মাধ্যমিক ও উচ্চ মাধ্যমিক শিক্ষা নিয়ে বারবার পরীক্ষা-নিরীক্ষা

শিক্ষায় বিরূপ প্রভাব ও আন্তর্জাতিক মান থেকে পিছিয়ে পড়ছে

ছবি : বণিক বার্তা

নানা জল্পনা-কল্পনার পর সম্প্রতি চূড়ান্ত হয়েছে নতুন শিক্ষাক্রমের মূল্যায়ন পদ্ধতি। কিন্তু এ নিয়ে শিক্ষক, শিক্ষার্থী ও অভিভাবক সবাই রয়েছে বিভ্রান্তিতে। মূল্যায়ন পদ্ধতি পুরোপুরি কেউই বুঝে উঠতে পারছেন না, বিশেষ করে বিপাকে পড়েছেন শিক্ষক ও শিক্ষার্থীরা। ফলে একদিকে যেমন শিক্ষায় বিরূপ প্রভাব পড়ছে, তেমনি আন্তর্জাতিক মান থেকে পিছিয়ে যাচ্ছে। 

গত বছর ষষ্ঠ ও সপ্তম শ্রেণীতে এবং এ বছর থেকে অষ্টম ও নবম শ্রেণীতে নতুন শিক্ষাক্রম বাস্তবায়ন করা হয়েছে। ২০২২ সালে প্রাথমিকভাবে শিক্ষার্থীদের যে পদ্ধতিতে মূল্যায়ন করা হয়েছিল, সে পদ্ধতিতে সম্পূর্ণ মূল্যায়ন ছিল শিখনফলনির্ভর। সম্প্রতি অনুমোদনকৃত মূল্যায়ন পদ্ধতিতে লিখিত পরীক্ষার বিষয়টি যোগ করা হয়েছে। মাধ্যমিক ও উচ্চ শিক্ষা অধিদপ্তর (মাউশি) এবং জাতীয় শিক্ষাক্রম ও পাঠ্যপুস্তক বোর্ড (এনসিটিবি) সংশ্লিষ্ট সূত্রের তথ্য অনুযায়ী, এতে লিখিত অংশের জন্য ৬৫ শতাংশ নম্বর এবং কার্যক্রমভিত্তিক অংশে ৩৫ শতাংশ নম্বর নির্ধারণ করা হয়েছে। এছাড়া একটি বিষয়ের মূল্যায়নে পরীক্ষা হবে সর্বোচ্চ ৫ ঘণ্টা। এক্ষেত্রে প্রশ্নভিত্তিক মূল্যায়ন হবে তিনটি নির্দেশকে—‘চেষ্টা’, ‘আংশিক’ ও ‘কার্যকরী’। 

তিনটি নির্দেশকে লিখিত পরীক্ষার প্রশ্ন বা কাজের উত্তর মূল্যায়নের পাশাপাশি তাদের শ্রেণীকক্ষের ধারাবাহিক ও আচরণগত মূল্যায়ন মিলিয়ে ‘নৈপুণ্য’ অ্যাপ থেকে সাত স্কেলে বা গ্রেডে শিক্ষার্থীদের প্রতিটি বিষয়ের সামষ্টিক মূল্যায়ন হবে। এগুলো হলো অনন্য, অর্জনমুখী, অগ্রগামী, সক্রিয়, অনুসন্ধানী, বিকাশমান ও প্রারম্ভিক। এক্ষেত্রে ‘প্রারম্ভিক’ সবচেয়ে নিচের স্তরের নাম এবং যে সবচেয়ে ভালো করবে সে পাবে ‘অনন্য’। এরই মধ্যে এ মূল্যায়ন পদ্ধতিতে দেশের মাধ্যমিক বিদ্যালয়গুলোয় পরীক্ষা গ্রহণ শুরু হয়েছে।

এভাবে বছর বছর মূল্যায়ন পদ্ধতির পরিবর্তনে বেগ পেতে হচ্ছে শিক্ষক ও শিক্ষার্থীদের। যার নেতিবচাক প্রভাব পড়ছে শিক্ষা ক্ষেত্রে। এছাড়া আশঙ্কা করা হচ্ছে, এ পদ্ধতিতে ভবিষ্যতে স্কলারশিপ পেতে অসুবিধায় পড়বে বিদেশ যেতে ইচ্ছুক শিক্ষার্থীরা। কেননা অনেক দেশে শিক্ষার্থী কত শতাংশ নম্বর পেয়েছে তার ওপর নির্ভর করে স্কলারশিপ দেয়া হয়। সেক্ষেত্রে শিক্ষার্থীর গ্রেড মূল্যায়ন কীভাবে হবে তা নিয়ে উদ্বেগ রয়েছে। আন্তর্জাতিক মানের প্রশ্নটি এক্ষেত্রে অতি গুরুত্বপূর্ণ। 

উপরন্তু বণিক বার্তার প্রতিবেদন থেকে জানা গেছে, এ পদ্ধতির নম্বর বণ্টনসহ আনুষঙ্গিক অনেক বিষয়ে স্পষ্ট ধারণা নেই শিক্ষক, শিক্ষার্থী ও অভিভাবকদের। নতুন মূল্যায়ন পদ্ধতির বিষয়ে শিক্ষকদের প্রশিক্ষণের ঘাটতি রয়েছে। ‘নৈপুণ্য’ অ্যাপ ব্যবহার করতে গিয়েও জটিলতার মুখোমুখি হচ্ছেন শিক্ষকরা। শিক্ষকদের ভেতরে অস্পষ্টতা থাকায় শিক্ষার্থীরাও এ বিষয়ে পূর্ণ ধারণা পায়নি। যদিও এ পদ্ধতিতে পরীক্ষা শুরু হয়েছে। তাছাড়া পরীক্ষার একদিন আগে মূল্যায়ন পদ্ধতি দেয়ার ফলে এত স্বল্প সময়ে শিক্ষক-শিক্ষার্থীদের জন্য প্রস্তুতি গ্রহণ অত্যন্ত কঠিন হয়ে উঠেছে। শিক্ষক-শিক্ষার্থীর মধ্যে পূর্ণ জ্ঞানের অভাবে ধোঁয়াশায় রয়েছেন অভিভাবকরাও।

সহজেই অনুমেয়, উদ্ভূত এ পরিস্থিতি এড়ানো যেত যদি মূল্যায়ন পদ্ধতি চূড়ান্ত অনুমোদন দেয়ার আগেই শিক্ষকদের প্রয়োজনীয় প্রশিক্ষণ প্রদান করা হতো। শিক্ষকরা যদি এ বিষয়ে পরিপূর্ণ ধারণা রাখতেন তাহলে শিক্ষার্থী ও অভিভাবকদের বিভ্রান্তি দূর করাও সহজ হতো। মূল্যায়ন সম্পর্কিত অস্পষ্টতা দূরীকরণে তাই শিক্ষকদের প্রয়োজনীয় প্রশিক্ষণ প্রদান করা অত্যন্ত জরুরি। একই সঙ্গে শিক্ষার্থী ও অভিভাবকদের বিভ্রান্তি দূর করতে বিদ্যালয় পর্যায়ে এ-সংক্রান্ত সভা আয়োজন করা যেতে পারে।

নতুন শিক্ষাক্রমে মূল্যায়ন কাঠামো চূড়ান্ত করতে শিক্ষা মন্ত্রণালয় বেশ গড়িমসি করেছে। একের পর এক খসড়া প্রণয়ন ও সংশোধন করা হয়। বলা বাহুল্য, কালক্ষেপণ ও সিদ্ধান্তহীনতায় সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে শিক্ষার্থীরা। নতুন মূল্যায়নে গ্রেডিং পদ্ধতি বাতিল করা হয়েছে। মাধ্যমিকে গ্রেডিং সিস্টেমে পরিবর্তনের আগে বলা হয়েছিল এর মাধ্যমে শিক্ষার্থীদের ওপর এ প্লাস কিংবা শতভাগ নম্বর পাওয়ার চাপ কমবে। তবে বিভিন্ন বিদ্যালয়ের চিত্র বলছে, প্রকৃতপক্ষে এ চাপ কমেনি; কেবল এ প্লাসের জায়গা করে নিয়েছে অনন্য। অর্থাৎ এক ধরনের অস্থিতিশীল পরিবেশ তৈরি হয়েছে নতুন শিক্ষাক্রমের মূল্যায়ন পদ্ধতি ঘিরে। 

শিক্ষাবিদদের মতে, মূল্যায়ন পদ্ধতি নিয়ে বিভ্রান্তি দূর করতে পারলে নতুন শিক্ষাক্রমের মাধ্যমে শিক্ষার্থীরা উপকৃত হবে। তবে এজন্য প্রয়োজন শিক্ষকদের প্রয়োজনীয় প্রশিক্ষণ দেয়ার ব্যবস্থা করা। কেননা পাঠদান থেকে মূল্যায়ন সবকিছু শিক্ষকরাই করে থাকেন। প্রশিক্ষিত শিক্ষক ছাড়া কোনো পাঠ্যক্রম বাস্তবায়ন করা বেশ কঠিন।

দেশের পুরনো শিক্ষাক্রমটি ছিল ধারণাভিত্তিক। এক্ষেত্রে লিখিত পরীক্ষাই ছিল একমাত্র মূল্যায়নের কৌশল। কিন্তু নতুন শিক্ষাক্রম করা হয়েছে দক্ষতাভিত্তিক। স্বাভাবিকভাবেই দক্ষতা কেবল লিখিত পরীক্ষার মাধ্যমে যাচাই করা সম্ভব নয়। বরং এজন্য প্রয়োজন বিভিন্ন কৌশল, যার ছাপ পাওয়া যাচ্ছে নতুন শিক্ষাক্রম ও এর মূল্যায়ন পদ্ধতিতে। 

দেশের শিক্ষা ব্যবস্থাকে যুগোপযোগী ও আধুনিক করে গড়ে তুলতে ‘জাতীয় শিক্ষাক্রম রূপরেখা ২০২১: প্রাক-প্রাথমিক থেকে দ্বাদশ শ্রেণী’ প্রণয়ন করা হয়। এ রূপরেখার ভিশন এমন একটি প্রজন্ম তৈরি করা, যারা জাতীয় ইতিহাস, ঐতিহ্য, মূল্যবোধ ও সংস্কৃতি ধারণ করে পরিবর্তনের সঙ্গে খাপ খাইয়ে নিজেকে সৃজনশীল, উৎপাদনমুখী, সুখী ও বৈশ্বিক নাগরিক হিসেবে প্রতিষ্ঠা করতে পারবে। যার আলোকে ২০২৩ ও ২০২৪ সাল থেকে নতুন শিক্ষাক্রম বাস্তবায়নের উদ্যোগ নিয়েছে সরকার। যে শিক্ষাক্রমের অভিলক্ষ—‘প্রত্যেক শিক্ষার্থীর অন্তর্নিহিত সম্ভাবনা বিকাশে নমনীয় ও কার্যকর শিক্ষাক্রম প্রস্তুত; সংবেদনশীল, দায়িত্বশীল, জবাবদিহিমূলক ও অংশগ্রহণমূলক শিক্ষা ব্যবস্থা প্রণয়ন; শিক্ষার সব পর্যায়ে দক্ষ, পেশাদার ও সংবেদনশীল, দায়িত্বশীল ও স্বতঃপ্রণোদিত জনশক্তি নিশ্চিত; শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানকে শিক্ষার্থীর অন্তর্নিহিত সম্ভাবনার বিকাশ ও উৎকর্ষের কেন্দ্রবিন্দুতে পরিণত এবং প্রাতিষ্ঠানিক পরিবেশের বাইরে ও বহুমাত্রিক শিখনের সুযোগ ও স্বীকৃতি প্রদান করা।’ আর এ অভিলক্ষ্য তখনই পূরণ সম্ভব যখন দেশের শিক্ষা ব্যবস্থা হবে ‍সৃজনশীলতা বিকাশে সহায়ক ও অভিজ্ঞতানির্ভর। 

স্বাভাবিক নিয়মে যেকোনো বিষয়ের শুরুতে খাপ খাওয়ানো নিয়ে এক ধরনের জটিলতা তৈরি হয়। সময়ের পরিক্রমায় নতুন নিয়ম নিয়ে অস্পষ্টতা দূর হয়ে যায়। তবে এজন্য প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ গ্রহণ করতে হয়। নতুন শিক্ষাক্রমকে কার্যকরী করতে হলে শিক্ষকদের দক্ষতা বৃদ্ধির বিকল্প নেই। একই সঙ্গে শিক্ষা মন্ত্রণালয়েরও সিদ্ধান্ত নেয়ার বিষয়ে আরো সচেতন হওয়া প্রয়োজন। যেকোনো নতুন পদ্ধতি চালু করার আগে শিক্ষকদের সে বিষয়ে দক্ষতা নিশ্চিত করা উচিত।

এই বিভাগের আরও খবর

আরও পড়ুন