কেন্দ্রীয় ব্যাংকের উচিত নগদ অর্থসহায়তা দিয়ে ব্যাংকগুলো পুনর্গঠনের সুযোগ করে দেয়া

ছবি : বণিক বার্তা

আবদুল আউয়াল মিন্টু ,দেশের শীর্ষস্থানীয় ব্যবসায়ী ও উদ্যোক্তা। ১৯৯৮-২০০০ এবং ২০০৩-০৫ মেয়াদের জন্য বাংলাদেশ শিল্প ও বণিক সমিতির (এফবিসিসিআই) নির্বাচিত সভাপতির দায়িত্ব পালন করেন। রেস্তোরাঁ, ব্যাংক-বীমা, শিপিং, সিমেন্ট, বীজ, আধুনিক বিভিন্ন উৎপাদন শিল্প ও বিপণন ব্যবসার সঙ্গে যুক্ত হয়ে প্রভূত সাফল্য অর্জন করেন। তার উল্লেখযোগ্য রচনাবলির মধ্যে আছে বাংলাদেশ: পরিবর্তনের রেখাচিত্র, বাংলাদেশ: রাজনীতি ও রাজনৈতিক অর্থনীতি। তার রচিত বাংলাদেশ: অ্যানাটমি অব চেঞ্জ লন্ডনের বিখ্যাত প্রকাশনা অ্যাথেনা প্রেস থেকেও প্রকাশিত হয়েছে ও আন্তর্জাতিক পাঠক মহলে সমাদৃত হয়েছে। সম্প্রতি বণিক বার্তায় কথা বলেন তিনি। সাক্ষাৎকার নিয়েছেন বদরুল আলম

দেশের অর্থনীতিতে স্বাভাবিক পরিস্থিতি ফিরিয়ে আনতে এবং অর্থনীতির অগ্রগতি ত্বরান্বিত করতে নতুন সরকারের করণীয় কী?

প্রথমত, ব্যাংক খাত ঠিক করতে হবে। বেশির ভাগ অভিযোগ আসছে যে ব্যাংক থেকে কেউই সহযোগিতা পাচ্ছেন না। আমি নিজেই দেখছি, অধিকাংশ ব্যাংকে নগদ অর্থের সংকট রয়েছে। স্বাভাবিক নিয়মে একটি সাধারণ ব্যাংকে যখন প্রতিদিনের লেনদেনের জন্য নগদ অর্থের ঘাটতি দেখা দেয়, তখন সে ব্যাংক কল মার্কেট তথা অন্য কোনো ব্যাংক থেকে অর্থ ঋণ নেয়। কিন্তু কল মার্কেট থেকে ঋণ না পেলে তখন কেন্দ্রীয় ব্যাংক থেকে এ ঋণ নেয়া হয়। কেন্দ্রীয় ব্যাংক আমাকে বা আপনাকে ঋণ দেয় না। প্রতিষ্ঠানটি কেবল ব্যাংককেই ঋণ দেয়। কিন্তু সম্প্রতি এ ব্যাংক সিদ্ধান্ত নিয়েছে যে তারা আর কোনো ব্যাংকে নগদ অর্থসহায়তা দেবে না। 

কেন্দ্রীয় ব্যাংক নগদ অর্থসহায়তা না দেয় তাহলে যেসব ব্যাংকে নগদ অর্থের অভাব রয়েছে তারা কীভাবে চলবে? সেসব ব্যাংকের ব্যবসায়ী ও উৎপাদনশীল কর্মকাণ্ডের সঙ্গে জড়িত গ্রাহকদের কী হবে? ব্যাংকগুলোয় তারল্য সংকট কেন তৈরি হয়েছে তা তো কেন্দ্রীয় ব্যাংকের অজানা নয়। গুটিকয়েক ব্যক্তি ব্যাংকের টাকা আত্মসাৎ করেছে। আর কেন্দ্রীয় ব্যাংক এ বিষয়ে সবকিছুই জানত। জানা সত্ত্বেও বরং কেন্দ্রীয় ব্যাংক কিছু ক্ষেত্রে ওই ব্যক্তিদের সহযোগী ‍হিসেবে কাজ করেছে। এ পরিস্থিতিতে হয় নগদ সহায়তা দিতে হবে কিংবা তারল্য সংকটে থাকা ব্যাংক বন্ধ করে দিতে হবে। নয়তো ওই সব ব্যাংকের গ্রাহকরা সমস্যায় পড়বে। সংকটে থাকা বেশির ভাগ ব্যাংক দেশের বড় ব্যাংক। ফলে তাদের গ্রাহকসংখ্যাও বড়। 

ব্যাংক দুর্নীতি একদিনে দূর করা যাবে না। বর্তমানে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের উচিত নগদ অর্থসহায়তা দিয়ে ব্যাংকগুলো পুনর্গঠনের সুযোগ করে দেয়া। ব্যাংকগুলো যেন ঠিকভাবে কার্যক্রম পরিচালনা করতে পারে ও গ্রাহক চাহিদা মেটাতে সক্ষম হয় সেটি নিশ্চিত করতে হবে।

দ্বিতীয়ত, কেন্দ্রীয় ব্যাংক সংকোচনমূলক মুদ্রানীতি প্রণয়ন করেছে। কিন্তু নিত্যদিনের খবর দেখলে মনে হয় এ মুদ্রানীতি কেবল বেসরকারি খাতের জন্য প্রযোজ্য, সরকারের জন্য নয়; সরকারের জন্য অবারিত মুদ্রানীতি। কেন্দ্রীয় ব্যাংককে এ ধরনের দ্বিমুখী নীতির প্রচলন বন্ধ করতে হবে। কেন্দ্রীয় ব্যাংককে তার নীতিতে অটল থাকতে হবে। নয়তো তার হাতে উচ্চ মূল্যস্ফীতি কমানোর একটি উপায়ই অবশিষ্ট থাকবে আর তা হলো সুদহার বাড়ানো। একদিকে ঋণ দেবে না, অন্যদিকে সুদহার বাড়বে, এ অবস্থায় বেসরকারি খাতে আরো চাপ বাড়বে।

সম্প্রতি কেন্দ্রীয় ব্যাংকে বড় ধরনের পরিবর্তন ঘটেছে। নেতৃত্বে রদবদল হয়েছে। একদিনে সবকিছু করে ফেলা যাবে না তা আমি স্বীকার করি। তার পরও কেন্দ্রীয় ব্যাংককে সমন্বিতভাবে কিছু তাৎক্ষণিক সিদ্ধান্ত নিতে হবে ব্যাংকগুলোকে কীভাবে চালু যায়, সে বিষয়ে। যে নীতির ওপর কেন্দ্রীয় ব্যাংক প্রতিষ্ঠিত, সে নীতিতে অটল থেকে দেশের ব্যাংক খাতকে এগিয়ে নিতে সাহায্য-সহযোগিতা করতে হবে।

তৃতীয়ত, আমাদের উদ্বৃত্ত বিদ্যুৎ উৎপাদন হয়। কিন্তু লোডশেডিংও হয়। এ ধরনের গরমিল ঠিক করতে হবে। 

চতুর্থত, আমাদের শত শত ফ্যাক্টরির ক্যাপটিভ পাওয়ার আছে। কিন্তু ক্যাপটিভ পাওয়ারের জন্য আমরা কোনো জ্বালানি কিনি না। সেগুলো সরকারই কেনে। ডলার বিনিময় হার যখন ১২২ টাকা ছিল, তখন সরকার জ্বালানি আমদানি ব্যয়ের পরিপ্রেক্ষিতে যে দাম নির্ধারণ করেছিল, ডলারের দাম কমার পরও জ্বালানির ক্ষেত্রে ওই একই দাম বজায় থাকল। ফলে আমাদের যে ক্যাপ্টিভ পাওয়ার আছে সেগুলো এখন আর লাভজনক অবস্থায় নেই। ওই দামে জ্বালানি কিনে যদি আমরা ক্যাপটিভ প্লান্টগুলো চালু করি এতে আমাদের উৎপাদন ব্যয় বেড়ে যাবে। সরকার ইচ্ছা করে একচেটিয়া ব্যবস্থাপনায় বেশি দাম রাখবে, এটি হতে পারে না। জ্বালানির দাম ওঠানামা করুক, আপত্তি নেই। কিন্তু সেটি হতে হবে আন্তর্জাতিক বাজারের সঙ্গে সমন্বয় করে। সরকারি ব্যক্তিরা অর্থ লোপাট করবে, অপচয় করবে, সিস্টেম লস দেখাবে, অন্যদিকে সাধারণ জনগণ, উৎপাদনকারীরা বাড়তি দাম দেবে এটি হতে পারে না। এক্ষেত্রে সবার আগে তেল-গ্যাসের নিরবচ্ছিন্ন সরবরাহ নিশ্চিত করতে হবে। দ্বিতীয়ত দাম কমানো লাগবে না, কিন্তু ন্যায্য দাম নির্ধারণ করতে হবে যাতে উৎপাদন খরচ কমানো যায়। সর্বশেষ, আইন-শৃঙ্খলা পরিস্থিতি শক্ত হাতে নিয়ন্ত্রণ করতে হবে। কারণ বর্তমান পরিবেশ বিনিয়োগ ও ফ্যাক্টরি চালু রাখার উপযোগী নয়। রফতানি বাড়াতে হলে কারখানাগুলো পুরোদমে চালু রাখতে হবে। সেজন্য ঋণপ্রবাহ ও আমদানি সরবরাহ ঠিক রাখতে হবে। উৎপাদন খরচ না কমানো গেলে মূল্যস্ফীতিও কমবে না। সুদহার বাড়ানো হলে এমনিতেও উৎপাদন খরচ বেড়ে যাবে। আবার কাঁচামাল না আনতে পারলেও উৎপাদন খরচ বাড়বে। সুতরাং উৎপাদন খরচ কমাতে হবে। এছাড়া রিজার্ভের সঙ্গে সংগতি রেখে ডলারের মান অবমূল্যায়ন করতে হবে। ঠিকমতো অবমূল্যায়ন করা না হলে আমদানি সস্তা হবে, এতে চাহিদা বেড়ে যাবে। অন্যদিকে রফতানি ব্যয়বহুল হয়ে দাঁড়াবে। আপনার হয়তো পাওয়ার কথা ছিল ১১০ টাকা, আপনি পাবেন ১০৫ টাকা। রফতানি করে যদি আয় বেশি না পাওয়া যায় তাহলে তো হবে না। আপনাকে নিয়মিত কর্মীদের বেতন-মজুরি বাড়াতে হবে। সবশেষ গুরুত্বপূর্ণ বলে মনে করি, আইন-শৃঙ্খলা পরিস্থিতির উন্নয়ন। এটা ঠিক করতে না পারলে কিন্তু কিছুই হবে না। 

আমাদের অর্থনীতি যারা নিয়ন্ত্রণ করেন, তারা বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই প্রবীণ। এক্ষেত্রে তারুণ্যের গুরুত্ব কতটুকু বা তারুণ্যের সমন্বয়টা কীভাবে ঘটানো যেতে পারে? 

অর্থনীতি এবং রাজনীতি—দুটি বিষয়কে যদি আলাদা করে দেখা হয় সেক্ষেত্রে প্রশ্নটি প্রযোজ্য। আর যদি অর্থনীতি ও রাজনীতি একে অন্যের সম্পূরক এবং পরিপূরক হিসেবে বিবেচনা করা হয়, সেক্ষেত্রে এ প্রশ্নের উত্তর দেয়া খুব কঠিন। প্রকৃতপক্ষে রাজনীতিই অর্থনীতিকে নিয়ন্ত্রণ করে। আর যারা রাজনীতি ও অর্থনীতি নিয়ন্ত্রণ করেন, তারা যদি অভিজ্ঞ না হন, সে হোক তরুণ বা প্রবীণ, ফলাফল একই। যেকোনোভাবেই রাজনীতির পথে চলতে গিয়ে ‘বিচার-বিবেচনার রাজনীতি চর্চা করতে হবে। বিচার-বিবেচনার রাজনীতিতে তর্ক-বিতর্ক, আলোচনা-সমালোচনার মধ্য দিয়ে একটা সুচিন্তিত সিদ্ধান্ত নেয়া যায়। যেই সিদ্ধান্ত রাষ্ট্রের উৎপাদন ব্যবস্থাকেও সাহায্য করবে, আবার সমাজে শান্তি-শৃঙ্খলা বজায় রাখতেও সাহায্য করবে। এক্ষেত্রে তরুণও থাকতে পারে, প্রবীণও থাকতে পারে। এ প্রক্রিয়ায় সব সদস্য তরুণ হলেও যেমন ব্যাঘাত ঘটবে, আবার সব সদস্য প্রবীণ হলেও ব্যাঘাত ঘটবে। তরুণ ও প্রবীণদের সমন্বয় থাকতে হবে।  

আমরা দেখতে পাচ্ছি যে রাজনৈতিক পরিবর্তন আসার পর বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান ও সংগঠনে কর্মকর্তাদের জোরপূর্বক পদত্যাগ করানো হচ্ছে। বিষয়টিকে আপনি কীভাবে দেখছেন? 

এটা অবশ্যই সঠিক পন্থা না। সব সংগঠনে এ রকম সমস্যা না থাকলেও বেশির ভাগ সংগঠনেই আছে। এর পেছনে মূল কারণ হলো যে গত দশ-বারো বছরে শুধু সরকারি, সাংবিধানিক অথবা রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠানগুলোকেই নয়, বরং বিভিন্ন বেসরকারি, এমনকি সাংস্কৃতিক প্রতিষ্ঠানগুলোকেও দলীয়করণ করা হয়েছে। হঠাৎ রাজনৈতিক পটভূমিতে ক্ষমতার পালাবদলের ফলে এসব প্রতিষ্ঠানে বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি হওয়া অসম্ভব কিছু না। তবে আমরা চেষ্টা করছি যাতে শৃঙ্খলা ফিরিয়ে আনা যায়। এ ব্যাপারে আমরা মিটিংও করেছি, যেখানে আমরা বলেছি যে বর্তমান পরিস্থিতিতে এসব প্রতিষ্ঠানের কেউ ব্যক্তিগতভাবে বিএনপি, আওয়ামী লীগ বা জামায়তের রাজনীতি করে সেটা মুখ্য বিষয় না। যে যেই দলের রাজনীতিবিদই হোক না কেন, সংগঠনের প্রতি তার দায়িত্ব ও কর্তব্য অবশ্যই যথাযথভাবে পালন করতে হবে।

এই বিভাগের আরও খবর

আরও পড়ুন