দেশের ভোজ্যতেল বাজারের বড় অংশ ‘পুষ্টি’ ব্র্যান্ডের

নিজস্ব প্রতিবেদক

ছবি : বণিক বার্তা

FMCG বা ফাস্ট মুভিং কনজিউমার প্রডাক্ট বলতে আসলে কী বুঝায়?

গ্রাহক যা সরাসরি গ্রহণ বা ভোগ করেন তাই মূলত ফাস্ট মুভিং কনজিউমার প্রডাক্ট যেমন বিস্কুট, কেক, চানাচুর, মুড়ি ইত্যাদি। এক্ষেত্রে টিকে গ্রুপের শুরু ও পরিচিতি যা নিয়ে তা মূলত এফএমসিজির আগের ধাপের পণ্য বা কমোডিটি প্রডাক্ট। এ পণ্যগুলো যেমন তেল, আটা, ময়দা, সুজি বা চা পাতা থেকে পরবর্তী কনজিউমার পণ্য বা খাবার পাওয়া যায়। বাজারে এ মুহূর্তে উল্লিখিত পণ্যগুলোর জন্য জনপ্রিয় ব্র্যান্ডগুলোর বেশির ভাগই টিকে গ্রুপের পুষ্টি ব্র্যান্ডের। শুধু তাই নয়, দেশে ভোজ্যতেলের বাজারের সবচেয়ে বড় অংশ (৪০ শতাংশ) পুষ্টি একাই দখল করে রেখেছে। 

কীভাবে শুরু হলো এ বৃহৎ যাত্রা? 

গ্রুপের যাত্রা মূলত ১৯৭২ সালে বীর মুক্তিযোদ্ধা প্রতিষ্ঠাতা চেয়ারম্যান মোহাম্মদ আবু তৈয়ব ও তার ভাই বিশিষ্ট ব্যবসায়ী মোহাম্মদ আবুল কালামের হাত ধরে। একটি ময়দার মিল ছিল শুরুর কারখানা। কিছুদিন পর এতে সাফল্য এলে আস্তে আস্তে তারা অন্যান্য সেক্টরে ডেভেলপ করেন। তখন বৈদ্যুতিক বাল্ব দিয়ে কারখানার সম্প্রসারণ হলেও নব্বই দশকের দিকে টিকে এফএমসিজির কমোডিটি মার্কেটের দিকে আবার অগ্রসর হয়। শুরুতে সয়াবিন তেল, আটা ও ময়দা দিয়ে শুরু করা কমোডিটি পণ্যের ব্যবসায় পরবর্তী সময়ে সরিষা তেল ও সুজি যুক্ত হয়। এছাড়া শিগগিরই বাজারে আসতে যাচ্ছে পুষ্টি ব্র্যান্ডের নতুন ভোজ্যতেল সানফ্লাওয়ার (সূর্যমুখী) অয়েল। এছাড়া দেশের ফুড ইন্ডাস্ট্রি, কনফেকশনারি, বেকারি ইত্যাদি খাতে কমোডিটি আইটেম হিসেবে আটা, ময়দা, সুজি, তেল ইত্যাদির সবচেয়ে বড় সরবরাহকারী টিকে গ্রুপ। বর্তমানে এসব পণ্য আমাদের প্রতিষ্ঠিত ব্র্যান্ড ‘পুষ্টি’ নামে বাজারজাত করা হচ্ছে। এছাড়া পুষ্টি ব্র্যান্ডের চা পাতাও রয়েছে বাজারে, যা তৈরি হয় টিকে গ্রুপের নিজস্ব তিনটি বিশাল চা বাগান থেকে উৎপাদিত বিশুদ্ধ চা পাতা থেকে। চট্টগ্রামের ফটিকছড়িতে প্রায় ৩০ হাজার একরের বিশাল এলাকাজুড়ে রয়েছে টিকে গ্রুপের এ চা বাগান। এছাড়া সম্প্রতি নতুন কারখানা থেকে বিস্কুট, দুধ পাউডার, ঘি, বেভারেজ ও স্ন্যাকস আইটেম (চানাচুর, ঝালমুড়ি, কেক ইত্যাদি) বাজারে নিয়ে এসেছে টিকে। 

শুরুর সময় বড় চ্যালেঞ্জগুলো কী ছিল?

কারখানা শুরুর সময় বড় চ্যালেঞ্জগুলো ছিল যন্ত্রপাতি, দক্ষ শ্রমিক পাওয়া, কারখানার স্থান ব্যবস্থা করা ইত্যাদি। যন্ত্রপাতিগুলো আনা হয়েছে বিভিন্ন দেশ থেকে। তেল পরিশোধনের ফিলিং মেশিন জার্মানির কেএইচএস থেকে আনা হয়েছে, যারা বিশ্বে এ-জাতীয় যন্ত্রপাতি তৈরিতে শীর্ষস্থানীয়। এছাড়া কানাডা, ফ্রান্স ইত্যাদি দেশ থেকেও প্রয়োজনীয় অত্যাধুনিক মেশিনারিজ আমদানি করা হয়েছে কারখানার প্রয়োজনে। শুরুতে অল্পসংখ্যক শ্রমিক দিয়ে কাজ শুরু হলেও বর্তমানে টিকে গ্রুপের কর্মচারী সংখ্যা সব মিলিয়ে ৫০ হাজারের বেশি। এর মাঝে ভোজ্যতেল, আটা-ময়দা-সুজি ও চা কারখানার সঙ্গে সংযুক্ত শ্রমিক ও কর্মীর সংখ্যা সর্বাধিক, যা সম্পূর্ণ জনশক্তির প্রায় ৬০ শতাংশ।

কারখানাগুলো কোথায় অবস্থিত?

টিকে গ্রুপের তেল, আটা-ময়দা-সুজির কারখানাগুলো দেশের অনেক জায়গায় বিস্তৃত। ভোজ্যতেলের কারখানা মূলত চট্টগ্রামে ও নারায়ণগঞ্জের দুটি জায়গায় (কাঁচপুর ও তারাবো বাজার) অবস্থিত। এছাড়া অন্য পণ্যের কারখানাগুলো খুলনার মংলা, হবিগঞ্জ, রংপুর ইত্যাদি জায়গায়। পাশাপাশি চট্টগ্রামের মিরসরাইতে নতুন একটি বিশাল কারখানা তৈরি হচ্ছে, যা শিগগিরই চালু হতে যাচ্ছে। এ কারখানাগুলোর বেশির ভাগই দেশের বৃহত্তম কারখানাগুলোর অন্তর্গত। আটা-ময়দার কারখানাগুলো শুরু হয়েছিল দৈনিক ১৫০ টন উৎপাদন সক্ষমতা নিয়ে, যার বর্তমান উৎপাদনসক্ষমতা দৈনিক ১ হাজার ৩০০ টন ও ১ হাজার ৬০০ টনে উন্নীত হয়েছে। ভোজ্যতেলের কারখানার রিফাইনারি বা পরিশোধন সক্ষমতা বর্তমানে দৈনিক পাঁচ হাজার টন, যা সামনে আরো বাড়ানোর পরিকল্পনা রয়েছে।

বিশ্ববাজারে কী কী পণ্য রফতানি হচ্ছে?

দেশের চাহিদার সঙ্গে তাল মিলিয়ে ক্রমাগত এ সম্প্রসারণের ফলে টিকে গ্রুপের পণ্য এখন রফতানি হচ্ছে ৩০টির বেশি দেশে। বিশেষ করে ভোজ্যতেল উৎপাদনের সময় উপজাত পণ্য হিসেবে উৎপাদিত তেলের ফ্যাটজাতীয় পণ্য (ঘি, ডালডা, অলিন) ইত্যাদি সম্পূর্ণটাই রফতানি হয়ে যায়। পাশাপাশি বিস্কুট, স্ন্যাকস, বেভারেজ আইটেম ও চা রফতানি হচ্ছে। রফতানি হওয়া দেশগুলোর মাঝে রয়েছে ভারত, সিঙ্গাপুর, মালয়েশিয়া, নেপাল, ভুটান, ফ্রান্স, ব্রিটেন, কানাডা ও মধ্যপ্রাচ্যের দেশ। বিশেষত মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলোয় বাংলাদেশ এবং এ উপমহাদেশের অনেক মানুষ বসবাস করায় সেখানে আমাদের দেশীয় ব্র্যান্ড পুষ্টি ও টিকে গ্রুপের অন্যান্য এফএমসিজি পণ্য খুবই জনপ্রিয়।

কারখানাগুলো স্থাপনায় কোন বিষয়টি গুরুত্ব দেয়া হয়েছে?

টিকে গ্রুপের বেশির ভাগ কারখানা, বিশেষত ভোজ্যতেলের কারখানাগুলো মূলত সমুদ্রের পাশে অবস্থিত। কারণ বিদেশ থেকে সমুদ্রপথে এসব পণ্যের কাঁচামাল আনার পাশাপাশি সমুদ্রের সঙ্গে সংযুক্ত নদীপথের মাধ্যমে উৎপাদিত পণ্য সারা দেশে খুব সহজেই পৌঁছানো যায়। বর্তমানে দেশজুড়ে নদীপথের মাধ্যমে পরিবহন ব্যবস্থাই সবচেয়ে সহজ ও সুলভ হওয়ায় কারখানা স্থাপনে বন্দরজাতীয় এলাকাকেই গুরুত্ব দেয়া হয়েছে।

বর্তমান বাজার পরিস্থিতি কেমন দেখছেন?

দেশের চাহিদা মেটানোর পাশাপাশি এ বিশালসংখ্যক উৎপাদন থেকে রফতানি করার পরেও দেশে এখনো এফএমসিজির কমোডিটি পণ্যের বিশাল বাজার রয়ে গেছে। কাঁচামাল আমদানি, নতুন এলসি খোলা, পরিবহন খরচ, সম্প্রতি উদ্ভূত জ্বালানি (গ্যাস-বিদ্যুৎ) সংকট ইত্যাদি সংক্রান্ত প্রয়োজনীয় চ্যালেঞ্জ মোকাবেলায় সরকারের উপযুক্ত সহযোগিতা পেলে উৎপাদন বৃদ্ধির মাধ্যমে দেশের বাজারে সুলভে আরো বেশি পণ্য সরবরাহ করা সম্ভব।

এই বিভাগের আরও খবর

আরও পড়ুন