অত্যাধুনিক ব্যাটারি উৎপাদন করছে

সাইফ পাওয়ারটেক

ছবি : সংগৃহীত

ব্যাটারি বলতে বেশির ভাগ মানুষ মূলত পেন্সিল ব্যাটারিকে চিনলেও ব্যাটারি আসলে প্রয়োজন অনুসারে বিভিন্ন আকারের হয়, যা গৃহস্থালি প্রয়োজন থেকে শুরু করে গাড়ির ইঞ্জিনেও ব্যবহার হয়। আগে বড় আকারের লেড অ্যাসিড ব্যাটারি আমদানি করা হলেও দেশের বিদ্যুৎ খাত, শিল্প খাত ও পরিবহন ব্যবস্থার ক্রমাগত বৃদ্ধির ফলে বর্তমানে বাংলাদেশেও ব্যাটারি নির্মাণ শিল্পের প্রসার দেখা দিয়েছে। প্রায় এক দশক ধরে এ শিল্পে নিজেদের অবস্থান প্রতিষ্ঠিত করেছে সাইফ পাওয়ারটেক। 

অত্যাধুনিক ব্যাটারি উৎপাদনকারী কারখানা মূলত একটি অ্যাডভান্সড কেমিক্যাল শিল্পপ্রতিষ্ঠান। এ-জাতীয় কারখানা নির্মাণের জন্য উপযুক্ত জায়গা নির্ধারণ করা অতীব জরুরি বিষয়। সে হিসেবে সাইফ পাওয়ারটেককে ফ্যাক্টরি বানানোর জন্য অনুপযোগী জায়গাকে উপযোগী করতে হয়েছে। ২০১৪ সালে গাজীপুরের পুবাইলে সাইফ পাওয়ারটেকের কারখানার প্রতিষ্ঠা করেন তরফদার মো. রুহুল আমিন। প্রতিষ্ঠাকালে কারখানার আকার ছিল ৭০ হাজার বর্গফুট, যা পর্যায়ক্রমে সম্প্রসারণ হয়ে ২ লাখ ৪৮ হাজার ৭৯২ বর্গফুটের বিশাল স্থাপনায় উন্নীত হয়েছে। প্রায় ৫ দশমিক ৭১ একর জমি নিয়ে কারখানাটির বর্তমান অবস্থান। প্রতিষ্ঠাকালে দক্ষ ও অদক্ষ প্রায় ১০০ শ্রমিক কর্মরত ছিলেন। বর্তমানে ছয় শতাধিক শ্রমিক কাজ করছেন।

এ ধরনের কারখানা নির্মাণে বৃহৎ বিনিয়োগ প্রয়োজন, যা সংস্থান করাই মুখ্য চ্যালেঞ্জ উদ্যোক্তাদের জন্য। উদ্যোক্তারা অর্থসংস্থানের উপায় হিসেবে ঢাকা স্টক এক্সচেঞ্জ ও চট্টগ্রাম স্টক এক্সচেঞ্জে পাবলিক শেয়ার এনলিস্টিংয়ের মাধ্যমে একটি বড় বিনিয়োগের ব্যবস্থা করেন। পাশাপাশি কারখানা বানানোর জন্য যে ধরনের বিদ্যুৎ সংযোগ প্রয়োজন ছিল তা অপ্রতুল থাকায় প্রায় দুই কিলোমিটার জায়গায় নিজস্ব অর্থায়নে বিদ্যুতিক খুঁটি স্থাপন করে কেবলের মাধ্যমে বিদ্যুৎ সংযোগ নেয়া হয়। ব্যাটারি ফ্যাক্টরি ভারী শিল্পপ্রতিষ্ঠান হওয়ায় বৈদ্যুতিক সংযোগের পাশাপাশি গ্যাস সংযোগ আবশ্যক। অধিক ব্যয়বহুল ও সরকারি ব্যবস্থাপনার জটিলতার কারণে কারখানায় এখন পর্যন্ত গ্যাস সংযোগ দেয়া সম্ভব হয়নি। ফলে সক্ষমতা থাকা সত্ত্বেও মূল সক্ষমতার ৩০ শতাংশের বেশি উৎপাদন করা সম্ভব হচ্ছে না। 

ব্যাটারি তৈরির জন্য প্রায় ৮০ শতাংশ দক্ষ শিল্পসংশিষ্ট শ্রমিক প্রযোজন রয়েছে, যা বাংলাদেশে সহজলভ্য নয়। এক্ষেত্রে কর্তৃপক্ষ বিভিন্ন সময়ে বিশেষ প্রশিক্ষণ, কাউন্সেলিং, হাতে হাতে প্রশিক্ষণ এবং বিস্তৃত শ্রম ও মানবসম্পদ উন্নয়ন প্রোগ্রামের মাধ্যমে শিল্প উপযোগী একটি বিশাল কর্মী বাহিনী গড়ে তোলে। উল্লেখ্য, ভারী শিল্প-কারখানা হওয়ায় সবার জন্য উপযুক্ত নিরাপত্তা ও স্বাস্থ্যগত সুবিধাদিকে প্রাধান্য দিয়ে ইন্ডাস্ট্রি পরিচালনা করতে হয়। স্পেশালাইজড অ্যাডভান্সড কেমিক্যাল শিল্প খাত হিসেবে কারখানার যন্ত্রপাতি সিলেকশন, সংগ্রহ, ইনস্টলেশন এবং সর্বোপরি প্রডাকশনে যাওয়া একটি বিশাল চ্যালেঞ্জের বিষয় ছিল নিঃসন্দেহে।

সাইফ পাওয়ারটেকের উদ্যোক্তারা বহু বছর ধরে দেশে বিভিন্ন ব্যবসা-বাণিজ্য প্রতিষ্ঠায় অগ্রণী ভূমিকা পালন করার মাধ্যমে অভিজ্ঞতা সঞ্চয় করেছেন। তার সম্পূর্ণটুকুই সাইফ পাওয়ারটেকের ব্যাটারি শিল্প-কারখানা প্রতিষ্ঠায় নিয়োজিত করার মাধ্যমে প্রতিষ্ঠানটি সব চ্যালেঞ্জ অতিক্রম করে আলোর মুখ দেখতে পায়।

আট বছর ধরে এ কারখানার মাধ্যমে বিভিন্ন পর্যায়ে একটি বিশাল শ্রমিক গোষ্ঠী (পাঁচ শতাধিক) গড়ে উঠেছে, যারা এ প্রতিষ্ঠান থেকে প্রাতিষ্ঠানিক বিশেষ দক্ষতা ও অভিজ্ঞতা অর্জনের পর দেশের বিভিন্ন ব্যাটারি ফ্যাক্টরিতে কর্মরত। ভবিষ্যতে উৎপাদন প্রক্রিয়া সম্প্রসারণের মাধ্যমে আরো এক হাজার শ্রমিকের কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা হতে পারে। কারখানায় শ্রমিকদের জন্য প্রতি শিফটে পর্যাপ্ত নাশতা এবং দুপুর অথবা রাতের খাবারের ব্যবস্থা করা হয়। প্রতিদিনের এ খাবারের জন্য শ্রমিকরা জনপ্রতি ২০ টাকা ও কর্তৃপক্ষ ১০০ টাকা হারে দেয়। পাশাপাশি রমজানে সম্পূর্ণ বিনামূল্যে ইফতার ও সাহরি দেয়া হয়। নাইট শিফটে কর্মরত কর্মকর্তা-কর্মচারীর জন্য অতিরিক্ত নাইট বিল দেয়া হয়। সব কর্মচারীকে দেয়া হয় প্রয়োজনীয় সেফটি ইকুপমেন্ট। কর্মরত অবস্থায় অসুস্থতা এবং যেকোনো দুর্ঘটনায় আক্রান্ত হলে কোম্পানি নিজ খরচে চিকিৎসার ব্যবস্থা করে থাকে। এছাড়া শ্রমিকদের প্রাথমিক চিকিৎসার জন্য সার্বক্ষণিক একজন মেডিকেল সহকারী চিকিৎসক রয়েছেন।

কারখানা প্রতিষ্ঠার পরপর প্রজেক্ট চলাকালে কিছুসংখ্যক চাইনিজ ও জার্মান প্রকৌশলী কাজ করেছেন। এরপর কারখানার পুরো জনগোষ্ঠীকে আন্তর্জাতিক মানের ব্যাটারি উৎপাদনের জন্য উপযুক্ত করে গড়ে তোলা হয়। এখন সাইফ পাওয়ারটেক বাংলাদেশী দক্ষ কর্মীদের মাধ্যমেই আন্তর্জাতিক মানের ব্যাটারি উৎপাদন করছে, যা দেশে-বিদেশে বিপুলভাবে সমাদৃত। তাছাড়া বিশেষ প্রয়োজনে আন্তর্জাতিক বাজার থেকে অনলাইনে বিভিন্ন ধরনের সাপোর্ট নেয়া হয়।

সাইফ পাওয়ারটেক লিমিটেডের কারখানায় আন্তর্জাতিক মানসম্পন্ন মেশিনারিজ বিভিন্ন ইউনিটে ব্যবহার করে সর্বোচ্চ মানসম্পন্ন ব্যাটারি উৎপাদন হচ্ছে। ইউনিটভিত্তিক কিছু যন্ত্রপাতি সম্পর্কে সংক্ষিপ্ত ধারণা দেয়া হলো—

গ্রিড কাস্টিং: আমেরিকান মেশিন Wirtz-এর মাধ্যমে মানসম্পন্ন গ্রিড উৎপাদন করা হয়। Pressure Die Casting (PDC) মেশিনের মাধ্যমে ক্ষয় রোধকারী পজিটিভ স্পেশাল গ্রিড উৎপাদন করা হয়। 

অ্যাসেম্বলি: ইউরোপিয়ান অত্যাধুনিক JIH HSING অ্যাসেম্বলি লাইনের মাধ্যমে ব্যাটারি উৎপাদন হয়। বিশ্ববিখ্যাত জার্মান টেকনোলজি ও ডিগাট্রন চার্জিংয়ের (Digatron Charging Unit) মাধ্যমে সব ব্যাটারি চার্জ করার জন্য কারখানাকে সমৃদ্ধ করা হয়েছে।

ACS চার্জিং: বাংলাদেশে একমাত্র সাইফ পাওয়ারটেক সর্বপ্রথম জার্মানির ACS অটোমেটিক চার্জিং সিস্টেমের মাধ্যমে ব্যাটারি চার্জিং কার্যক্রম সম্পন্ন করে। 

কিউএ ল্যাব: অত্যাধুনিক মেশিনারিজসমৃদ্ধ কোয়ালিটি অ্যাসুরেন্স ল্যাবের মাধ্যমে ইনকামিং ম্যাটেরিয়ালের (যেমন: সিসা, অ্যাসিড ও রেড অক্সাইড) গুণাগুণ এবং জার্মানির ICP-OES মেশিন দ্বারা পরীক্ষার মাধ্যমে গুণাগুণ নিশ্চিত করা হয়।

সাইফের উৎপাদিত ব্যাটারি দেশের বাজার ছাড়িয়ে সার্কভুক্ত দেশ এবং মধ্যপ্রাচ্যের গালফ অঞ্চলের দেশেও রফতানি হয়েছিল। বর্তমানে কাঁচামালস্বল্পতা এবং এলসির লিমিটেশনের কারণে রফতানি সাময়িকভাবে বন্ধ রয়েছে। দেশের বাজারে সাইফ পাওয়ারটেকের ব্যাটারি প্রায় ৫ শতাংশ শেয়ারের অংশীদার। ২০১৯-২০ অর্থবছরে সাইফ পাওয়ারটেকের রেভিনিউ ছিল প্রায় ৯০ কোটি ৪৩ লাখ টাকা, যা বেড়ে ২০২২-২৩ অর্থবছরে ১৩৪ কোটি ৫১ লাখ টাকা অতিক্রম করেছে। 

বর্তমানে কারখানাটি বাংলাদেশে একক যেকোনো ব্যাটারি উৎপাদন প্রতিষ্ঠানের মধ্যে অন্যতম। এ কারখানার পণ্যের ব্যাপকতা ও প্রসারতা, গুণগত মান, ব্র্যান্ডিং এবং সুনাম দেশব্যাপী প্রতিষ্ঠিত ও বিস্তৃত। ভবিয্যতে কারখানা সম্প্রসারণের পরিকল্পনা রয়েছে, যার মধ্যে লিথিয়াম ও জেল টেকনোলজি নিয়ে রিসার্চ অ্যান্ড ডেভেলপমেন্ট ডিপার্টমেন্ট কাজ করছে বলে জানিয়েছে কর্তৃপক্ষ। শিগগিরই বাণিজ্যিকভাবে লিথিয়াম ও জেল টেকনোলজিসমৃদ্ধ ব্যাটারি বাজারজাতের পরিকল্পনা করছেন তারা।\

এই বিভাগের আরও খবর

আরও পড়ুন