নতুন বাংলাদেশ বিনির্মাণে হাসান আরিফ অপরিহার্য ছিলেন কি?

ইমামূল হাছান আদনান

ছবি: সংগৃহীত

১৯৪১ সালে ভারতে জন্ম নেয়া হাসান আরিফ শিক্ষাজীবন শেষ করে পেশাগত জীবন শুরু করেন কলকাতায়। স্বাধীনতার আগে ১৯৭০ সালে তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানে আসেন। এরশাদের সামরিক শাসনামলের প্রায় পুরো সময় তিনি সরকারের অ্যাটর্নি অফিসের সঙ্গে যুক্ত ছিলেন। ২০০১ সালে বিএনপি ক্ষমতায় এলে নিয়োগ পান অ্যাটর্নি জেনারেল হিসেবে। ২০০২ সালে বেসরকারি টিভি চ্যানেল ইটিভি বন্ধে তিনি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখেন। এক-এগারোর তত্ত্বাবধায়ক সরকারের আইন উপদেষ্টা হিসেবে ২০০৮ সালের জানুয়ারিতে শপথ নেন হাসান আরিফ।

এক-এগারোর তত্ত্বাবধায়ক সরকারের উপদেষ্টা হিসেবে আইন, বিচার ও সংসদ বিষয়ক মন্ত্রণালয়ের দায়িত্বে ছিলেন আইনজীবী হাসান আরিফ। সে সময় নেয়া গণতন্ত্রবিরোধী সব উদ্যোগেরই তিনি ছিলেন গুরুত্বপূর্ণ অংশীদার। বিশেষ করে খালেদা জিয়ার বিরুদ্ধে মামলাগুলো দায়েরে তিনি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখেন। মাইনাস টু ফর্মুলার অন্যতম কুশীলব ছিলেন তিনি। মইনুদ্দিন-ফখরুদ্দিন আহমেদ নেতৃত্বাধীন তত্ত্বাবধায়ক সরকারের হাত ধরে ২০০৯ সালে ক্ষমতায় আসে আওয়ামী লীগ নেতৃত্বাধীন মহাজোট। 

আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় এসে প্রতিহিংসাবশত অনেকের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিলেও তিনি ছিলেন এসবের ঊর্ধ্বে। গুমসহ গোটা দেশে নানা মানবাধিকার হরণের বিরুদ্ধে কোনো উদ্যোগে তাকে সমর্থন দিতে দেখা যায়নি। জুলাইয়ের গণআন্দোলনেও দৃশ্যত তার কোনো অবস্থান ছিল না। ৫ আগস্ট শেখ হাসিনা সরকারের পতন হলে ৮ আগস্ট অন্তর্বর্তী সরকারের উপদেষ্টা হিসেবে আবার শপথ নেন তিনি।

আইনজীবী হিসেবে হাসান আরিফের অগ্রাধিকারমূলক বিষয় হলো সাংবিধানিক বিরোধ, ব্যাংকিং, ইন্স্যুরেন্স, করপোরেট সংক্রান্ত বিকল্প বিরোধ নিষ্পত্তি, রাজস্ব ও কর-সংক্রান্ত মামলা। যদিও ড. মুহাম্মদ ইউনূসের নেতৃত্বাধীন সরকারে স্থানীয় সরকার, পল্লী উন্নয়ন ও সমবায় মন্ত্রণালয় এবং ভূমি মন্ত্রণালয়ের গুরুদায়িত্ব পেয়েছেন তিনি। এছাড়া দীর্ঘদিন ধরেই ঢাকেশ্বরী মন্দিরের উপদেষ্টা হিসেবেও রয়েছেন তিনি। 

হাসান আরিফের সহকর্মী তথা সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবীরা বলছেন, ‘বিএনপি নেতৃত্বাধীন সরকারের সময় অ্যাটর্নি জেনারেল পদের মতো গুরুত্বপূর্ণ পদে থাকলেও ২০০৭-০৮ সালের তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সময়ে তার ভূমিকা প্রশ্নবিদ্ধ। ওই সময় বিএনপি চেয়ারপারসন খালেদা জিয়ার বিরুদ্ধে দুর্নীতির মামলা দায়েরের ক্ষেত্রে তিনি অতি উৎসাহী ভূমিকায় ছিলেন। ২০০৯ সালে আওয়ামী লীগ সরকার ক্ষমতায় আসার পর বিএনপি আমলের গুরুত্বপূর্ণ পদে দায়িত্ব পালনকারী সব কর্মকর্তার বিরুদ্ধেই মামলা দিয়েছে। ব্যতিক্রম ছিলেন অ্যাটর্নি জেনারেলের মতো গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্ব পালনকারী হাসান আরিফ। গত চার-পাঁচ বছর ধরে তিনি আওয়ামী লীগপন্থী আইনজীবীদের সঙ্গেই বেশি ঘনিষ্ঠ ছিলেন। এমনকি শেখ হাসিনা সুপ্রিম কোর্ট বার অ্যাসোসিয়েশনের সভাপতি পদে প্রার্থী হওয়ার জন্য তাকে অনুরোধ করেছেন বলেও হাসান আরিফ প্রচার করেছিলেন। তিনি কীভাবে গণ-অভ্যুত্থানের মাধ্যমে গঠিত সরকারে স্থান পেলেন, সেটি আমাদের বিস্মিত করেছে।’

সুপ্রিম কোর্টের অন্তত পাঁচজন গুরুত্বপূর্ণ আইনজীবী প্রায় একই ধরনের মন্তব্য করলেও পেশাগত কারণে তারা নাম উদ্ধৃত করে বক্তব্য দিতে চাননি। তারা বলছেন, অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের উপদেষ্টা পদে হাসান আরিফের উপস্থিতি অস্বস্তিকর। ২০০৭-০৮ সালের তত্ত্বাবধায়ক সরকার ছিল ভারত সমর্থিত। বর্তমান সরকারের উপদেষ্টা হিসেবে তিনি কোনো পক্ষের এজেন্ডা বাস্তবায়নের হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহৃত হন কিনা সেটিই আমাদের সবচেয়ে বড় ভয়।

তবে এসব বিষয়ে চেষ্টা করেও হাসান আরিফের বক্তব্য জানা সম্ভব হয়নি। তার সেলফোনে একাধিকবার কল করলেও তিনি রিসিভ করেননি। ক্ষুদে বার্তা পাঠালেও তিনি সাড়া দেননি।

বাংলাদেশ সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী হাসান আরিফের জীবন-বৃত্তান্ত ঘেঁটে দেখা যায়, তার জন্ম, বেড়ে ওঠা, পড়ালেখা কলকাতায়। ১৯৪১ সালের ১০ জুলাই কলকাতায় জন্মগ্রহণ করেন তিনি। কলকাতার সেন্ট জেভিয়ার্স কলেজ থেকে মাধ্যমিক এবং উচ্চ মাধ্যমিক শিক্ষা সম্পন্ন করেন। এরপর কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে স্নাতক ও এলএলবি ডিগ্রি নেন। ১৯৬৭ সালে আইনজীবী হিসেবে তার কর্মজীবনের শুরুটাও কলকাতা হাইকোর্টে। ১৯৭০ সালে তিনি ঢাকা হাইকোর্টের আইনজীবী হিসেবে তালিকাভুক্ত হন। ১৯৮২ সালের এপ্রিলে অ্যাসিস্ট্যান্ট অ্যাটর্নি জেনারেল পদে নিয়োগ পান তিনি। ১৯৮৫ সালের আগস্ট পর্যন্ত এ পদে দায়িত্ব পালনের পর ওই বছর ডেপুটি অ্যাটর্নি জেনারেল পদে পদোন্নতি পান। ১৯৯৬ সালের মার্চ পর্যন্ত প্রায় ১১ বছর এ পদে নিয়োগপ্রাপ্ত ছিলেন। 

২০০১ সালে বিএনপি নেতৃত্বাধীন চারদলীয় সরকার ক্ষমতা গ্রহণের পর হাসান আরিফকে অ্যাটর্নি জেনারেল পদে নিয়োগ দেয়া হয়। ওই বছরের অক্টোবর থেকে ২০০৫ সালের এপ্রিল পর্যন্ত সরকারের প্রধান ও মুখ্য আইন পরামর্শকের এ পদে ছিলেন তিনি। অ্যাটর্নি জেনারেল হিসেবে হাসান আরিফের বিতর্কিত ও সমালোচিত ভূমিকার মধ্যে ছিল বেসরকারি একুশে টেলিভিশন বন্ধের মামলা। ২০০২ সালের ২৯ আগস্ট আদালতের নির্দেশে একুশে টেলিভিশন বন্ধ করে দেয়া হয়েছিল। 

এক-এগারোর বিশেষ সরকারের সময়ে ‘জাতীয় নিরাপত্তা পরিষদ’ গঠনের মতো হঠকারী সিদ্ধান্ত নেয়া হয়। এ পরিষদ গঠনের পক্ষে জনমত গড়ে তুলতে ভূমিকা রাখেন হাসান আরিফ। যদিও ওই সময় কোনো শত্রুরাষ্ট্র দেশে আক্রমণ করবে, সে রকম কোনো সম্ভাবনাই ছিল না। ২০০৭-০৮ সালের তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সময়ে রাজনৈতিক নেতা ও ব্যবসায়ীদের বিরুদ্ধে গণহারে মামলা দায়ের করা হয়। আইন মন্ত্রণালয়ের দায়িত্বপ্রাপ্ত উপদেষ্টা হিসেবে সেসব মামলার মুখ্য ভূমিকায়ও ছিলেন তিনি।

নাগরিক ঐক্যের সভাপতি মাহমুদুর রহমান মান্না মনে করেন, ‘ড. মুহাম্মদ ইউনূসের নেতৃত্বাধীন অন্তর্বর্তী সরকার প্রতিষ্ঠিত হয়েছে ছাত্র-জনতার লড়াই ও রক্তের ওপর ভর করে। এ সরকারের ওপর দেশের জনগণের আস্থা ও প্রত্যাশা অনেক বেশি। গণ-অভ্যুত্থানের পর গঠিত একটি সরকারে কোনো বিতর্কিত ব্যক্তি না থাকলেই ভালো হতো। এতে সরকারের কর্মকাণ্ড ও সিদ্ধান্তের ওপর মানুষের আস্থা আরো দৃঢ় থাকত। ’

মাহমুদুর রহমান মান্না বলেন, ‘হাসান আরিফ একজন বিজ্ঞ ও দক্ষ আইনজীবী হিসেবে পরিচিত। এক-এগারোর সরকারে তার ব্যক্তিগত ভূমিকা কী ছিল, সে সম্পর্কে আমরা জ্ঞাত নই। তবে তার মতো একজন আইনজীবী বাধ্য হয়ে কিংবা না বুঝে কোনো সিদ্ধান্ত নিয়েছেন, সেটিও বিশ্বাসযোগ্য নয়।’


এই বিভাগের আরও খবর

আরও পড়ুন