বাজার ঊর্ধ্বমুখী থাকলেও কমেছে খাদ্য ও সাধারণ মূল্যস্ফীতি

নিজস্ব প্রতিবেদক

ছবি : বণিক বার্তা

নিত্যপণ্যের দাম ঊর্ধ্বমুখী থাকলেও সরকারি হিসাব অনুযায়ী সেপ্টেম্বরে দেশের সাধারণ মূল্যস্ফীতি কমেছে। গত মাসে দেশের সাধারণ মূল্যস্ফীতি কমে দাঁড়িয়েছে ৯ দশমিক ৯২ শতাংশে। অন্যদিকে খাদ্য মূল্যস্ফীতি দশমিক ৯৬ শতাংশীয় পয়েন্ট কমলেও দুই অংকের ঘরেই রয়ে গেছে। আর খাদ্যবহির্ভূত মূল্যস্ফীতি দশমিক ২৪ শতাংশীয় পয়েন্ট কমে দাঁড়িয়েছে ৯ দশমিক ৫০ শতাংশে। 

গতকাল মাসিক হালনাগাদ ভোক্তা মূল্যসূচকের (সিপিআই) তথ্য প্রকাশ করেছে বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরো (বিবিএস)। সেপ্টেম্বরের সিপিআইয়ের হালনাগাদ প্রতিবেদনে সব ধরনের মূল্যস্ফীতি হ্রাসের চিত্র উঠে এসেছে।

বিশ্লেষকরা বলছেন, মূল্যস্ফীতির বাস্কেটে খাদ্যপণ্যের ওয়েট বা ভার এখনো কম। এখানে পদ্ধতিগত কোনো ইস্যু থাকতে পারে। তাই খাদ্যপণ্যের দাম না কমলেও খাদ্য মূল্যস্ফীতি কমে যাচ্ছে। এসব পরিসংখ্যান মনিটরিং করার জন্য একটি স্বাধীন কমিটি থাকা উচিত, যেন স্বচ্ছতা নিশ্চিত করা যায়। কারণ হিসেবে তারা বলছেন, বিবিএস আগের মতোই আছে, কোনো পরিবর্তন হয়নি। আবার বাজারে সিন্ডিকেটও সক্রিয় রয়েছে।

বিবিএসের হিসাব অনুযায়ী, জুলাই ও আগস্টের তুলনায় সেপ্টেম্বরে মূল্যস্ফীতি কিছুটা কমেছে। আওয়ামী লীগ সরকারের শাসনামলের শেষ মাস জুলাইয়ে মূল্যস্ফীতি উঠেছিল ১১ দশমিক ৬৬ শতাংশে। আর খাদ্য মূল্যস্ফীতি ১৩ বছরে সর্বোচ্চ অবস্থানে গিয়ে ১৪ দশমিক ১০ শতাংশে ঠেকেছিল। তবে অন্তর্বর্তী সরকার ক্ষমতা গ্রহণের মাসেই (আগস্ট) সাধারণ মূল্যস্ফীতি কমে ১০ দশমিক ৪৯ শতাংশে নামে, খাদ্য মূল্যস্ফীতিও নামে ১১ দশমিক ৩৬ শতাংশে। 

বিবিএসের প্রতিবেদনের তথ্যমতে, সেপ্টেম্বরে দেশের খাদ্যবহির্ভূত পণ্যের মূল্যস্ফীতিও কমে ৯ দশমিক ৫ শতাংশে ঠেকেছে। আগস্টে তা ছিল ৯ দশমিক ৭৪ শতাংশ। তবে শহরের তুলনায় গ্রামের মানুষের নিত্যপণ্যের কেনাকাটায় বেগ পেতে হচ্ছে বেশি। সেপ্টেম্বরে গ্রামাঞ্চলে গড় মূল্যস্ফীতি ছিল ১০ দশমিক ১৫ শতাংশ, যেখানে শহরাঞ্চলে ছিল ৯ দশমিক ৮৩ শতাংশ।

মূল্যস্ফীতির হার ক্রমেই নিম্নমুখী থাকলেও বাজারে নিত্যপণ্যের দাম খুব একটা কমতে দেখা যায়নি। বরং কিছু ক্ষেত্রে পণ্যের দাম আরো বেড়েছে। ট্রেডিং করপোরেশন অব বাংলাদেশের (টিসিবি) তথ্য অনুযায়ী, গত ৩১ আগস্ট ডিমের হালি ৫৩ টাকা থাকলেও সেপ্টেম্বরের শেষ দিকে তা ৫৬ টাকা ছাড়িয়ে যায়। সে হিসাবে দাম বাড়ে প্রায় ৮ শতাংশ। একইভাবে আগস্টে ব্রয়লার মুরগির কেজি ১৫৫-১৭০ টাকা থাকলেও সেপ্টেম্বরে ১৭০-১৮৫ টাকায় উঠে যায়। একইভাবে মোটা চাল, আলু, তেল ও চিনির দামও বেড়েছে। তবে বাজারে পণ্যের প্রকৃত দাম আরো বেশি বলছেন বাজারসংশ্লিষ্টরা। 

কৃষি অর্থনীতিবিদরাও বলছেন পণ্যের দাম কমেনি। ভোক্তাদের মধ্যে স্বস্তি না এসে উল্টো চাপ আরো বেড়েছে। এ বিষয়ে কৃষি অর্থনীতিবিদ ড. জাহাঙ্গীর আলম বণিক বার্তাকে বলেন, ‘চাল, ডিম, মাছ-মাংস, শাক-সবজি ও আলুর দাম কিছুটা বেড়েছে। পূর্বাঞ্চল ও উত্তরাঞ্চলে সাম্প্রতিক বন্যায় উৎপাদন কিছুটা ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। আমনের উৎপাদনও ২৪ লাখ টনের মতো কম হতে পারে। এলসি জটিলতায় কিছু পণ্যের আমদানিতেও সমস্যা হচ্ছে। আর এমন পরিস্থিতির সুযোগ নেন ব্যবসায়ীরা। এখন দুর্বল বাজার ব্যবস্থাপনায় তারা সুযোগ নিচ্ছে। তাই কৃষি নিত্যপণ্যের দাম কমছে না। তবে আসন্ন রবি মৌসুমকে ভালোভাবে কাজে লাগানো গেলে অদূর ভবিষ্যতে পণ্যের মূল্য হ্রাস পেতে পারে।’

প্রতিটি পণ্য ও সেবার ভার নির্ধারণ করে এর বিপরীতে পণ্যটির মূল্যবৃদ্ধির হার হিসাব করে। বাংলাদেশ ব্যাংক থেকে প্রকাশিত মূল্যস্ফীতির হিটম্যাপের তথ্য অনুযায়ী, মূল্যস্ফীতির হিসাবের ক্ষেত্রে দানাদার খাদ্যশস্যের ওয়েট বা ভার রয়েছে ২১ শতাংশের বেশি। এর মধ্যে চালের ভার ২০ দশমিক ৩১ শতাংশ। আর ডিমের ভার প্রায় ৫ শতাংশ। এছাড়া মাছের ভার প্রায় ৭ শতাংশ ও মসলার ৪ শতাংশের বেশি। আগস্টে এসব পণ্যের দাম কমেনি। উল্টো মুরগি ও ডিমসহ কিছু নিত্যপণ্যের দাম বেড়েছে। চালের বাড়তি দামও নিয়ন্ত্রণে আসেনি।

বিবিএসের তথ্যমতে, গত মাসে খাদ্যবহির্ভূত মূল্যস্ফীতিও ছিল নিম্নমুখী। সেপ্টেম্বরে তা কিছুটা হ্রাস পেয়ে সাড়ে ৯ শতাংশে নেমেছে, যা আগস্টে ছিল ৯ দশমিক ৭৪ শতাংশ। যদিও বাসাবাড়ির জ্বালানি গ্যাসের দাম নতুন করে বাড়ানো হয়েছে। বাড়ি ভাড়া কমার কোনো তথ্যও সামনে আসেনি। কমেনি পরিবহন ব্যয়ও। পানির দামও বাড়ানো হয় কিছুদিন আগে।

বিইআরসির সূত্রমতে, চলতি বছরের জুনে ১২ কেজি এলপিজির দাম বেঁধে দেয়া হয় ১ হাজার ৩৬৩ টাকা। জুলাইয়ে ১২ কেজি সিলিন্ডার দামে বাড়িয়ে করা হয় ১ হাজার ৩৬৬ টাকা। আগস্টে করা হয় ১ হাজার ৩৭৭ টাকা। সেপ্টেম্বরে ১ হাজার ৪২১ টাকা আর চলতি মাসের জন্য তা করা হয় ১ হাজার ৪৫৬ টাকা। এর ফলে গত পাঁচ মাসে ১২ কেজি এলপিজির দাম অব্যাহতভাবে পাঁচ দফায় মোট ৯৩ টাকা বাড়ানো হয়।

অর্থনীতিবিদরা বলছেন, বিবিএস এখনো আগের মতোই রয়েছে। সেখানে কোনো পরিবর্তন আনা হয়নি। মূল্যস্ফীতির বাস্কেটে খাদ্যপণ্যের ওয়েট বা ভার এখনো কম রয়েছে। 

এ বিষয়ে অর্থনীতিবিদ ও ইস্ট ওয়েস্ট ইউনিভার্সিটির অধ্যাপক ড. এ কে এনামুল হক বণিক বার্তাকে বলেন, ‘বাজারে পণ্যের দাম না কমলেও মূল্যস্ফীতি কমছে। এখানে পদ্ধতিগত কোনো ইস্যু থাকতে পারে। এসব মনিটরিং করার জন্য স্বাধীন কমিটি থাকা উচিত, যেন স্বচ্ছতা নিশ্চিত করা যায়। রাস্তায় চাঁদাবাজি ও বাজারে এখনো সিন্ডিকেট রয়েছে। সরকারের এগুলো দেখা উচিত।’ 

বিবিএসের তথ্যকে নির্ভরযোগ্য মনে করেন না দেশের এক-তৃতীয়াংশেরও বেশি মানুষ। বিশেষ করে মূল্যস্ফীতি পরিসংখ্যান নিয়ে তাদের অবিশ্বাস সবচেয়ে বেশি। সংশয় রয়েছে বিবিএসের অন্য সব তথ্য নিয়েও। এ তথ্য উঠে এসেছে খোদ বিবিএস পরিচালিত এক জরিপেই। ‘ব্যবহারকারী সন্তুষ্টি জরিপ-২০২৪’ শীর্ষক এ জরিপে দেখা যায়, বিবিএসের পরিসংখ্যানের মোট ব্যবহারকারীর মধ্যে প্রায় এক-তৃতীয়াংশ বা ৩৩ দশমিক ১৬ শতাংশ বিবিএসের মূল্যস্ফীতিসংক্রান্ত পরিসংখ্যানকে নির্ভরযোগ্য মনে করেন না। ব্যবহারকারীদের ২৭ দশমিক ৪৪ শতাংশ মনে করেন, এ-সংক্রান্ত তথ্যের নির্ভরযোগ্যতা কম। আর একেবারেই অনির্ভরযোগ্য মনে করেন ৫ দশমিক ৭২ শতাংশ। মূলত ২০১৪ সালে বিগত সরকারের পরিকল্পনামন্ত্রী হিসেবে আ হ ম মুস্তফা কামাল দায়িত্ব নেয়ার পর পরিসংখ্যান বিভ্রাট প্রকট হতে থাকে।

এ বিষয়ে পরিসংখ্যান বিশেষজ্ঞ জিয়া হাসান সম্প্রতি বণিক বার্তাকে বলেছিলেন, ‘দেশের মূল্যস্ফীতি ও প্রবৃদ্ধির পরিসংখ্যান নিয়ে বড় ধরনের প্রশ্ন রয়েছে। তাই একটি কমিশন গঠনের মাধ্যমে দেশের এ দুটি ডাটা চেক করা উচিত। স্বাধীন কোনো প্রতিষ্ঠানের মাধ্যমেও এসব ডাটা যাচাই করা যেতে পারে। কারণ এ দুই ডাটার ওপর ভিত্তি করে সুদহার নির্ধারণ করা হয়। তাই সামষ্টিক অর্থনৈতিক স্থিতিশীলতার ক্ষেত্রে এসব ডাটা খুবই গুরুত্বপূর্ণ।’

সার্বিক বিষয়ে জানার জন্য বিবিএসের মহাপরিচালক মোহাম্মদ মিজানুর রহমানের সঙ্গে যোগাযোগের চেষ্টা করা হলেও তাৎক্ষণিক কোনো মন্তব্য পাওয়া যায়নি।

এই বিভাগের আরও খবর

আরও পড়ুন