দুই দশকে ভারতের চেয়েও চীন ও যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে বাংলাদেশের বাণিজ্য প্রবৃদ্ধি বেশি

বদরুল আলম

ছবি : বণিক বার্তা

অর্থমূল্য বিবেচনায় চীন, যুক্তরাষ্ট্র ও ভারতের সঙ্গেই সবচেয়ে বেশি দ্বিপক্ষীয় বাণিজ্য হয় বাংলাদেশের। এর মধ্যে যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে বেশি হয় রফতানি। অন্যদিকে চীন ও ভারত থেকে বেশি হয় আমদানি বাণিজ্য। মাঝে কোনো কোনো বছর আমদানি-রফতানি কমবেশি হলেও গড়ে এ দেশগুলোর সঙ্গে গত দুই দশকে বাংলাদেশের বাণিজ্য বেড়েছে। এশীয় উন্নয়ন ব্যাংকের (এডিবি) বিশ্লেষণ বলছে, এ সময়ে প্রতিবেশী ভারতের চেয়েও বাংলাদেশের বাণিজ্য প্রবৃদ্ধি বেশি হয়েছে যুক্তরাষ্ট্র ও চীনের সঙ্গে। 

বাণিজ্যসংশ্লিষ্টরা বলছেন, দুই দশক আগে রফতানির বাজার হিসেবে শুধু পশ্চিমা দেশগুলোই বেশি ভূমিকা রেখেছে। একক দেশ হিসেবে যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে বাংলাদেশের বাণিজ্যের ভূমিকা বেশি। গত এক দশকে রফতানি বাজারে কিছুটা বৈচিত্র্যও এসেছে। সে ধারাবাহিকতায় চীন ও ভারতের সঙ্গেও বেড়েছে বাংলাদেশের বাণিজ্য। খুব সামান্য হলেও চীনে বেড়েছে পণ্য রফতানি। তবে দেশটি থেকে আমদানি বেড়েছে বহুগুণ। আমদানি-রফতানি বাণিজ্য বেড়েছে ভারতের সঙ্গেও। তবে প্রতিবেশী দেশটির সঙ্গে এর একটি গুরুত্বপূর্ণ অংশ অনানুষ্ঠানিক পন্থায় হয় বলে তা আনুষ্ঠানিক বাণিজ্যের তথ্যে প্রতিফলিত হয় না। এসব কারণেই প্রবৃদ্ধি বিবেচনায় ভারতের চেয়ে যুক্তরাষ্ট্র ও চীনের সঙ্গে বাংলাদেশের বাণিজ্য বেশি হয়।

সম্প্রতি ‘ইভ্যালুয়েশেন অব এডিবি সাপোর্ট ফর দ্য সাউথ এশিয়া সাবরিজিওনাল ইকোনমিক কো-অপারেশন প্রোগ্রাম, ২০১১-২৩’ শীর্ষক মূল্যায়ন প্রতিবেদন প্রকাশ করেছে এডিবি। এতে দেখা যাচ্ছে, ২০০১-১২ সময়ে যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে বাংলাদেশের বাণিজ্য প্রবৃদ্ধি ছিল ১৩৭ শতাংশ। আর চীনের সঙ্গে ৬৬৭ ও ভারতের সঙ্গে ৩৭৩ শতাংশ ছিল। অর্থাৎ আলোচ্য সময়ে যুক্তরাষ্ট্রের চেয়ে প্রবৃদ্ধিতে এগিয়ে থাকলেও চীনের চেয়ে কম বাণিজ্য প্রবৃদ্ধি হয়েছে ভারতের সঙ্গে। এদিকে যুক্তরাজ্যের সঙ্গে এ সময় বাংলাদেশের বাণিজ্য প্রবৃদ্ধির হার ছিল ২২৮ শতাংশ। ভুটান, নেপাল ও শ্রীলংকার সঙ্গে বাণিজ্য প্রবৃদ্ধি হলেও পরিমাণ খুবই নগণ্য।

এডিবির প্রতিবেদনে ২০১২-২২ সময়েরও বাণিজ্য বিশ্লেষণ দেখানো হয়েছে। সে অনুযায়ী, গত এক দশকে যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে বাংলাদেশের বাণিজ্য প্রবৃদ্ধির হার ছিল ১৯৮ শতাংশ। এ সময় চীনের সঙ্গে ২৩০ ও ভারতের সঙ্গে বাণিজ্য প্রবৃদ্ধি ছিল ১৮৪ শতাংশ। অর্থাৎ এ সময়ে ভারতের চেয়ে যুক্তরাষ্ট্র ও চীনের সঙ্গে বাংলাদেশের বেশি বাণিজ্য প্রবৃদ্ধি হয়েছে। তবে ভুটানের সঙ্গে গত দশকে বাণিজ্য প্রবৃদ্ধি ঋণাত্মক বা নেতিবাচক ছিল। আর নেপাল ও শ্রীলংকার সঙ্গে বাংলাদেশের বাণিজ্য প্রবৃদ্ধি হলেও খুবই কম পরিমাণে আমদানি-রফতানি হয়েছে দেশগুলোর সঙ্গে।

জানতে চাইলে বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের সচিব মো. সেলিম উদ্দিন বণিক বার্তাকে বলেন, ‘আমাদের রপ্তানি উন্নয়ন ব্যুরোকে (ইপিবি) অ্যানালাইসিস করতে বলেছি। গত কয়েক বছরে বিভিন্ন দেশের সঙ্গে বাণিজ্য যেটা হচ্ছে, সেটার গতিপ্রকৃতি, বাজার, পণ্য—এ বিষয়গুলো নিয়ে একটা বিশ্লেষণ করার জন্য বলা হয়েছে। বিশ্লেষণগুলো হাতে আসার পরই এ বিষয়ে বিস্তারিত মন্তব্য করা সমীচীন হবে।’

বাংলাদেশ ব্যাংকের পরিসংখ্যান অনুযায়ী, ২০২২-২৩ অর্থবছরে অর্থমূল্যে বাংলাদেশ-যুক্তরাষ্ট্রের বাণিজ্য হয়েছে ১০ দশমিক ৬ বিলিয়ন ডলারের। একই সময়ে চীনের সঙ্গে বাণিজ্য হয়েছে প্রায় ১৮ বিলিয়ন ডলারের। এ সময় ভারতের সঙ্গে বাণিজ্যের আকার ছিল ১১ দশমিক ২ বিলিয়ন ডলার। 

বাণিজ্য বিশ্লেষকরা বলছেন, বাংলাদেশের রফতানি বাণিজ্য মূলত তৈরি পোশাককেন্দ্রিক। এ রফতানির বিপরীতে বিপুল পরিমাণ পণ্য আমদানি করতে হয়। চীন ও ভারত থেকে বাংলাদেশ কাঁচামাল আমদানি করে। আর পণ্য রফতানি করে পশ্চিমা বাজারগুলোয়, বিশেষ করে যুক্তরাষ্ট্রে। চীন থেকে বিপুল পরিমাণ কাঁচামাল আমদানি করলেও পণ্য রফতানি একেবারেই নগণ্য। আবার ভারত থেকে পণ্য আমদানি করলেও সেটা চীন থেকে কম। এছাড়া ভারতের সঙ্গে বাণিজ্যের উল্লেখযোগ্য একটি অংশ হয় অনানুষ্ঠানিকভাবে পন্থায়। পণ্য বৈচিত্র্যে ঘাটতি থাকার কারণে চীনেও পণ্য রফতানি প্রবৃদ্ধি একেবারে নগণ্য, যা মোট বাণিজ্য প্রবৃদ্ধিতে বড় প্রভাব ফেলতে পারেনি। 

সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগের সম্মাননীয় ফেলো অধ্যাপক মোস্তাফিজুর রহমান বণিক বার্তাকে বলেন, ‘যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে বাংলাদেশের বাণিজ্য বেড়েছে। তবে দেশটি মূলত বাংলাদেশী তৈরি পোশাক রফতানি গন্তব্য, সেখান থেকে আমদানি তেমন একটা করি না আমরা। ইউরোপীয় ইউনিয়ন থেকে আমাদের আমদানি ছিল, যা বাড়তে পারত কিন্তু সে জায়গাটি ভারত ও চীন নিয়েছে। কারণ তারা এরই মধ্যে প্রযুক্তি উন্নত করেছে। পণ্যের মান বেড়েছে। বাণিজ্য গতিশীল হয়েছে, দ্রুতই পণ্য আনা যায়। ফলে এ বিষয়গুলো দুই দেশের সঙ্গে বাণিজ্য বৃদ্ধিতে ভূমিকা রেখেছে। চীন আমদানি করে প্রতি বছর ২ হাজার ৮০০ বিলিয়ন ডলারের, ভারত আমদানি করে ৭০০ বিলিয়ন ডলারের, কিন্তু আমরা এ দুই গন্তব্যে রফতানি বাড়াতে পারিনি। এটাই হলো কাঠামোগত দিক থেকে আমাদের দুর্বলতা।’ 

ভারতের সঙ্গে বাংলাদেশের বাণিজ্যের প্রসঙ্গ টেনে মোস্তাফিজুর রহমান বলেন, ‘২০১১ সালে ভারত বাংলাদেশ থেকে পণ্য প্রবেশে শুল্কমুক্ত সুবিধা দেয়। ফলে আমাদের রফতানি বেড়েছে। বিলিয়ন ডলার অতিক্রম করতে যেখানে লেগেছে ৪৮ বছর, সেখানে ২ বিলিয়ন ডলার অতিক্রম করতে লেগেছে মাত্র চার বছর। অর্থাৎ শুল্ক ও কোটামুক্ত সুবিধা ভালো কাজে দিয়েছে। ভারতেরও ক্যাপাসিটি বেড়েছে, প্রযুক্তিগত সক্ষমতার উন্নয়ন হয়েছে। মানের ক্ষেত্রে প্রতিযোগিতা সক্ষমতা বেড়েছে। ফলে আমরা যেগুলো ইউরোপ থেকে আমদানি করতাম, এখন ভারত থেকে আনছি। সুতরাং কিছুটা আমদানি বিকল্প বা ট্রেড ডাইভারশনের ক্ষেত্র হয়েছে ভারত। এভাবে গত দশকে ভারত থেকে আমাদের আমদানিও বেড়েছে। দুই দিক বিবেচনায় ভারতের সঙ্গে বাংলাদেশের বাণিজ্যে প্রবৃদ্ধি রয়েছে।’ 

বাণিজ্যসংশ্লিষ্টরা বলছেন, যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে বাংলাদেশের রফতানি ও আমদানি দুটোই হচ্ছে। তবে আমদানি কম, রফতানিই বেশি। আর চীনের উৎপাদনমুখী শিল্পপণ্যের ব্যাপক চাহিদা রয়েছে বাংলাদেশে। বিশেষ করে বস্ত্র ও পোশাক খাতের মেশিনারি ও কাঁচামালের চাহিদা অনেক। ফলে দেশটি থেকে আমদানি বাড়ন্ত। আর ভারতের ক্ষেত্রে বাস্তবতা হলো বাংলাদেশে রফতানিযোগ্য অনেক পণ্য তাদেরই রয়েছে, সে তুলনায় দেশটিতে রফতানিযোগ্য পণ্য হাতে গোনা। 

আমেরিকান চেম্বার অব কমার্স ইন বাংলাদেশ (অ্যামচেম) সভাপতি সৈয়দ এরশাদ আহমেদ বণিক বার্তাকে বলেন, ‘যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে বাংলাদেশের রফতানি ও আমদানি দুটোই হচ্ছে। বাণিজ্য ভারসাম্যে আমরা লাভবান। সাম্প্রতিক অতীতে অবশ্য আমাদের আমদানি-রফতানি দুটোই কমেছে। চীন থেকে আমাদের আমদানি অনেক বেশি। যে কারণে চীনে বেশি প্রবৃদ্ধি দেখা যাচ্ছে। দেশটিতে বাংলাদেশের রফতানি খুবই নগণ্য। আর ভারতের সঙ্গে আনুষ্ঠানিকের চেয়ে অনানুষ্ঠানিক ব্যবসা বেশি হয়ে গেছে, যেটাকে বলে আন্তঃসীমান্ত অনানুষ্ঠানিক ব্যবসা। মানুষ দেখে ব্যবসা অনেক হচ্ছে। কিন্তু যখন বিভিন্ন উৎস থেকে তথ্য নিয়ে হিসাব করে তখন দেখা যায় রেকর্ডে আসেনি। অনানুষ্ঠানিক চ্যানেলে বাণিজ্যের প্রতিফলন মূল হিসাবে পাওয়া যাচ্ছে না। তাই যেকোনো দেশের সঙ্গে এ ধরনের অনানুষ্ঠানিক ব্যবসাকেও আনুষ্ঠানিক করে নেয়া প্রয়োজন।’  

চীনের সরকারি তথ্য অনুযায়ী, ২০০৩ থেকে ২০২৩ সাল পর্যন্ত–এ দুই দশকে ২ বিলিয়ন থেকে ২৮ বিলিয়ন ডলারে উন্নীত হয়েছে দেশটির বাণিজ্য। অর্থাৎ প্রবৃদ্ধি প্রায় ১ হাজার ৪০০ শতাংশ। এ তথ্য তুলে ধরে বাংলাদেশ-চায়না চেম্বার অব কমার্স অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রির (বিসিসিসিআই) সেক্রেটারি জেনারেল আল মামুন মৃধা বণিক বার্তাকে বলেন, ‘২০০৩ সালের আগে থেকে যদি দেখি তাহলে আমরা দেখব ওই সময় বাণিজ্য ও প্রবৃদ্ধি ছিল অনেক কম। এর পর থেকে শিল্পায়নের দিকে ধাবিত হয়ে দ্রুত আমরা প্রবৃদ্ধির পথে যেতে শুরু করি। চীনের বাজারও তখন বিশ্ববাজারের জন্য উন্মুক্ত হতে শুরু করে। গত দুই দশকে শিল্পায়নের একটা ঢল নামে, বিশেষ করে দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ায়। এ প্রেক্ষাপটে চীনের উৎপাদনমুখী পণ্য নিয়ে বাংলাদেশের সঙ্গে বাণিজ্য বাড়তে থাকে। বিশেষ করে বস্ত্র ও পোশাক খাতের মেশিনারি ও কাঁচামালের আমদানি বেড়ে যায়। সামগ্রিকভাবে বৈশ্বিক প্রেক্ষাপট ও বাংলাদেশের চাহিদা সব মিলিয়েই চীনের সঙ্গে বাণিজ্য বহুলাংশে বেড়েছে গত দুই দশকে।’ 

ভারতের সঙ্গে বাংলাদেশের বাণিজ্য প্রবৃদ্ধি আগের চেয়ে বেড়েছে বলে দাবি করেন ইন্ডিয়া বাংলাদেশ চেম্বার অব কমার্স অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রি (আইবিসিসিআই) কোষাধ্যক্ষ দেওয়ান সুলতান আহমেদ। বণিক বার্তাকে তিনি বলেন, ‘ভারতের সঙ্গে আমাদের বাণিজ্য প্রবৃদ্ধি আগের চেয়ে বেশি। সমস্যা হলো আমাদের রফতানির বাস্কেট ছোট। যার প্রতিফলন আছে বাণিজ্য প্রবৃদ্ধিতে। বাস্তবতা হলো ভারত যেভাবে আমাদের পণ্য দিতে পারে, আমরা ওইভাবে দিতে পারি না। ভারতে রফতানি হচ্ছে মূলত তৈরি পোশাক। প্রবৃদ্ধির পরিস্থিতি দুই বছর আগের চেয়ে এখন ভালো। আমাদের সেবা খাতকে যদি আমরা উন্নত করতে পারি তাহলে ভারতের সঙ্গে বাণিজ্য চিত্র আরো ভালো হওয়া সম্ভব। এটা সম্ভব না হলে দেশটির সঙ্গে বাণিজ্য প্রবৃদ্ধিতে আমরা সবসময় পিছিয়েই থাকব। এছাড়া আরেকটা কারণ হলো ভারতের সঙ্গে বাংলাদেশের অনানুষ্ঠানিক বাণিজ্য। এ ধরনের বাণিজ্যের কারণে ২০-২৫ শতাংশ প্রবৃদ্ধি নাই হয়ে যাচ্ছে।’

এই বিভাগের আরও খবর

আরও পড়ুন