাংলাদেশ মহিলা পরিষদের এ উদ্যোগ ও পরাম‍‍র্শকে সাধুবাদ জানাই। তারা স্বতঃপ্রণোদিত হয়ে এগিয়ে এসেছেন। কিন্তু যে প্রশ্নটি মৌলিক সেটা হচ্ছে বিশ্ববিদ্যালয়ে যৌন হয়রানি বন্ধের জন্য প্রস্তাব নিয়ে কেন বাংলাদেশ মহিলা পরিষদকে এগিয়ে আসতে হবে? বিশ্ববিদ্যালয়ে যৌন হয়রানি বন্ধের দাবি কি কেবলই বাংলাদেশের নারী বা মহিলাদের? বাংলাদেশের পুরুষদের কি কোনো দাবি নেই? বাংলাদেশের পুরুষরা কি চায় না বিশ্ববিদ্যালয়ে যৌন হয়রানি বন্ধ হোক? নাকি যেহেতু বিশ্ববিদ্যালয়ে যৌন হয়রানির বিষয়টি বেশির ভাগ ক্ষেত্রে নারীরা ভিকটিম আর পুরুষরা অপরাধী, সেহেতু পুরুষতান্ত্রিক ও পুরুষাধিপত্যবাদী সমাজের চরিত্র অনুযায়ী অপরাধীরা স্বগোত্রের বলে পুরুষরা বিশ্ববিদ্যালয়ের যৌন নি‍র্যাতনকারীদের যথাযথ শাস্তি হোক, ক্যাম্পাসে যৌন নি‍পীড়নের ঘটনা বন্ধ হোক এবং যৌন নি‍র্যাতনের ঘটনার সুষ্ঠু বিচার হোক, সেটা চান না? আমাদের মনে রাখতে হবে যে যৌন নি‍র্যাতনের শিকার প্রত্যেক নারীই কোনো না কোনোভাবে আমাদের পরিবারের অংশ। আমাদেরই কারো বোন, কারো মেয়ে, কারো মা এবং কারো স্ত্রী। তাই সমাজের যৌন নি‍র্যাতনের ঘটনা রোধ করার জন্য সমাজের নারী-পুরুষ উভয়কে সমানভাবে এগিয়ে আসতে হবে। সমাজে ‘জেন্ডার রোল’ বলে একটা ব্যাপার আছে, যেখানে নারী-পুরুষ উভয়কেই পারস্পরিক সম্মান ও শ্রদ্ধাবোধের জায়গা থেকে নিজ নিজ ভূমিকা পালন করার দ‍‍র্শন আছে। তাই বিশ্ববিদ্যালয়গুলোয় যৌন হয়রানি বন্ধের জন্য সমাজের নারীদের পাশাপাশি পুরুষদেরও সমান সংবেদনশীলতা ও দায়িত্বশীলতা নিয়ে এগিয়ে আসতে হবে। সমাজে নারী-পুরুষের সমম‍‍র্যাদার সহাবস্থান নিশ্চিত করা গেলে যৌন হয়রানির ঘটনা হ্রাস পাবে এবং ক্রমান্বয়ে বন্ধ হবে। আর এর শুরুটা করতে হবে বিশ্ববিদ্যালয়গুলো থেকেই। কেননা বাংলাদেশের বিশ্ববিদ্যালয়গুলোই সমাজকে পথ দেখাবে। 

ড. রাহমান নাসির উদ্দিন: নৃবিজ্ঞানী ও অধ্যাপক, নৃবিজ্ঞান বিভাগ, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়

এই বিভাগের আরও খবর

আরও পড়ুন