ওজোন দিবস

টেকসই পৃথিবীর জন্য ওজোন স্তর সুরক্ষা করি

ড. মো. ইকবাল সরোয়ার

ছবি : বণিক বার্তা

বায়ুমণ্ডলের ওজোন স্তর ক্ষয়ের জন্য দায়ী দ্রব্যগুলোর ব্যবহার সীমিত করার জন্য ভিয়েনা কনভেনশনের আওতায় ওজোন স্তর ধ্বংসকারী নানা ধরনের পদার্থের ওপর মন্ট্রিল প্রটোকল গৃহীত হয় ১৯৮৭ সালের ১৬ সেপ্টেম্বর। বর্তমানে বিশ্বের ১৯৫টি দেশ প্রটোকলের চুক্তিতে স্বাক্ষর করেছে এবং মন্ট্রিল প্রটোকল এ পর্যন্ত আটবার সংশোধিত হয়েছে। এ প্রটোকল অনুযায়ী, সদস্যদেশগুলো ওজোন স্তর ধ্বংসকারী রাসায়নিক সিএফসি, হ্যালন, কার্বন টেট্রাক্লোরাইড, মিথাইল ক্লোরোফর্ম, হাইড্রোব্রোমোফ্লোরো কার্বন, হাইড্রোফ্লোরো কার্বন ইত্যাদির উৎপাদন, ব্যবহার সীমিত ও নিষিদ্ধ করতে একমত হয়। দিনটির স্মরণে ১৯৯৪ সালে জাতিসংঘের সাধারণ পরিষদ ১৬ সেপ্টেম্বরকে আন্তর্জাতিক ওজোন স্তর সুরক্ষা দিবস হিসেবে পালনের সিদ্ধান্ত ঘোষণা করে। এর পর থেকে ওজোন স্তর ক্ষয় ও এর নানা ধরনের ক্ষতিকর প্রভাব সম্পর্কে সচেতনতা সৃষ্টিতে প্রতি বছর এদিনে আন্তর্জাতিক ওজোন দিবস পালন করা হয়ে থাকে। ১৯৯০ সালে বাংলাদেশ মন্ট্রিল প্রটোকলে স্বাক্ষর করে, যার ফলে বাংলাদেশেও প্রতি বছর বিশেষ গুরুত্ব দিয়ে দিবসটি পালন করা হয়। এ বছর দিনটির প্রতিপাদ্য নির্ধারণ করা হয়েছে ‘জীবনের জন্য ওজোন: বিশ্বব্যাপী সহযোগিতার ৩৫ বছর’ (Ozone for Life: 35 Years of Global Cooperation)।

পৃথিবীপৃষ্ঠে ওজোন গ্যাসকে একটি দূষণ সৃষ্টিকারী পদার্থ হিসেবে বিবেচনা করা হলেও বায়ুমণ্ডলে ওজোন খুবই প্রয়োজনীয় একটি উপাদান। গ্রিক ‘ওজোন’ শব্দের অর্থ গন্ধ পাওয়া। বাস্তবেও ওজোন কড়া গন্ধযুক্ত হালকা নীল রঙের বিষাক্ত একটি গ্যাস। ওজোন গ্যাস -১১২০ সে. তাপমাত্রায় তরলে রূপান্তরিত হয় এবং ওজোন ঘনীভূত হয় -২৫১.৪০ সে. তাপমাত্রায়। অক্সিজেনের সঙ্গে বিভিন্ন দিক থেকে মিল থাকলেও ওজোন অক্সিজেনের চেয়ে বেশি সক্রিয় এবং শক্তিশালী জারক পদার্থ হিসেবে ব্যবহৃত হয়। বৈদ্যুতিক সরঞ্জামের কাছের এলাকায় সৃষ্ট স্ফুলিঙ্গ এবং বজ্রসহ বৃষ্টির পর ওজোন গ্যাসের গন্ধ পাওয়া যায়। ১৮৪০ সালে ওজোন গ্যাস আবিষ্কার করেন স্কোনবি। এরপর ফ্রান্সের পদার্থবিদ চার্লস ফ্যাব্রি এবং হেনরি বুইসন ১৯১৩ সালে বায়ুমণ্ডলের ওজোন স্তর আবিষ্কার করেন। ওজোন স্তর সূর্যের ক্ষতিকর অতিবেগুনি রশ্মিকে শোষণ করে পৃথিবীতে প্রবেশে বাধা দেয়, যা (সূর্যের ক্ষতিকর অতিবেগুনি রশ্মি) পৃথিবীর জীবজগৎ ও প্রাণিজগতের জন্য হুমকিস্বরূপ। সর্বোপরি ওজোন স্তর বায়ুমণ্ডলের তাপমাত্রা নিয়ন্ত্রণ করতে সহায়তা করে। 

বায়ুতে ওজোন গ্যাসের উপস্থিতির তারতম্যের ফলে বায়ুর মান খারাপ হওয়ার পাশাপাশি বৈশ্বিক উষ্ণায়ন ও জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাব তৈরি করে। এ বৈশ্বিক জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাবে মানুষের জীবনযাপন, আবহাওয়া ও পরিবেশের ওপর ক্রমাগত নেতিবাচক প্রভাব পড়ছে। জলবায়ু পরিবর্তনজনিত হুমকির মুখে থাকা পৃথিবীর শীর্ষস্থানীয় একটি দেশ হলো বাংলাদেশ। সমুদ্রসমতল থেকে কম উচ্চতা, অধিক জনসংখ্যা, চরম ভাবাপন্ন আবহাওয়া, নিয়মিত প্রাকৃতিক দুর্যোগ, সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা বৃদ্ধি ইত্যাদি বাংলাদেশের আবহাওয়া, জলবায়ু ও পরিবেশকে বিপন্ন করে তুলছে। অন্যদিকে পৃথিবীর বায়ুমণ্ডলের একটি গুরুত্বপূর্ণ স্তর হলো ওজোন স্তর যেখানে তুলনামূলকভাবে বেশি মাত্রায় ওজোন গ্যাস বিদ্যমান রয়েছে। বায়ুমণ্ডলের স্তরসমূহের মধ্যে ভূপৃষ্ঠ থেকে ২০-৩০ কিলোমিটারের ওপর ওজন গ্যাসযুক্ত যে বায়ু স্তর রয়েছে তাকে ওজোন মণ্ডল বা ওজন স্তর বলা হয়। ভূপৃষ্ঠসংলগ্ন বায়ুতে এ গ্যাসের উপস্থিতি খুবই নগণ্য এবং স্ট্র্যাটোম্ফিয়ারের ৩০ কিলোমিটারের মধ্যে ওজোন স্তরের ঘনত্ব সবচেয়ে বেশি। বিজ্ঞানীদের তথ্য অনুযায়ী, বিষুবরেখার কাছাকাছি ওজোনের পরিমাণ থাকে কম, অন্যদিকে মেরু এলাকায় ওজোন গ্যাসের পরিমাণ থাকে বেশি। উত্তর এবং দক্ষিণ গোলার্ধের মাঝামাঝি থেকে উচ্চতর অক্ষাংশে বেশি পরিমাণে ওজোন গ্যাস বিদ্যমান থাকে। ১৯৮৫ সালে সর্বপ্রথম ব্রিটিশ অ্যান্টার্কটিক সার্ভের বিজ্ঞানীরা লক্ষ করেন, দূষণ বাড়ায় ক্রমে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে বায়ুমণ্ডলের এ ওজোন স্তর। বিজ্ঞানীরা গবেষণার মাধ্যমে দেখান যে কীভাবে এ ওজোন স্তর আমাদের আবাসস্থল পৃথিবীকে সূর্যের ক্ষতিকর রশ্মি ও গ্যাস থেকে রক্ষা করে। তারা ব্যাখ্যা করেন, এ স্তর চাদরের মতো পৃথিবীকে ঢেকে রাখে বলেই ক্ষতিকর উপাদানগুলো এতে প্রতিফলিত হয়ে বিপরীত প্রতিবর্ত প্রতিফলনে ফিরে যায়। পৃথিবীর ক্রমবর্ধমান মানুষের উচ্চাভিলাষী জীবনযাপন পদ্ধতি ও অতিরিক্ত কার্বন ব্যবহারের কারণে ওজোন স্তর ক্ষতিগ্রস্ত হতে শুরু করেছে। সত্তরের দশকের শুরুর দিকে ওজোন গ্যাসের স্তর ক্ষতিগ্রস্ত হওয়ার বিষয়টি প্রথম দৃষ্টিগোচর হয়। গবেষণায় দেখা যায়, স্ট্র্যাটোস্ফিয়ারে প্রতি এক দশকে প্রায় ৪ শতাংশ হারে ওজোন স্তরের পুরুত্ব হ্রাস পাচ্ছে। বায়ুমণ্ডলের ওজোন স্তর ক্ষতিগ্রস্ত হওয়ার ফলে সূর্য থেকে অতিবেগুনি রশ্মি পৃথিবীতে প্রবেশ করছে, যা নেতিবাচক প্রভাব ফেলছে মানুষসহ উদ্ভিদ ও প্রাণিজগতের ওপর। মানবজাতি আক্রান্ত হচ্ছে ত্বকের ক্যান্সারসহ নানা জটিল ও কঠিন রোগে। এছাড়া এ রশ্মির কারণে চোখের ক্ষতি হতে পারে, শরীরের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা কমে যেতে পারে। ওজোন স্তর প্রতিনিয়ত সূর্যের ক্ষতিকর অতিবেগুনি রশ্মি প্রতিহত করে পৃথিবীর প্রাণিজগৎকে রক্ষা করে চলেছে। কিন্তু ফ্রিজ, এসি, অ্যারোসলসহ নানা যন্ত্রপাতি থেকে নির্গত ক্লোরোফ্লোরো কার্বনের কারণে ওজোন স্তর ক্রমাগত ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে। বায়ুমণ্ডলে সিএফসির ক্রমাগত উপস্থিতি ওজোন স্তরের ক্ষতির অন্যতম কারণ। সিএফসি গ্যাস বায়ুমণ্ডলের ওপরের দিকে উঠে সূর্যের অতিবেগুনি রশ্মির কারণে ক্লোরিন পরমাণু ছেড়ে দেয় যা ওজোন গ্যাসের অণু ভাঙার ক্ষেত্রে অনুঘটক হিসেবে কাজ করে, যার ফলে ওজোন স্তরে ছিদ্রের সৃষ্টি হয়। সাধারণত ওজোন স্তরে দুই ধরনের ক্ষত সৃষ্টির ব্যাপারে জানা যায়, যেগুলো প্রায় একই ধরনের। প্রথমটি খুবই ধীরগতিতে ঘটে, যাতে ওজোন স্তরে ক্ষতের পরিমাণ এক দশকে প্রায় ৪ শতাংশ, যা ১৯৭০-এর দশক থেকে এটি নিয়মিত ঘটছে। অন্যটি বড় পরিসরে মেরু প্রদেশে মৌসুমভিত্তিক ঘটে। যেমন ইউরোপীয় ইউনিয়নের আর্থ অবজারভেশন প্রোগ্রাম ‘কোপার্নিকাস’ ২০২১ সালে খবর দিয়েছিল যে উত্তর মেরুর বরফ ঢাকা আকাশের ওজন স্তরে প্রায় ১০ লাখ বর্গকিলোমিটারের একটি বিশাল গর্তের সন্ধান পাওয়া গেছে।

আমাদের প্রতিনিয়ত সিএফসি গ্যাসসহ অন্যান্য ওজোন স্তর ক্ষয়কারী গ্যাস উৎপাদন ও ব্যবহারের ফলে ওজোন স্তর মারাত্মকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে। ওজোন স্তর ক্ষতিগ্রস্তের ফলে জলজ ফাইটোপ্লাঙ্কটন নষ্ট হয়ে নেতিবাচক প্রভাব ফেলছে ইকোসিস্টেমের ওপর। এছাড়া বৈশ্বিক উষ্ণতা বৃদ্ধি এবং জলবায়ু পরিবর্তনজনিত প্রভাব তো আছেই। পৃথিবীর প্রাকৃতিক ভারসাম্য বজায় রাখতে হলে আমাদের পরিবেশের বিভিন্ন উপাদানকে সমুন্নত রাখতে হবে। কিন্তু শহর এলাকায় ইট, কংক্রিট ও কাচের আচ্ছাদনের জন্য পুকুর, জলাশয় ভরাট করে গাছ কেটে প্রতিনিয়ত প্রাকৃতিক ভারসাম্য নষ্ট করছি। ভূপৃষ্ঠ এতটাই উত্তপ্ত হচ্ছে যে সামগ্রিকভাবে বদলে যাচ্ছে আবহাওয়া, প্রকৃতি ও পরিবেশ। বাংলাদেশ রেড ক্রিসেন্ট সোসাইটির প্রতিবেদন অনুযায়ী ২০২৪ সালের এপ্রিলের তাপপ্রবাহে দেশের ৭০ শতাংশ মানুষ বিপদে পড়েছে। বাংলাদেশ আবহাওয়া অধিদপ্তরের হিসাব অনুযায়ী, এপ্রিলজুড়ে বাংলাদেশে গড় তাপমাত্রা ছিল ৩৭⁰ সে.। এজন্য আমাদের সচেতন হওয়া জরুরি। বায়ুমণ্ডলে পৃথিবীর প্রায় ৬০ শতাংশ কার্বন নিঃসরণ করে শিল্পোন্নত (আমেরিকা, চীন, জার্মানি, রাশিয়া, যুক্তরাজ্য, ভারত ইত্যাদি) দেশগুলো। ওজোন স্তর রক্ষায় শিল্পোন্নত দেশগুলোকে আকাশে কার্বন নিঃসরণ হ্রাস করে বিকল্প জ্বালানির ব্যবস্থা করতে হবে। এ লক্ষ্যে বাংলাদেশের বর্তমান অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক ড. মুহাম্মদ ইউনূস কর্তৃক প্রকাশিত আ ওয়ার্ল্ড অব থ্রি জিরোস বইয়ে ‘থ্রি জিরো’ ধারণাটি সহায়ক ভূমিকা রাখতে পারে। পরিবেশ সংরক্ষণ ও জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাব কমানোর লক্ষ্যে অধ্যাপক ড. মুহাম্মদ ইউনূস কর্তৃক ‘শূন্য কার্বন নিঃসরণ’ পরিকল্পনা হলো: বনায়ন ও প্রাকৃতিক সম্পদ রক্ষা এবং প্রাকৃতিক সম্পদের সুষ্ঠু ব্যবস্থাপনার মাধ্যমে কার্বন নিঃসরণ কমানো; পরিষ্কার ও পরিবেশবান্ধব প্রযুক্তি এবং পুনর্নবীকরণযোগ্য শক্তির উৎস ব্যবহার করে কার্বন নিঃসরণ হ্রাস করা; এবং অর্থনৈতিক সংস্কার, সবুজ ব্যবসা মডেল ও কার্বন কমানোর লক্ষ্য নির্ধারণ করে শিল্প ও অর্থনীতিতে পরিবেশবান্ধব সংস্কার। সর্বোপরি আমাদের জীবাশ্ম জ্বালানির ব্যবহার কমিয়ে পরিবেশবান্ধব (সৌর, বায়ু ও পানি শক্তি) নবায়নযোগ্য জ্বালানির ব্যবস্থা করতে হবে টেকসই বাসযোগ্য পৃথিবী ও ভবিষ্যৎ প্রজন্মের জন্য। এ ব্যাপারে ওজোন স্তরের ক্ষতিকর দিকগুলো তুলে ধরে সর্বস্তরের শিক্ষার্থীদের ওজোন স্তর রক্ষায় ও সামগ্রিক পরিবেশ সংরক্ষণে সচেতন করতে হবে। ব্যক্তিগত গাড়ির পরিবর্তে গণপরিবহন, বাইসাইকেল, স্বল্প দূরত্বে হাঁটার অভ্যাস গড়ে তুলতে হবে। এছাড়া সিএফসি নির্গত করে এমন পণ্যসামগ্রী (যেমন স্প্রে, অ্যারোসল, এয়ারফ্রেশনার ইত্যাদি) ব্যবহার হ্রাস করতে হবে। কৃষিতে রাসায়নিক সারের পরিবর্তে জৈব সারের ব্যবহার বাড়াতে হবে। 

ড. মো. ইকবাল সরোয়ার: অধ্যাপক, ভূগোল ও পরিবেশবিদ্যা বিভাগ, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়

এই বিভাগের আরও খবর

আরও পড়ুন