সামিট-আদানি-বেক্সিমকোসহ ১১ বিদ্যুৎ কেন্দ্রের তথ্য চেয়েছে জাতীয় পর্যালোচনা কমিটি

নিজস্ব প্রতিবেদক

ছবি : বণিক বার্তা

বিদ্যুৎ ও জ্বালানির দ্রুত সরবরাহ বৃদ্ধি বা বিশেষ আইনের অধীনে হওয়া ভারতের আদানি, বাংলাদেশের সামিট ও বেক্সিমকোসহ ১১ প্রতিষ্ঠানের বিদ্যুৎ সরবরাহ-সংক্রান্ত চুক্তি খতিয়ে দেখবে সরকার। এজন্য তাদের বিদ্যুৎ কেন্দ্র সম্পর্কিত তথ্য-উপাত্ত চেয়েছে সরকার গঠিত জাতীয় পর্যালোচনা কমিটি। বিভিন্ন ধাপে আরো তথ্য চাওয়া হবে বলে কমিটি সূত্রে জানা গেছে। 

১১ বিদ্যুৎ কেন্দ্রের তথ্য-উপাত্ত সংগ্রহের বিষয়টি জানিয়ে গতকাল রাতে এক সংবাদ বিজ্ঞপ্তি দিয়েছে বিদ্যুৎ, জ্বালানি ও খনিজ সম্পদ মন্ত্রণালয়। বিজ্ঞপ্তিতে বলা হয়, বিদ্যুৎ ও জ্বালানির দ্রুত সরবরাহ বৃদ্ধি (বিশেষ বিধান) আইন, ২০১০ (সংশোধিত ২০২১)-এর অধীন সম্পাদিত চুক্তিগুলো পর্যালোচনা করা হবে। এজন্য সরকার গঠিত জাতীয় পর্যালোচনা কমিটির দ্বিতীয় সভায় (২৮ সেপ্টেম্বর) ১১টি বিদ্যুৎ কেন্দ্রসংশ্লিষ্ট তথ্য-উপাত্ত সংগ্রহের সিদ্ধান্ত হয়।

জানা গেছে, কমিটির সিদ্ধান্ত অনুযায়ী ১১টি বিদ্যুৎ কেন্দ্রের পিপিএ (পাওয়ার পারচেজ এগ্রিমেন্ট), কেন্দ্রের মেয়াদ ও সক্ষমতার বিভিন্ন উপাদান এবং জ্বালানি খরচসহ সংশ্লিষ্ট বিষয়াদি চাওয়া হয়েছে। কেন্দ্রগুলোর মধ্যে ছয়টি জ্বালানি তেল ও গ্যাসভিত্তিক বিদ্যুৎ কেন্দ্র। এগুলো হলো মেঘনাঘাট ৫৮৩ মেগাওয়াট ডুয়াল ফুয়েল বিদ্যুৎ কেন্দ্র, বাঘাবাড়ী ২০০ মেগাওয়াট (এইচএসডি), পটুয়াখালী ১৫০ মেগাওয়াট (এইচএফও), আশুগঞ্জ ১৫০ মেগাওয়াট (এইচএফও), মানিকগঞ্জ ১৬২ মেগাওয়াট (এইচএফও), কড্ডা ৩০০ মেগাওয়াট (এইচএফও) বিদ্যুৎ কেন্দ্র। চারটি সৌরবিদ্যুৎ কেন্দ্র মোংলা ১০০ মেগাওয়াট সৌরবিদ্যুৎ কেন্দ্র, সুন্দরগঞ্জ ২০০ মেগাওয়াট, লালমনিরহাট ৩০ মেগাওয়াট ও সুতিয়াখালী ৫০ মেগাওয়াট সৌরবিদ্যুৎ কেন্দ্র। বাকি একটি কয়লাভিত্তিক আদানির গড্ডায় নির্মিত ১ হাজার ৬০০ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ কেন্দ্র। 

সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা গেছে, ৫৮৩ মেগাওয়াট ডুয়াল ফুয়েল বিদ্যুৎ কেন্দ্রের বিষয়ে তথ্য চাওয়া হয়েছে। সেটি নারায়ণগঞ্জের মেঘনাঘাটে অবস্থিত সামিটের মালিকানাধীন। চুক্তির সময় বিদ্যুৎ কেন্দ্রটির ৮০ শতাংশ শেয়ার ধরা হয় সামিট গ্রুপের, বাকি ২০ শতাংশের মালিকানা মার্কিন কোম্পানি জিই (জেনারেল ইলেকট্রিক)। ২০১৯ সালের ১৪ মার্চ কেন্দ্রটি নির্মাণে বাংলাদেশ বিদ্যুৎ উন্নয়ন বোর্ডের (বিপিডিবি) সঙ্গে চুক্তি সই হয়। 

ভারতের ঝাড়খণ্ড জেলার গড্ডায় স্থাপিত ১ হাজার ৬০০ মেগাওয়াট সক্ষমতার আদানির বিদ্যুৎ কেন্দ্রের বিষয়েও তথ্য চেয়েছে পর্যালোচনা কমিটি। এ কেন্দ্রটি নির্মাণে ২০১৭ সালের ৫ নভেম্বর আদানি পাওয়ারের সঙ্গে চুক্তি সই করে বিপিডিবি। অভিযোগ রয়েছে, আদানির কাছ থেকে বিদ্যুৎ কেনার ওই চুক্তি সইয়ে গোপনীয়তা অনুসরণ করা হয়। কেন্দ্রটি থেকে বিদ্যুৎ কিনতে বিপিডিবির সঙ্গে চুক্তি রয়েছে ২৫ বছর মেয়াদি। শর্ত অনুযায়ী, চাহিদা না থাকলেও বিপিডিবিকে ৩৪ শতাংশ বিদ্যুৎ কিনতে হবে। পাশাপাশি এ বিদ্যুৎ কেন্দ্রে যে কয়লা ব্যবহার হয় সেখানেও নেয়া হচ্ছে বেশি দাম।

পটুয়াখালী ১৫০ মেগাওয়াট সক্ষমতার ফার্নেস অয়েলচালিত বিদ্যুৎ কেন্দ্রটি ইউনাইটেড পায়রা পাওয়ার লিমিটেডের (ইউপিপিএল)। এটি ইউনাইটেড গ্রুপের সাবসিডিয়ারি। এ বিদ্যুৎ কেন্দ্রটি ২০২১ সালের জানুয়ারিতে বাণিজ্যিক উৎপাদনে (সিওডি) যায়।

মানিকগঞ্জ ১৬২ মেগাওয়াট পাওয়ার প্লান্টটি সিঙ্গাইর উপজেলায় অবস্থিত। এটি মানিকগঞ্জ পাওয়ার জেনারেশন কোম্পানির (এমপিজিএল) আওতাধীন। ডরিন গ্রুপের সাবসিডিয়ারি প্রতিষ্ঠানটির এ বিদ্যুৎ কেন্দ্র উৎপাদনে আসে ২০২০ সালের ডিসেম্বরে।

আশুগঞ্জ ১৫০ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ কেন্দ্রটি স্পন্সর প্রতিষ্ঠান মিডল্যান্ড ইস্ট পাওয়ার লিমিটেড (এমইপিএল)। জয়েন্ট ভেঞ্চারে এ বিদ্যুৎ কেন্দ্রের বিনিয়োগে রয়েছে ইয়ুথ গ্রুপ ও ভিয়েলাটেক্স গ্রুপ। বিপিডিবির সঙ্গে ১৫ বছর মেয়াদি বিদ্যুৎ ক্রয় চুক্তি হিসেবে আগামী ২০৩৩ সালে নভেম্বর পর্যন্ত তাদের বিদ্যুৎ সরবরাহের কথা রয়েছে।

এছাড়া ফার্নেস অয়েলভিত্তিক কড্ডায় ৩০০ মেগাওয়াট যে বিদ্যুৎ কেন্দ্রের তথ্য চাওয়া হয়েছে সেটি সামিট গ্রুপের। প্রকৃতপক্ষে এ বিদ্যুৎ কেন্দ্রের ইনস্টল ক্যাপাসিটি ৩০৭ মেগাওয়াট। কেন্দ্রটির তত্ত্বাবধানকারী প্রতিষ্ঠান সামিট গাজীপুর-২ পাওয়ার লিমিটেড। ২০১৮ সালে মে মাসে এটি উৎপাদনে আসে। সৌরভিত্তিক যেসব বিদ্যুৎ কেন্দ্রের তথ্য জানতে চাওয়া হয়েছে তার মধ্যে গাইবান্ধার সুন্দরগঞ্জে অবস্থিত ২০০ মেগাওয়াট কেন্দ্রটির পরিচালনাকারী প্রতিষ্ঠান তিস্তা সোলার লিমিটেড। বেক্সিমকো গ্রুপের সাবসিডিয়ারি প্রতিষ্ঠান তিস্তা সোলার। বাংলাদেশের সর্ববৃহৎ এ সৌরবিদ্যুৎ কেন্দ্রটির কমিশনিং হয় ২০২৩ সালের জানুয়ারিতে। বিপিডিবির সঙ্গে ২০ বছর মেয়াদি বিদ্যুৎ ক্রয় চুক্তি রয়েছে প্রতিষ্ঠানটির। গত বছরের ২ আগস্ট রংপুর জিলা স্কুল মাঠের এক সমাবেশ থেকে বিদ্যুৎ কেন্দ্রটি উদ্বোধন করেছিলেন সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা।

বাগেরহাটের মোংলায় স্থাপিত সৌর বিদ্যুতের ১০০ মেগাওয়াট সক্ষমতার পাওয়ার প্ল্যান্টটি ওরিয়ন গ্রুপের সাবসিডিয়ারি এনারগন রিনিউয়েবল বাংলাদেশ লিমিটেডের। কেন্দ্রটি ২০২১ ডিসেম্বরে গ্রিডে বিদ্যুৎ সরবরাহ শুরু করে। আইপিপিভিত্তিক বিদ্যুৎ কেন্দ্রটির ২০ বছর মেয়াদি ক্রয়চুক্তি রয়েছে বিপিডিবির সঙ্গে। আগামী ২০৪১ সালের ডিসেম্বরে সেই চুক্তির মেয়াদ শেষ হওয়ার কথা রয়েছে। এছাড়া লালমনিরহাট ৩০ মেগাওয়াট সৌরবিদ্যুৎ কেন্দ্রটি ইন্ট্রাকো গ্রুপের। প্রতিষ্ঠানটির বাংলাদেশে সিএনজি ও গ্যাস পরিবহনের ব্যবসা রয়েছে। ভোলা থেকে সিএনজি করে গ্যাস পরিবহনের কাজটি করছে তারা।

ময়মনসিংহের সুতিয়াখালীতে বেসরকারি খাতে নির্মাণাধীন ৫০ মেগাওয়াট সৌরবিদ্যুৎ কেন্দ্রটি এইচডিএফসি সিনপাওয়ার লিমিটেডের। ২০২০ সালের নভেম্বরে কেন্দ্রটির বাণিজ্যিক উৎপাদন শুরু হয়। আগামী ২০৪০ সাল পর্যন্ত কেন্দ্রটির সঙ্গে বিপিডিবির চুক্তি রয়েছে।

আওয়ামী লীগ সরকার ২০১০ সালে দুই বছরের জন্য ‘বিদ্যুৎ ও জ্বালানির দ্রুত সরবরাহ বৃদ্ধি (বিশেষ বিধান) আইন’ করে। পরে তিন দফায় ওই আইনের মেয়াদ ১৪ বছর বাড়ানো হয়। আলোচিত ওই আইনটিতে বলা হয়েছে, বিদ্যুতের জন্য জ্বালানি আমদানি অথবা বিদ্যুৎ কেন্দ্র স্থাপন অথবা বিদ্যুৎ ও জ্বালানি খাতে অন্য কোনো কার্যক্রম, গৃহীত কোনো ব্যবস্থা, আদেশ বা নির্দেশের বৈধতা নিয়ে কোনো আদালতে প্রশ্ন তোলা যাবে না। সে কারণে এ আইনকে বিদ্যুৎ খাতের ‘দায়মুক্তি আইন’ বলে থাকেন সমালোচকরা। এ আইনের সুযোগ নিয়েই আওয়ামী লীগ সরকারের আমলে বিপুল অনিয়ম ও দুর্নীতি হয়েছে বলে অভিযোগ রয়েছে। তাই এ আইনের অধীনে করা চুক্তিগুলো পর্যালোচনা করতে গত ৫ সেপ্টেম্বর পাঁচ সদস্যের জাতীয় কমিটি গঠন করে বিদ্যুৎ বিভাগ। কমিটির আহ্বায়ক হিসেবে রয়েছেন হাইকোর্টের অবসরপ্রাপ্ত বিচারপতি মঈনুল ইসলাম চৌধুরী। সদস্য হিসেবে আছেন বুয়েটের অধ্যাপক আবদুল হাসিব চৌধুরী, চার্টার্ড অ্যাকাউন্ট্যান্ট আলী আশফাক, বিশ্বব্যাংকের ঢাকা কার্যালয়ের সাবেক প্রধান অর্থনীতিবিদ জাহিদ হোসেন ও ইউনিভার্সিটি অব লন্ডনের অধ্যাপক মোশতাক খান।

এদিকে বিদ্যুৎ ও জ্বালানি বিভাগে বিশেষ আইনের আওতায় হওয়া দুর্নীতির তথ্য চেয়ে গণবিজ্ঞপ্তি দিয়েছে চুক্তি পর্যালোচনায় গঠিত জাতীয় কমিটি। যেকোনো ব্যক্তি বিদ্যুৎ ও জ্বালানি উৎপাদন এবং সরবরাহকারী সংস্থার দুর্নীতিসংক্রান্ত তথ্য-উপাত্ত ই-মেইলে পাঠাতে পারবেন। আজ থেকে শুরু করে চলতি মাসের শেষ দিন পর্যন্ত রিভিউ কমিটিতে অভিযোগ দাখিল করা যাবে।

এই বিভাগের আরও খবর

আরও পড়ুন