প্রকৃতিবিরুদ্ধ নির্মাণকাজের ফল

বন্যা ও পাহাড়ধসে ক্ষতিগ্রস্ত দোহাজারী-কক্সবাজার রেলপথ

সুজিত সাহা I চট্টগ্রাম ব্যুরো

বন্যা ও ভারি বৃষ্টির প্রভাবে সম্প্রতি একাধিক পাহাড়ধসের ঘটনা ঘটে কক্সবাজারে। পাহাড়ধসের কারণে মাটিতে ভরে যায় দোহাজারী-কক্সবাজার রেলপথের অনেক স্থান ছবি: নিজস্ব আলোকচিত্রী

নির্মাণ কাজ শেষ না হলেও ২০২৩ সালের ডিসেম্বরে সীমিত আকারে চালু হয় দোহাজারী-কক্সবাজার রেলপথ। পরপর দুই বছর ভারি বৃষ্টিতে কয়েক দফা বন্যা ও পাহাড়ধসে রেলপথটি ক্রমে ঝুঁকিপূর্ণ হয়ে উঠেছে। বিশেষজ্ঞরা জানান, প্রকৃতিবিরুদ্ধ রেলপথ নির্মাণকাজের প্রভাব পড়তে শুরু করেছে।

২০২৩ সালের আগস্টে টানা বৃষ্টি ও পাহাড়ি ঢলে ক্ষতিগ্রস্ত হয় নির্মাণাধীন চট্টগ্রাম-কক্সবাজার রেললাইনের বিভিন্ন অংশ। সাতকানিয়ার কেঁওচিয়া তেমুহনী এলাকায় পাথর ও মাটি সরে যাওয়ায় ৪৫০ মিটার ডেবে যায়। স্থানীয় বাসিন্দারা দাবি করেছিল, রেলপথ নির্মাণের ফলে ওই অঞ্চলে স্মরণকালের ভয়াবহ বন্যা হয়েছিল। স্থানীয়দের পাশাপাশি রেলপথসংশ্লিষ্ট ও বিশেষজ্ঞরাও দাবি করেছিলেন, অপরিকল্পিতভাবে রেললাইন নির্মাণের ফলে দীর্ঘমেয়াদি বন্যা হতে পারে। ওই বন্যার পর রেলওয়ে নকশা পরিবর্তন করে আরো বেশকিছু বাড়তি কালভার্ট ও সেতু নির্মাণ করে। চলতি মৌসুমে রেললাইনকে ঘিরে বন্যা বা জলাবদ্ধতা না হলেও নতুন সংকট হিসেবে হাজির হয়েছে পাহাড়ধস। চুনতি অভয়ারণ্যের ওপর দিয়ে তৈরি রেললাইনের বিভিন্ন অংশে পাহাড় ধসে রেললাইনের ওপর পড়ার একাধিক ঘটনা ঘটেছে। নতুন এ সংকট কক্সবাজার রেললাইনকে ঘিরে ঝুঁকি তৈরি করেছে বলে জানিয়েছেন রেলওয়ে কর্মকর্তারা।

রেলওয়ে সূত্রে জানা গেছে, গত ২২ আগস্ট দেশব্যাপী ভারি বৃষ্টিপাতের ফলে পূর্বাঞ্চলের দোহাজারী-কক্সবাজার রেলপথে পাহাড়ধসের ঘটনা ঘটে। নিরাপত্তার স্বার্থে বেশ কয়েক দিন কক্সবাজারগামী ট্রেন সার্ভিস বন্ধ রাখা হয়। মাটি সরিয়ে কয়েক দিন পর সার্ভিস চালু হলেও গতকাল দুপুরে ফের পাহাড়ধসের ঘটনা ঘটে। চুনতি অভয়ারণ্য এলাকায় বারবার পাহাড়ধসে রেলপথ ঝুঁকিপূর্ণ হয়ে ওঠায় প্রকল্পের নির্মাণকাজ নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে। মূলত অনিয়ন্ত্রিত ও অবৈজ্ঞানিকভাবে পাহাড় কেটে রেলপথ নির্মাণ, রেলপথের ওপর পর্যাপ্ত কালভার্ট-ব্রিজ নির্মাণ না করা, পাহাড়সংলগ্ন রেললাইনের পাশে অপর্যাপ্ত রিটেনিং ওয়াল নির্মাণ, কেটে ফেলা পাহাড়কে স্বরূপে ফিরিয়ে আনতে ব্যবস্থা না নেয়ায় একের পর এক ধসের ঘটনা ঘটছে। তাছাড়া পরিবেশ অধিদপ্তরের নিষেধাজ্ঞা সত্ত্বেও পাহাড় কেটে রেলপথের মাটি ব্যবহারের ফলেও ওই এলাকায় রেললাইন ঝুঁকিপূর্ণ হয়ে পড়েছে।

খাতসংশ্লিষ্টরা জানান, এমনিতে লোহাগাড়া উপজেলার বিভিন্ন এলাকা থেকে পাহাড় কেটে ওই মাটি রেললাইনের বাঁধ নির্মাণে ব্যবহার করা হয়েছে। এতে পুরো এলাকার বিভিন্ন স্থানে বর্ষা মৌসুমে পাহাড়ধসের ঘটনা বাড়ছে। বৃষ্টিতে পাহাড় ভেঙে প্রাকৃতিক ছড়া, খালগুলোর গতিপথও পরিবর্তন হয়ে গেছে। এতে সংশ্লিষ্ট এলাকাটিতে যে ধরনের কালভার্ট কিংবা ব্রিজ নির্মাণ করা হয়েছে সেখান দিয়ে পানি যাচ্ছে না। মূলত লোগাহাড়ার চুনতি অভয়ারণ্যের আজিজনগর এলাকার প্রায় ৪০০ মিটার এলাকার উভয় পাশে পাহাড় কাটা থাকায় বৃষ্টিতে ভেঙে রেলপথে প্রতিবন্ধকতা তৈরি করছে। ওই এলাকায় সীমিত আকারে সাইডিং ওয়াল নির্মাণ করা হলেও সেগুলো ছিল অপর্যাপ্ত। সাম্প্রতিক পাহাড়ধসের ঘটনায় সাইডিং ওয়ালগুলো ভেঙে পাহাড় ধসে মাটির নিচে চাপা পড়ে যায়। বর্তমানে রেলওয়ের নির্দেশনায় ওই এলাকায় নতুন করে উঁচু সাইডিং ওয়াল নির্মাণের পরিকল্পনা করছে ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান।

স্থানীয়রা জানান, পাহাড়ি ভূমির সঙ্গে সমন্বয় করে তৈরি করা হয়েছে চট্টগ্রাম-কক্সবাজার মহাসড়ক। এ কারণে চট্টগ্রাম-কক্সবাজার এলাকায় অতিবৃষ্টি কিংবা বন্যায় মহাসড়কে উল্লেখযোগ্য কোনো ক্ষতি বা স্থায়ী জলাবদ্ধতা হয়নি। এমনকি মহাসড়কে বন্যা বা জলাবদ্ধতার কারণও হয়ে দাঁড়ায়নি। কিন্তু দোহাজারী-কক্সবাজার রেলপথ নির্মাণে পাহাড়ি ভূমির সঙ্গে রেলপথের সমন্বয়ের অসামঞ্জস্যতায় সাম্প্রতিক সময়ে বন্যা ও পাহাড়ধসের ঘটনা বাড়ছে। মহাসড়কের চেয়ে রেলপথের মাটির সড়কবাঁধ উঁচু হওয়ায় দ্রুত পানি সরতে পারছে না বিভিন্ন এলাকায়। অপর্যাপ্ত কালভার্ট, পাহাড়ি এলাকায় রেলপথ নির্মাণের সময় প্রাকৃতিক ছড়া বা পানিপ্রবাহের পথগুলো বাধাগ্রস্ত হওয়ায় ধস ও রেলপথে পানি জমে যাওয়ার ঘটনা ঘটছে।

সম্প্রতি দুই দফায় পাহাড়ধসের ঘটনায় প্রকল্প কর্তৃপক্ষকে দুর্ঘটনাস্থলে শক্তিশালী গাইড ওয়াল বা প্রটেকশন ওয়াল নির্মাণের নির্দেশনা দেয়া হয়েছে। এর পরিপ্রেক্ষিতে ওই এলাকায় প্রায় ১০০ মিটার অংশে (৭৭/৫৭ কিলোমিটার) তিন-চার ফুট উঁচু ওয়াল নির্মাণের কাজ শুরু করেছে ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান তমা কনস্ট্রাকশন লিমিটেড। এছাড়া ওই এলাকার প্রায় ৪০০ মিটার অংশে কেটে ফেলা পাহাড়ে জিও টেকনোলজি ব্যবহার করে বিশেষায়িত ঘাস লাগিয়ে পাহাড়ধস প্রতিরোধে ব্যবস্থা নেয়া হবে। প্রকল্পের মেয়াদ আরো এক মাস বাড়ানোয় আগামী অক্টোবরের মধ্যে প্রকল্পের মূল বাজেট থেকে এসব কার্যক্রম বাস্তবায়ন করে ভবিষ্যতে রেলপথে পাহাড়ধস ও জলাবদ্ধতা প্রতিরোধে ব্যবস্থা নেবে বলে জানিয়েছে ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান ও প্রকল্প কর্মকর্তারা।

রেলওয়ে-সংশ্লিষ্টরা জানান, প্রকল্পটি বাস্তবায়নের আগে পাহাড়ি এলাকার মাটি ও জীববৈচিত্র্য নিয়ে ডিটেইল সমীক্ষা করা হয়নি। তাছাড়া সমীক্ষায় ওই অঞ্চলের পাহাড়ি মাটির গুণগত মান, ভঙ্গুরতা কিংবা পানিপ্রবাহের গতিপথ নিয়ে পর্যাপ্ত স্টাডি না থাকায় প্রকল্প বাস্তবায়নের দ্বারপ্রান্তে এসে নানা ত্রুটি-বিচ্যুতি উঠে আসছে। রেলপথের উভয় পাশে অনিয়ন্ত্রিতভাবে পাহাড় কাটার পাশাপাশি রেলট্র্যাক বাঁধ নির্মাণের প্রয়োজনে আশপাশ এলাকার পাহাড় কেটে মাটি ব্যবহার হওয়ায় প্রাকৃতিক পানিপ্রবাহের পথগুলোয় প্রতিবন্ধকতা তৈরি হয়েছে। এ কারণে প্রতিরোধক দেয়াল নির্মাণের পরও পাহাড়ধস ও জলাবদ্ধতার ঘটনা বাড়বে বলে মনে করছেন তারা। মূলত রেলপথের উভয় পাশের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট কালভার্ট ও ব্রিজের পানি প্রবেশের ক্যাচমেন্ট এরিয়ার অসামঞ্জস্যতায় জলাবদ্ধতা, বন্যা ও পাহাড়ধস হচ্ছে বলে দাবি তাদের।

জানতে চাইলে তমা কনস্ট্রাকশন অ্যান্ড কোম্পানি লিমিটেডের প্রকল্প পরিচালক বিমল সাহা বণিক বার্তাকে বলেন, ‘দোহাজারী থেকে চকরিয়া পর্যন্ত বেশকিছু এলাকায় পাহাড়ি ভূমির ওপর রেলপথ নির্মাণ করা হয়েছে। প্রকল্পের কাজ এখনো শেষ না হওয়ায় বর্ষা মৌসুমে বেশকিছু সমস্যা দেখা দিয়েছে। সাম্প্রতিক পাহাড়ধস, জলাবদ্ধতার ঘটনায় বিশেষজ্ঞদের নিয়ে পাহাড়ধস ঠেকাতে ব্যবস্থা নেয়া হয়েছে। দুই পাশে উঁচু দেয়াল নির্মাণের পাশাপাশি পাহাড়গুলোয় ঘাস লাগানো হবে। প্রকল্পের কাজ শেষ হলেও মেরামত পিরিয়ডের মধ্যেই কাজগুলো শেষ করা হবে বলে জানিয়েছেন তিনি।

দোহাজারী-কক্সবাজার রেলপথ নির্মাণের জন্য ২০১৩-১৪ সালে পরিবেশগত প্রভাব মূল্যায়ন সমীক্ষা (ইআইএ) করা হয়। সমীক্ষার জন্য স্থানীয় প্রশাসন, উপজেলা প্রশাসন, ইউনিয়ন পরিষদ, কৃষক, জেলেসহ স্থানীয় জনগোষ্ঠী, স্থানীয় সরকার ও প্রকৌশল অধিদপ্তর, উপকূলীয় বন বিভাগ, কৃষি সম্প্রসারণ বিভাগ, বন বিভাগ, বন্যপ্রাণী সংরক্ষণ বিভাগ, পরিবেশ অধিদপ্তরসহ বিভিন্ন সংস্থার সঙ্গে বৈঠক করে পরামর্শক প্রতিষ্ঠান। তবে এসব বৈঠকে পাউবোকে সম্পৃক্ত করা হয়নি বলে অভিযোগ করেছেন সংস্থাটির স্থানীয় কর্মকর্তারা। প্রকল্পের পরিবেশগত প্রভাব মূল্যায়ন সমীক্ষার সময় বন্যা, পাহাড় কাটার ফলে ভূমিধসের আশঙ্কার কথা জানিয়েছিলেন স্থানীয় অংশীজনরাও।

প্রকল্প সূত্রে জানা গেছে, দোহাজারী-কক্সবাজার রেলপথ নির্মাণ প্রকল্প কর্তৃপক্ষ স্থানীয়দের দাবির মুখে কালভার্টের সংখ্যা বাড়িয়েছে। প্রকল্প কর্মকর্তারা বলছেন, নকশা অনুযায়ী পুরো রেলপথে ১৪৪টি কালভার্ট হওয়ার কথা। কিন্তু স্থানীয়দের দাবির মুখে কালভার্টের সংখ্যা ১৭৩টি করা হয়েছে। ২০২৩ সালে বন্যার পর সাতকানিয়ার কেঁওচিয়া এলাকায় চারটিসহ বিভিন্ন এলাকায় আরো কালভার্ট নির্মাণ করা হয়। সংশ্লিষ্টরা বলছেন, প্রকল্পের নকশার বাইরে বাড়তি কালভার্ট-সেতু নির্মাণ এবং বন্যার পর অতিরিক্ত কালভার্ট নির্মাণ প্রকল্পটি বাস্তবায়নে প্রকৌশলগত অদক্ষতার চিত্র উঠে এসেছে।

এ বিষয়ে দোহাজারী-কক্সবাজার রেললাইন প্রকল্পের পরিচালক মোহাম্মদ সুবক্তগীন বণিক বার্তাকে বলেন, ‘দেশের একাধিক নতুন রেলপথ নির্মাণ হলেও দোহাজারী-কক্সবাজার রেলপথ সম্পূর্ণ ভিন্ন। পাহাড়ি ভূমিসহ ওই এলাকার ভূপ্রাকৃতিক গঠনের কারণে দীর্ঘ একটি নতুন রেলপথের কাজ বাস্তবায়ন চ্যালেঞ্জিং। বাস্তবায়নের মধ্যেই আমরা বিভিন্ন সমস্যা খুঁজে বের করে সমাধানের চেষ্টা করছি। আশা করি প্রকল্পকাজ সম্পূর্ণ শেষ হয়ে গেলে পাহাড়ধসসহ বিদ্যমান সংকটগুলো আর থাকবে না।’

বিশেষজ্ঞরা বলছেন, ‌চট্টগ্রাম-কক্সবাজার এলাকার ভূমির কাঠামো সারা দেশের মধ্যে অনেকটা আলাদা। সাধারণত বাংলাদেশে পানি উত্তর-দক্ষিণ বরাবর প্রবাহিত হলেও চট্টগ্রাম-কক্সবাজার এলাকায় পানির প্রবাহ পূর্ব-পশ্চিমমুখী। এ প্রেক্ষাপটে চট্টগ্রাম-কক্সবাজার এলাকায় বৃষ্টিপাত ও পাহাড়ি ঢলের কারণে সমন্বিতভাবে সমীক্ষা করে তারপর রেলপথটির বিদ্যমান ত্রুটিগুলো সংশোধন করা জরুরি বলে মনে করছেন তারা।

রেলওয়ে পূর্বাঞ্চলের বিভাগীয় রেলওয়ে ম্যানেজার মো. সাইফুল ইসলাম বণিক বার্তাকে বলেন, ‘দোহাজারী-কক্সবাজার রেলপথের নির্মাণকাজ আনুষ্ঠানিকভাবে শেষ হয়নি। সাম্প্রতিক সময়ে লোহাগাড়া এলাকায় দুই দফায় পাহাড়ধসের কারণে রেলপথে মাটি এসে পড়ায় আমরা প্রকল্প কর্তৃপক্ষকে ত্রুটির বিষয়টি অবহিত করেছি। তাছাড়া ওই এলাকায় পাহাড়ধস প্রতিরোধে স্থায়ী ব্যবস্থা নেয়ার জন্য একটি প্রস্তাব ও নির্দেশনা পাঠানোর পরিকল্পনা নেয়া হয়েছে। প্রকল্পের সময়সীমার মধ্যেই এসব কাজ শেষ করতে চিঠিতে নির্দেশনা দেয়া হবে।’

এই বিভাগের আরও খবর

আরও পড়ুন