২৭০ কোটি ডলার

আর্থিক সহায়তার যথাযথ ব্যবহার নিশ্চিত করতে হবে

ছবি : বণিক বার্তা

দেশের অর্থনীতির অন্যতম চালিকাশক্তি ব্যাংক ও আর্থিক খাত। যদিও অস্বাভাবিক খেলাপি ঋণ, দুর্বল ব্যবস্থাপনা, দুর্নীতি, রাজনৈতিক বিবেচনায় ব্যাংক অনুমোদন, পরিবার বা গোষ্ঠীর প্রভাবে বিগত সাড়ে ১৫ বছরে এ খাতটিকে ধ্বংসের দ্বারপ্রান্তে নিয়ে যাওয়া হয়েছে। এ খাতটিকে দুর্বল করার পেছনে বাংলাদেশ ব্যাংকও দায়ী। কেননা বিগত বছরগুলোয় অনেক ঘটনা চিহ্নিত হওয়ার পরও কোনো দৃশ্যমান পদক্ষেপ নিতে দেখা যায়নি বাংলাদেশ ব্যাংককে। ফলে নানা অনিয়ম-দুর্নীতির কারণে গ্রাহকের আস্থা কমেছে এ খাতে। বিগত বছরগুলোয় এ খাত সংস্কারের বিভিন্ন উদ্যোগ নেয়া হলেও তা ফলপ্রসূ হয়নি। এ খাতে এখন দরকার শৃঙ্খলা ও সুশাসন নিশ্চিতের পাশাপাশি নিয়ন্ত্রণ, পরিবীক্ষণ আরো সুদৃঢ় করা। ব্যাংক ও আর্থিক খাত সংস্কারে সরকার ও বাংলাদেশ ব্যাংক যে উদ্যোগ নিয়েছে তা ভালো দিক। সরকারের আহ্বানে উন্নয়ন সহযোগীরাও এগিয়ে আসছে। এ খাত সংস্কারের জন্য যে সহায়তা দেয়ার আশ্বাস দিয়েছে উন্নয়ন সহযোগীরা, তা পেলে যথাযথভাবে বাস্তবায়ন নিশ্চিত করতে হবে।

দেশের আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ খাত চিকিৎসা। চিকিৎসা মানুষের মৌলিক অধিকার হলেও দীর্ঘদিনেও এ খাতকে সেবা খাত হিসেবে গড়ে তোলা যায়নি। দরকারি উপকরণের অভাব, স্বাস্থ্য ব্যবস্থাপনা নিয়ে অভিযোগ, হাসপাতালে সেবার অভাব, নিয়োগ আর কেনাকাটায় একের পর এক দুর্নীতির সংবাদ যেন এ খাতের বেহাল দশাকেই তুলে ধরেছে। কিছু কিছু চিকিৎসক অতিরিক্ত পরীক্ষা-নিরীক্ষা ও ওষুধ প্রেসক্রাইব করেন এবং পরীক্ষা-নিরীক্ষার জন্য ডায়াগনস্টিক নির্ধারণ করে দেন। সেখান থেকে তারা অতিরিক্ত মুনাফাও পান। চিকিৎসকদের এ বাণিজ্য ঠেকাতে হবে। দেশে মানসম্পন্ন চিকিৎসকের সংখ্যাও দিন দিন কমছে। পেশাদারত্ব থেকে বেরিয়ে চিকিৎসকরা অনিয়মের জোয়ারে গা ভাসিয়েছেন। অতিরিক্ত মুনাফার লোভে তারা বিভিন্ন অসদুপায় অবলম্বন করছেন। এ অবস্থা থেকে বেরিয়ে আসতে হবে চিকিৎসকদের। এ খাতকে সেবামূলক হিসেবে গড়ে তুলতে সরকারের শক্ত নিয়ন্ত্রণ ও সুশাসন প্রতিষ্ঠা জরুরি। স্বাস্থ্যসেবা ব্যয়কে দেশের নিম্ন ও মধ্যম আয়ের মানুষের নাগালের মধ্যে রাখতে সরকারের পদক্ষেপ কাম্য। স্বাস্থ্য, সুশাসন ও অর্থনৈতিক সুযোগ সৃষ্টির লক্ষ্যে যুক্তরাষ্ট্র যে আর্থিক সহায়তা দিচ্ছে তা যথাযথভাবে ব্যবহার নিশ্চিত জরুরি। 

বাংলাদেশকে বিশ্বব্যাংক ১০০ কোটি ডলার, এশীয় উন্নয়ন ব্যাংক (এডিবি) ১৫০ কোটি ডলার ও যুক্তরাষ্ট্র ২০ কোটি ডলার আর্থিক সহায়তা দেয়ার প্রতিশ্রুতি দিয়েছে। ব্যাংক ও আর্থিক খাত সংস্কারে বিশ্বব্যাংক ও এডিবি এবং স্বাস্থ্য, সুশাসন ও অর্থনৈতিক সুযোগ সৃষ্টির লক্ষ্যে যুক্তরাষ্ট্র এ সহায়তা দিচ্ছে। বিশ্বব্যাংকের ১০০ কোটি ডলারের সহায়তার মধ্যে পলিসি বেজড ঋণ হিসেবে ৭৫ কোটি ডলার ও ইনভেস্টমেন্ট ঋণ হিসেবে ২৫ কোটি ডলার পাওয়া যাবে। আগামী ডিসেম্বরের মধ্যে বিশ্বব্যাংকের বোর্ডে এ ঋণ অনুমোদন হওয়ার কথা রয়েছে। তবে ঋণ পেতে বেসরকারি খাতে অ্যাসেস ম্যানেজমেন্ট কোম্পানি করা, আন্তর্জাতিক মানদণ্ডে খেলাপি ঋণের নতুন সংজ্ঞায়ন করা এবং নতুন গঠিত টাস্কফোর্সের অডিট ফার্মের কার্যবিবরণী বিশ্বব্যাংকে উপস্থাপন করার শর্ত মানতে হবে বাংলাদেশকে।

গত ১১ সেপ্টেম্বর দেশের ব্যাংক খাত সংস্কারে ছয় সদস্যের টাস্কফোর্স গঠন করেছে বাংলাদেশ ব্যাংক। এ টাস্কফোর্সের সার্বিক কার্যাবলি বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নর সমন্বয় করবেন। আশা করি এ টাস্কফোর্স ব্যাংক সংস্কারে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখবে। 

সংস্কার ও সুশাসন ছাড়া ব্যাংক খাত, পুঁজিবাজার, আর্থিক সংস্থার ওপর মানুষের আস্থা আরো কমে যাবে। অর্থনৈতিক সংকটের সময় জনগণের অংশগ্রহণ ও সহযোগিতা পাওয়া মুশকিল হবে। দেশের অর্থনীতিকে পুনরুজ্জীবিত করতে হলে ব্যাংক ও আর্থিক খাতে মনোযোগ দিতে হবে। অর্থনীতিকে এগিয়ে নিতে ও সংকট থেকে উত্তরণে ব্যাংক খাত বড় ভূমিকা পালন করে। ব্যাংক খাতে সংস্কার ও শৃঙ্খলা প্রতিষ্ঠা করতে হবে। সুশাসন ও জবাবদিহি নিশ্চিত করতে হবে। শক্তিশালী ব্যাংক ব্যবস্থা স্থিতিশীল অর্থনীতির পরিচয় বহন করে। রুগ্‌ণ-দুর্বল ব্যাংক ব্যবস্থা রুগ্‌ণ-দুর্বল অর্থনীতির প্রমাণ দেয়। ব্যাংক বা ব্যাংক ব্যবস্থার প্রতি মানুষের অটল আস্থা অত্যন্ত জরুরি। কেননা আস্থা নষ্ট হলে কিংবা না থাকলে গোটা অর্থনীতিতে ও অন্যান্য ব্যবস্থায় ধস নামতে বাধ্য। তাই ব্যাংককেন্দ্রিক অনিয়ম-দুর্নীতি-দুষ্কৃতীর প্রতিটি ঘটনার অনুপুঙ্খ তদন্ত করতে হবে। এসবের সঙ্গে যুক্ত ব্যক্তিদের বিরুদ্ধে দৃষ্টান্তমূলক শাস্তির ব্যবস্থা করতে হবে।

দেশের ব্যাংক ও আর্থিক খাতের নিয়ন্ত্রক প্রতিষ্ঠান বাংলাদেশ ব্যাংক। অর্থনৈতিক কার্যক্রমের সঙ্গে ব্যাংকটির নিবিড় সংযোগ বিদ্যমান। এছাড়া ব্যবসা-বাণিজ্য, শিল্প, রফতানি, আমদানিসহ সার্বিক অর্থনীতিতে আর্থিক স্থিতিশীলতা নিশ্চিত করাও এর অন্যতম দায়িত্ব। বিভিন্ন আর্থিক প্রতিষ্ঠান এবং অধীনস্থ ব্যাংকের ওপর নিয়ন্ত্রণ নিশ্চিত করতে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের কার্যকারিতা সরাসরি সংস্থাটির স্বাধীনতার সঙ্গে সম্পর্কিত। কিন্তু অতীতের যেকোনো সময়ের তুলনায় গত কয়েক বছরে ব্যাংক খাতে রাজনৈতিক হস্তক্ষেপ বেড়েছে। কেন্দ্রীয় ব্যাংককে পাশ কাটিয়েও দেশের ব্যাংক খাতের অনেক গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্ত হয়েছে। ফলে বাংলাদেশ ব্যাংক আইনে যে স্বাধীনতা ও স্বায়ত্তশাসন তাকে দেয়া হয়েছে, সেগুলোর কতটুকু বাস্তবায়ন হয়েছে সেটা নিয়েও প্রশ্ন উঠছে অনেক আগে থেকেই। ফলে ব্যাংক খাতে সুশাসন প্রতিষ্ঠা সম্ভব হয়নি। এদিকে বাংলাদেশ ব্যাংকের স্বায়ত্তশাসন নিয়ে আইনি সীমাবদ্ধতার বিষয়গুলো উঠে এসেছে আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিলের (আইএমএফ) এক প্রতিবেদনেও। 

ব্যাংক ও আর্থিক খাতে সুশাসন নিশ্চিত করতে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের আইনি সীমাবদ্ধতাগুলোও পর্যালোচনা করা দরকার। কেননা দেশের স্বার্থে রাজনৈতিক প্রভাবমুক্ত হয়ে কেন্দ্রীয় ব্যাংক যেন যেকোনো নীতিগত সিদ্ধান্ত নিতে পারে, সে বিষয়টি নিশ্চিত করা জরুরি। বিগত সরকারের আমলে রাজনৈতিক হস্তক্ষেপ বাড়ার কারণে ব্যাংক খাতে তৈরি হয়েছে অস্থিরতা। বেড়েছে খেলাপি ঋণের পরিমাণ। এ ঋণ আদায়ে বাংলাদেশ ব্যাংকের ভূমিকা জোরালো হওয়ার কথা থাকলেও সেই ভূমিকা পালনে ব্যত্যয় ঘটতে দেখা গেছে। বরং খেলাপিদের সুযোগ দিয়ে বরাবরই তাদের পক্ষে অবস্থান নিয়েছে ব্যাংকটি। রাজনৈতিক প্রভাবমুক্ত হয়ে স্বাধীনভাবে কাজ করতে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের আইনি কাঠামোয় পরিবর্তন দরকার বলেও মনে করেছেন বিশ্লেষকরা। 

যে দেশের অর্থনীতি যত বেশি সুসংহত, সে দেশে স্থানীয়ভাবে গড়ে ওঠা ব্যাংকের সংখ্যা তত কম। এক্ষেত্রে আমরা থাইল্যান্ড, সিঙ্গাপুর ও মালয়েশিয়ার দিকে তাকালে দেখতে পাই যে তাদের অর্থনীতির আকার বেড়েছে। একই সঙ্গে অর্জন করেছে অর্থনৈতিক সমৃদ্ধি। অর্থনীতির আকার বিবেচনায় সেসব দেশে স্থানীয় ব্যাংকের সংখ্যা বাড়েনি। কিন্তু বাংলাদেশে রাজনৈতিক বিবেচনায় ও অপ্রয়োজনীয় একের পর এক ব্যাংক অনুমোদন দিয়ে এ খাতকে ঝুঁকিতে ফেলা হয়েছে। যদিও ব্যাংক ও আর্থিক খাত সংস্কারের বেশকিছু পদক্ষেপ নিয়েছে অন্তর্বর্তীকালীন সরকার, যা গ্রাহককে আস্থা ফেরাতে সহায়ক ভূমিকা পালন করেছে।

যে যে উদ্দেশ্যে আমাদের উন্নয়ন সহযোগীদের কাছ থেকে ঋণ পাওয়ার আশ্বাস পাওয়া গেছে, তা পেলে তার যথাযথ ব্যবহার সরকারকে নিশ্চিত করতে হবে। এ অর্থের অপব্যবহার ও অপচয় বন্ধ করতে হবে। অতীতের মতো অর্থ অপচয় ও অনিয়ম-দুর্নীতির পুনরাবৃত্তি যাতে না ঘটে তা নিশ্চিত করতে হবে। আর্থিক ও ব্যাংক এবং স্বাস্থ্য খাতে তদারকি ও পরিবীক্ষণ আরো সুদৃঢ় করতে হবে। আর অনিয়মের সঙ্গে যারা জড়িত তাদের বিরুদ্ধে শক্ত ব্যবস্থা নেয়া জরুরি। 

এই বিভাগের আরও খবর

আরও পড়ুন