বাংলাদেশের অভ্যুত্থান পরবর্তী পরিস্থিতি তিউনিসিয়া বা মিসরের দিকে যাবে না

ছবি : বণিক বার্তা

রাষ্ট্রচিন্তাবিদ, তাত্ত্বিক ও রাজনীতিবিদ বদরুদ্দীন উমর। পারিবারিকভাবে রাজনৈতিক উত্তরাধিকার বহনকারী বদরুদ্দীন উমর রাজনীতি ও গবেষণায় সম্পৃক্ত রয়েছেন ৫৩ বছর ধরে। দেশের রাজনীতি, সমাজনীতি, সংস্কৃতিসহ নানা বিষয়ে শতাধিক বই রয়েছে তার। দেশের চলমান অর্থনীতি, আইন-শৃঙ্খলা ও রাজনীতি নিয়ে কথা বলেছেন বণিক বার্তার সঙ্গে। সাক্ষাৎকার নিয়েছেন আনিকা মাহজাবিন

আরব বসন্তের পর মিসর-তিউনিসিয়ার ভাগ্যে যা ঘটল বাংলাদেশের পরিণতি কি সেদিকে গড়াবে? 

তিউনিসিয়ায় দীর্ঘ ২৩ বছর ধরে ক্ষমতা দখল করে রেখেছিল জাইন আল-আবিদিন বেন আলী। খাদ্যের উচ্চ মূল্যস্ফীতি, দুর্নীতি ও ক্রমবর্ধমান বেকারত্ব গ্রাস করে ফেলেছিল তিউনিসিয়াকে। এরই প্রতিঘাতে ২০১১ সালে নিজের শরীরে আগুন দিয়ে আত্মাহুতি দেন ফলবিক্রেতা বুআজিজি। তার মৃত্যুর ঘটনায় ক্ষুব্ধ হয়ে ওঠে তিউনিসিয়ার জনগণ। সেই ক্ষোভই গণ-অভ্যুত্থানে রূপ নেয়। তিউনিসিয়ায় যা হয়েছে সেটি দীর্ঘদিনের নির্যাতনের বিরুদ্ধে ও স্বাধীনতার অভাবে। কাছাকাছি সময়ে আন্দোলন হয়েছে মিসরের স্বৈরশাসকদের বিরুদ্ধে। কিন্তু মিসরে কোনোদিন কোনো নির্বাচিত সরকার থাকেনি। আরব বসন্তের পরে মুসলিম ব্রাদারহুডের হাতে ক্ষমতা গেল। পর মুসলিম ব্রাদারহুডকে হটিয়ে মিলিটারি ডিক্টেটর ক্ষমতা নিল। আরব বসন্ত বলে যা ঘটেছিল সেখানে কোনো সামাজিক বিপ্লব হয়নি। কেবল অভ্যুত্থানের মাধ্যমে শাসককে ফেলে দেয়া হয়েছিল। কিন্তু পরে সেই একই অবস্থায় ফিরে যায়। আগের চেয়ে আরো কঠিনভাবে মিলিটারি শাসন শুরু হয়েছে। 

বাংলাদেশের পরিণতি মিসর, তিউনিসিয়া বা অন্য দেশের মতো হবে না। মিসরের ইতিহাসের কথা আগেই বলেছি, সেখানে কখনই নির্বাচিত সরকার থাকেনি। আমাদের এখানে তেমন না। আমাদের তো ১৯৯০ সালের পর থেকে ২০০৬ সাল পর্যন্ত গণতন্ত্র ছিল। আমাদের গণতান্ত্রিক ঐতিহ্যের জন্য বাংলাদেশের পরিণতি মিসরের মতো হবে না। এটার সম্ভাবনা নেই। 

তাহলে কি সামনের দিনে বিএনপিকে ঘিরে এককেন্দ্রিক রাজনীতি শুরু হতে পারে? 

না। তারা হাসিনার মতো এত বেশি নির্যাতন করতে পারবে না। বিভিন্ন দেশের সঙ্গে সম্পর্ক উন্নয়নে কাজ করবে। এখন বিএনপি সবচেয়ে বড় দল। নির্বাচন হলে তারা যে ক্ষমতায় আসবে এতে কোনো সন্দেহ নেই। তারা এসে দেশের কী করবে? আমেরিকার সঙ্গে তাদের সম্পর্ক ভালো হবে, এমনটা আশা করা যায়। এমনকি ভারতের সঙ্গেও সম্পর্ক আরো ভালো করার চেষ্টা করবে। ভারতকে তো অবজ্ঞা করার কোনো উপায় নেই। সেটিকে বাংলাদেশ অস্বীকার করতে পারবে না। বিশেষ করে সংস্কৃতির ক্ষেত্রে এবং এখানকার বুদ্ধিজীবীদের মধ্যে ভারতের যে প্রভাব আছে তা নির্মূল হয়ে যাবে তা তো না। সেটি থাকবে। কিন্তু আগেকার মতো ভারতের অধীন হয়ে যাবে বাংলাদেশ, সেটি হবে না। আমেরিকার প্রভাব থাকবে। চীনেরও প্রভাব থাকবে। কিন্তু ভারত ও আমেরিকার মতো এতটা প্রভাব থাকবে না।

আইন-শৃঙ্খলা পরিস্থিতি এখনো অনুকূলে আনতে পারেনি সরকার। এর কারণ কী?

আইন-শৃঙ্খলা পরিস্থিতি উন্নতি না ঘটার বড় একটি কারণ হলো হাসিনার ফ্যাসিজম। দীর্ঘদিন ধরে মানুষের কিছু করার সুযোগ ছিল না। এখন একটা গণতান্ত্রিক পরিবেশ সৃষ্টি হওয়ায় মানুষের ওপর সরকারি আক্রমণ নেই। সাধারণ মানুষ আন্দোলন করেছে। কিন্তু কিছু দুষ্কৃতকারী সুযোগ নিয়ে নানা রকম লুটপাট, বদমায়েশি করছে। মন্দির ভাঙা থেকে মাজার আক্রমণ—নানা কাজ করছে। মব ভায়োলেন্স বলে একটা কথা আছে। এর মানে কতগুলো দুষ্ট প্রকৃতির লোক মিলে এ মব সংগঠিত করে। এই যে উচ্ছৃঙ্খলতা, এর আরেকটি বড় কারণ হচ্ছে ছাত্রদের যে কোটা আন্দোলন আর জনগণের অভ্যুত্থান—এটি কোনো শক্তিশালী রাজনৈতিক দলের দ্বারা পরিচালিত হয়নি এবং কোনো শক্তিশালী রাজনৈতিক দলের নিয়ন্ত্রণেও নেই। নিয়ন্ত্রণে থাকলে তারা বিশৃঙ্খলা নিয়ন্ত্রণ করতে পারত। 

বিএনপি বলছে যে এটা করো না সেটা করো না, সরকারও বলছে কিন্তু তাদের এমন কোনো নিয়ন্ত্রণ বা প্রভাব জনগণের ওপর নেই যে তারা কোনো কথা বললে জনগণ সেটা শুনবে। কাজেই এ অবস্থায় মানুষ স্বাধীনতা পেয়ে তা ব্যবহারও করবে, অপব্যবহারও করবে। একটা মুক্ত পরিবেশ তৈরি হয়েছে। এ মুক্ত পরিবেশে যেমন ভালো কাজ হচ্ছে, তেমনি কিছু দুষ্কৃতকারী খারাপ কাজ করারও সুযোগ পাচ্ছে এবং সেটি নিয়ন্ত্রণ করার মতো কোনো সরকারি প্রতিষ্ঠান ঠিক নেই। আবার কোনো রাজনৈতিক দলও নেই। কাজেই এখানে বিশৃঙ্খলা হচ্ছে। আর এ বিশৃঙ্খলা কতদিন চলবে তা বলা যায় না। হয়তো কিছুদিন যাবে এরপর এটি নিয়ন্ত্রণে আসবে। কিন্তু আবার যদি দেখা যায় যে কারো নিয়ন্ত্রণে কাজ হচ্ছে না তাহলে অবস্থা আরো খারাপ হবে।

সংবিধান মুজিববাদের ওপর তৈরির কথা টেনে অনেকেই পুনর্লিখনের কথা বলছে। আপনিও কি তাই মনে করেন?

আমি মনে করি, এসব স্থূলবুদ্ধি মানুষের কথায় আমল দেয়ার দরকার নেই। মুজিববাদ মানে কী? গুণ্ডামি, বদমায়েশি, ফ্যাসিজম। মুজিব নিজেই জানত না যে মুজিববাদ কাকে বলে।

সংবিধান পুরো ফেলে দিতে হবে। এ সংবিধান প্রথম ধর্ষণ করেছিল শেখ মুজিব, জঘন্যভাবে ধর্ষণ করেছিল। তারপর জিয়াউর রহমান, এরশাদ, হাসিনা ধর্ষণ করতে করতে এমন জায়গায় নিয়ে গেছে যে এটার সংস্কার করার কিছু নেই। এটি ফেলে দিয়ে নতুন একটা সংবিধান করতে হবে।

আর ১৯৭২ সালের সংবিধান এটাও পুরো বেআইনি ছিল। এ সংবিধান যে সভা রচনা করেছিল, তা ভুয়া ছিল। একাত্তর সালে মুক্তিযুদ্ধের মতো একটা ঘটনা ঘটার পর নতুন স্বাধীন দেশের সংবিধান রচনার জন্য একটা গণতান্ত্রিক সংবিধান সভা নির্বাচন করা দরকার ছিল। সেটা না করে শেখ মুজিব পাকিস্তান আমলে, ইয়াহিয়ার আমলে সত্তর সালে যে নির্বাচন হয়েছিল, সেটার কেন্দ্রীয় ও প্রাদেশিক সদস্য মিলে একটা অর্ডিন্যান্সের মাধ্যমে সংবিধান সভা করেছিল। এটা একটা আশ্চর্য ব্যাপার। ফলে একাত্তর সালে মুক্তিযুদ্ধের মাধ্যমে মানুষের চিন্তা-চেতনা, মানসিকতায় যে পরিবর্তন এসেছিল, তার কোনো প্রতিফলনই এ সংবিধান সভায় নেই। 

কাজেই প্রথমত সংবিধান সভাটিই বেআইনি ছিল। দ্বিতীয়ত, ওই সংবিধানের মধ্যে যা ছিল, আমি তখনই সেটির সমালোচনা করে অনেক কিছু লিখেছিলাম। বড়াই করে বলছি না, আমার বইয়েও কিন্তু লেখা আছে। আমি বলেছিলাম যে এটার ৭০ নম্বর ধারা অনুযায়ী প্রধানমন্ত্রীকে সরকারপ্রধান করে রাখা হয়েছে, এটা থাকা যাবে না। কারণ শেখ মুজিবের যে ক্ষমতা, এর কারণে শেষ পর্যন্ত এটা প্রেসিডেন্সিয়াল সিস্টেম হবে এবং আরো কী কী হবে বলেছিলাম যেগুলো পরে হয়েছিলও। আমি যে এগুলো গণক ঠাকুরের হিসাবে বলেছিলাম তা নয়, আমি মার্ক্সিস্ট অ্যানালাইসিসের ভিত্তিতেই বলেছিলাম কোন ঘটনা কীভাবে হবে, ডেভেলপমেন্টটা কীভাবে হবে। এখনো পড়ে দেখা যেতে পারে যা আমি বলেছিলাম। পরবর্তীকালে কী হয়েছিল এবং কতদিনের মধ্যে হয়েছে। যেমন এবারো ৭ জুলাই বলেছিলাম তাড়িয়ে দিতে হবে। তবে এটা ভাবিনি যে এক মাসের মধ্যে এটা ঘটবে। আমি মনে করেছিলাম, যে অবস্থা দাঁড়িয়েছে জনগণ আওয়ামী লীগকে মেরে তাড়িয়ে দেবে। 

আন্তর্জাতিক অপরাধ (ট্রাইব্যুনাল) আইন ১৯৭৩ যুগোপযোগী করতে আইনটির ৮টি ধারার একটিতে আওয়ামী লীগকে সংশোধনে খসড়া প্রস্তাব উপস্থাপন করা হয়েছে। মওলানা ভাসানী আওয়ামী লীগ থেকে বেরিয়ে না গেলে আজকে আওয়ামী লীগের এ পরিণতি হতো কি?

মওলানা বেরিয়ে যাওয়ার পর আওয়ামী লীগ আরো দক্ষিণপন্থী হয়ে গেল। আওয়ামী লীগের তথাকথিত বামপন্থী যে অংশটি ছিল তারা যদি থাকত তাহলে আওয়ামী লীগ একেবারে শেখ মুজিবের অধীনে গিয়ে এ রকম ফ্যাসিস্ট সংগঠনে পরিণত হতো না। 

১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধে ভারতের বুদ্ধিজীবীদের ভূমিকা আর ২০২৪ সালে তাদের ভূমিকা নিয়ে আপনার মূল্যায়ন জানতে চাই।

ভারতের পশ্চিম বাংলার ছাত্ররা এ আন্দোলনে সমর্থন করেছিল। কিন্তু সাধারণভাবে ভারতে লেখক-বুদ্ধিজীবীরা এ জুলাইয়ের আন্দোলন এবং অভ্যুত্থানের পক্ষে কেউ কথা বলেনি। চুপ থেকেছে। অরুন্ধতী রায়ের মতো একজন লেখক। তিনি ভারতের কাশ্মীরে এবং ভারতের বাইরে অনেক রকম অত্যাচার যে হয়েছে সেগুলোর বিরুদ্ধে কঠোর সমালোচনা করেছেন। উনি কিংবা পশ্চিম বাংলার বুদ্ধিজীবীরা বাংলাদেশের ক্ষেত্রে কথা না বলে ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদিকে একভাবে সাহায্য করেছেন। এ বুদ্ধিজীবী ও বামপন্থী রাজনৈতিক দল এ নিয়ে কোনো বিবৃতি দেয়নি। তার কারণ তাদের সবারই বাংলাদেশের ব্যাপারে কলোনিয়াল মাইন্ডসেট আছে। তারা সবাই চায় বাংলাদেশে ভারতের প্রভাব থাকুক, ঢাকা নয়াদিল্লির আয়ত্বের মধ্যে থাকুক। সেটি চলে যাওয়ায় তারা না পারছে কিছু বলতে কিংবা করতে, এজন্য চুপ মেরে আছে। 

একাত্তরে লেখক-বুদ্ধিজীবীরা বাংলাদেশের পক্ষে ছিল এ কারণে যে যুদ্ধের মূল পরিচালক ভারত। যুদ্ধ শেষে ভারতের এক ধরনের প্রভাবের আওতায় থাকবে নতুন দেশটি। এখন ঠিক উল্টো ব্যাপার ঘটেছে। ভারতের হাতছাড়া হয়ে গেছে বাংলাদেশ। সেজন্য তখন যারা মুক্তিযুদ্ধকে সমর্থন করেছিল এখন আর তারা এটিকে সমর্থন করে না। এটি নিশ্চিতভাবে তাদের একটি কলোনিয়াল মাইন্ডসেট।

ছাত্ররা কি নতুন দল গড়ার পথে এগোবে? তাদের সফলতার সম্ভাবনা কেমন দেখছেন?

নতুন দল তৈরি হতে পারে। শোনা যাচ্ছে ছাত্ররাও হয়তো একটি দল করতে পারে। ছাত্র বলে তো কিছু নেই। একটি দল তৈরি হতে গেলে একটি ভিত্তি থাকতে হবে, শ্রেণী ভিত্তি থাকতে হবে। ছাত্র মানে মধ্যবিত্ত। এখন যদি কিছু ছাত্র মিলে একটি দল দাঁড় করায় এ দল থাকবে না। ছাত্ররা কোটা আন্দোলন করে একটি ঐতিহাসিক ঘটনা ঘটিয়েছে। কিন্তু ছাত্ররা যদি এখন একটি দল দাঁড় করায় তাহলে তারা তখন কতগুলো নিয়মের অধীন হয়ে পড়বে। তাদের যে একেবারে হৈ হৈ রৈ রৈ করে বিকাশ ঘটবে এটা মনে করার কোনো কারণ নেই। একটি রাজনৈতিক দল হলে তারা যে একটি শক্তিশালী সংগঠনে পরিণত হবে, তা মনে করি না।

মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণে হিমশিম খাচ্ছে অন্তর্বর্তী সরকার। কেন মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণে আসছে না? 

ছাত্রাবস্থা থেকে একটা ইস্যু দেখেছি সেটি হলো জিনিসপত্রের দাম বাড়তি। সেই তখন থেকে আজ পর্যন্ত এটিই রয়েছে। যখন চালের দাম বারো আনা সের ছিল তখনো জিনিসপত্রে দাম বাড়ার বিষয়টি ছিল। আর এখন নাজিরশাইল চালের দাম ৮৫ টাকা কেজি। এখনো মূল্যবৃদ্ধির ইস্যু। এর মানে ব্যবসায়ীদের যে চক্র এ রকম সমাজ ব্যবস্থায় স্বাভাবিক চলছে এখানে। সারা দুনিয়াজুড়ে মূল্যবৃদ্ধি হয়েছে। ছাত্র অবস্থায় বিলেতে দুপুরের খাবার খেতাম আড়াই স্টার্লিং আর ডিনার খেতাম তিন স্টার্লিংয়ে। আর এখন সামান্য খেলেও ৫-৬ পাউন্ড চলে যায় আর ডিনার খেলে ১০-১৫ পাউন্ড। সব জায়গায়ই মূল্যবৃদ্ধি হয়েছে নানা কারণে। যেমন অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি, অগ্রগতি এসবের ভিত্তিতে হয়। কিন্তু আমাদের এখানে তা হয় না। 

এখানে কৃত্রিমভাবে মূল্যবৃদ্ধি হয়। যে পরিমাণে মূল্যবৃদ্ধি হয় সেই বাস্তব পরিস্থিতি এমন থাকে না। এখানকার মূল্যবৃদ্ধির ওপরে এখানকার অর্থনীতিবিদরা নানা রকম আলোচনা করছেন। সেই আলোচনাগুলো পড়ে আমার রবীন্দ্রনাথের ‘জুতা আবিষ্কার’ কবিতার কথা মনে পড়ে। কিন্তু সেই অবস্থার মধ্যে তারা এ কথাও বলছেন যে এখন যে অবস্থা তার মধ্যে এটি নিয়ন্ত্রণ করাও মুশকিল আছে। এসব পথ বাতলায় তারা। এখনকার ব্যবসায়ীরা তাদের যে সিন্ডিকেট রয়েছে, তারা যেসব জিনিসপত্র গুদামজাত করে রেখেছে, ছাড়ছে না—এটা তো তাদের পুরনো কায়দা। 

১৯৪৩ সালেও যখন দুর্ভিক্ষ হয় তখনো খাদ্যদ্রব্য থাকা সত্ত্বেও গুদামজাত করে রেখেছিল, ছাড়েনি। অল্প বিক্রি করে বেশি টাকা মুনাফা করেছে। এখনো তারা গুদামজাত করছে। সাপ্লাই চেইন নিয়ন্ত্রণ করছে। এর পাশাপাশি অন্যরা যেমন বলে থাকে তেমনি তারা বলছে যে ধর্মঘট, বন্যার জন্য চলাচল বিঘ্নিত হওয়ার কারণে এখানে জিনিসপত্রের দাম বাড়ছে। এর পাশাপাশি ব্যবসায়ী শ্রেণী যে বাজার নিয়ন্ত্রণ করছে এ কর্মকাণ্ড সম্পর্কেও বলছে। তাদের নিয়ন্ত্রণ করতে সেটি বলছে। 

সাধারণ মানুষ বাজারে অস্থিরতায় কষ্টে আছে। দ্রব্যমূল্য নিয়ন্ত্রণে অন্তর্বর্তী সরকারকে আপনি কী পরামর্শ দেবেন? 

১৯৫২ সালের ভাষা আন্দোলনের ওপর আমি যে বই লিখেছি সেখানে তৃতীয় খণ্ডে দুর্ভিক্ষের ওপর লেখা আছে। তখন যে মূল্যবৃদ্ধি হয়েছে তা কমাতে গেলে বা চালের দাম নিয়ন্ত্রণ করতে গেলে কী করতে হবে সে আলোচনা আছে। সে সময় নুরুল আমিন সরকার রেশনিং ব্যবস্থা করেছিল। এটি ব্রিটিশ আমলেও ছিল। সে সময় শুধু চাল-ডাল না বরং খাতা, সাটিন কাপড় ইত্যাদিও ছিল।

পাকিস্তান আমলেও কিছু আংশিকভাবে রেশনিং ব্যবস্থা ছিল। সে সময় নুরুল আমিন রেশনিং চালু করেছিলেন ঢাকা শহরে। তখন অনেকেই বলেছিল ঢাকা শহরের লোকদের ক্রয়ক্ষমতা আছে। গ্রামে গরিবদের মধ্যে রেশনিং না চালু করে এখানে চালু করা হলো কেন। নুরুল আমিন সাহেব সঠিক কাজ করেছিলেন। কারণ এখানে রেশনিং ব্যবস্থা থাকলে এখানে আর মূল্য বেশি হবে না। কম মূল্যে রেশনিংয়ে জিনিসপত্র দেয়া হবে। কাজেই বেশি পয়সায় তারা বিক্রি করতে পারবে না। এটির প্রভাব গ্রামাঞ্চলেও পড়েছিল। এখনো মূলত এ জিনিস আছে। 

এখানে অর্থনীতিবিদরা এটা-সেটা করো বলছে কিন্তু এটিও বলছে যে তাদের দিয়ে করানো যাচ্ছে না। এখন তো সরকার জিনিসপত্রের দাম বেঁধে দিয়েছে। কিন্তু তাদের বেঁধে দেয়া দামে জিনিসপত্র বিক্রি হচ্ছে না। ডিমের দাম করেছে ৪৭-৪৮ টাকা হালি কিন্তু বিক্রি হচ্ছে ৫৫ টাকা। চাল, তেল, চিনির দামেও একই অবস্থা। এটিকে এক হিসেবে বলতে হবে সেলার্স মার্কেট, সেলার যে দাম চাইবে সেই অনুসারে বায়ারকে নিতে হবে। বায়ারের কোনো চয়েস নেই। এটি করে তারা অতিরিক্ত মুনাফা করছে। এমন পদক্ষেপ নিতে হবে যাতে তাদের কোনো হাত না থাকে। ইতিবাচকভাবে কাজ করতে হবে আর সেটিই হলো রেশনিং। 

এখন যেটা দরকার সেটা হলো ঢাকাসহ অন্য শহরগুলোয় ব্যাপকভাবে রেশনিং চালু করে দেয়া। প্রথমত চাল, তার সঙ্গে সম্ভব হলে আটা, ডাল ও চিনি এ রকম জিনিসের রেশনিং। এটি করলে মূল্য নিয়ন্ত্রণের মধ্যে থাকবে। মূল্য এ জায়গায় নিয়ন্ত্রণ করতে পারলে এখানে যে মূল্য আছে তারা এর চেয়ে বেশি দামে বাইরে বিক্রি করতে পারবে না। মূল্য স্বাভাবিকভাবেই কমে যাবে। কাজেই এখানে বলতে হবে যে রেশনিং প্রথার মাধ্যমে খাদ্যমূল্য নিয়ন্ত্রণ করতে হবে। এ উদ্যোগের নাটাই ব্যবসায়ীদের হাতে থাকছে না, থাকছে সরকারের হাতে। 

রেশনিং ব্যবস্থা চালুতে কী প্রয়োজন?

এখানে সবচেয়ে জরুরি সরকারের ইচ্ছে আছে কিনা। এখানে অবশ্যই বড় অংকের বিনিয়োগ প্রয়োজন। বিনিয়োগের প্রয়োজন হলে বিনিয়োগ করা চাই। কত আজেবাজে কাজে সরকারি বিনিয়োগ হয়েছে। শেখ হাসিনার সময়ে দেখা গেল যে যুক্তরাষ্ট্রে উৎসব করেছে। বাংলাদেশের ব্যাপার নিয়ে নিউইয়র্কে উৎসব করার কী হলো? শত শত লোক ওখানে ডলার উড়িয়ে গেল। 

মূল্যবৃদ্ধি সবাইকে প্রভাবিত করছে। তাই এটিকে নিয়ন্ত্রণের জন্য বিনিয়োগের প্রয়োজন হলে তাই করতে হবে। আগে ছিল প্রকিউরমেন্ট। যুদ্ধের সময় সিভিল সাপ্লাই মিনিস্ট্রি ছিল। ১৯৪৫-৪৬ সালে সোহরাওয়ার্দী সিভিল সাপ্লাই মন্ত্রী ছিলেন। এখন এ নামে কোনো ডিপার্টমেন্ট নেই। এটি করতে হবে। সিভিল সাপ্লাই ডিপার্টমেন্টই সবকিছু করবে। 

ফলে দ্রব্যমূল্য নিয়ন্ত্রণ হয়ে যাবে। এটি একটি গ্রহণযোগ্য জিনিস। ব্রিটিশ আমলে মূল্যবৃদ্ধি নিয়ন্ত্রণের জন্য এ রেশনিং ব্যবস্থা ছিল। এটি নতুন কিছু না। কিন্তু এ কথা এখানকার অর্থনীতিবিদদের মুখে শোনা যাচ্ছে না সেটিই খুব আশ্চর্যের বিষয়। তারা যা করছেন তা জুতা আবিষ্কারের মতো।

এই বিভাগের আরও খবর

আরও পড়ুন