বিগত সরকারের নানা অতিরঞ্জিত পরিসংখ্যান

বিবিএসে টানা ১৫ বছর পরামর্শক ছিলেন ড. বজলুল হক খন্দকার

ইয়াহইয়া নকিব

ছবি : সংগৃহীত

বিগত আওয়ামী লীগ সরকারের শাসনামলের শুরু থেকেই দেশের প্রবৃদ্ধি, মূল্যস্ফীতি ও দারিদ্র্যের হারসহ অন্যান্য অর্থনৈতিক সূচকের যথার্থতা নিয়ে প্রশ্ন উঠতে থাকে। সন্দেহ তৈরি হয় দীর্ঘ সময় ধরে উচ্চ প্রবৃদ্ধি অব্যাহত থাকায়। কভিড মহামারীকালেও দক্ষিণ এশিয়ার মধ্যে সবচেয়ে বেশি প্রবৃদ্ধির খবর সামনে আসায় এ ধরনের সন্দেহ আরো বেড়ে যায়। কারণ ধারাবাহিক উচ্চ প্রবৃদ্ধির পরও দেশে কর্মসংস্থান বৃদ্ধির হার সন্তোষজনক ছিল না। এ ধরনের নানা অতিরঞ্জিত পরিসংখ্যান নিয়ে উষ্মা প্রকাশ করা হয় আন্তর্জাতিক মহল থেকেও। একপর্যায়ে অবশ্য এসব সন্দেহ বাস্তবে রূপ নিতে থাকে। প্রমাণিত হয়—রফতানি ও রাজস্ব আহরণের পরিসংখ্যানও ফুলিয়ে-ফাঁপিয়ে দেখিয়েছিল শেখ হাসিনার সরকার। আর এসব বানোয়াট পরিসংখ্যানের সামনে থেকে নেতৃত্ব দেন সাবেক অর্থমন্ত্রী আ হ ম মুস্তফা কামাল। কিন্তু পেছনের কারিগর কারা, তা নিয়ে প্রশ্ন থেকে যায়। অনুসন্ধানে দেখা গেছে, বিগত সরকারের আমলে পরিসংখ্যানবিষয়ক গুরুত্বপূর্ণ প্রায় সব কমিটির সদস্য ছিলেন ড. বজলুল হক খন্দকার। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের এ অধ্যাপক ‘সিজি মডেলের’ মাধ্যমে প্রবৃদ্ধি নির্ধারণের জন্য এরই মধ্যে খ্যাতি অর্জন করেছেন। যদিও বানোয়াট পরিসংখ্যানের অন্যতম পরামর্শকও মনে করা হয় তাকে।

বিশ্লেষকরা বলছেন, বিবিএসের চাহিদামতো তথ্য সরবরাহের জন্যই টেকনিক্যাল কমিটিগুলো করা হয় কিনা, তা খতিয়ে দেখা দরকার। কমিটি গঠনের প্রক্রিয়ার মধ্যেই দুর্বলতা রয়েছে। যেভাবে কমিটি করলে বিবিএসের স্বার্থ ঠিক থাকে, সেভাবেই হয়তো কমিটি করা হতো। 

বিগত সরকারের প্রথম দফায় ক্ষমতায় আসার পরই বিবিএসের ন্যাশনাল অ্যাকাউন্টিং উইংয়ের জন্য একটি টেকনিক্যাল কমিটি করা হয়। এ কমিটি উইংয়ের কাজের দেখভাল করত। আর এখান থেকেই দেশের জিডিপি, মূল্যস্ফীতি, শ্রমিকের মজুরি হার এবং আন্তর্জাতিক বাণিজ্যের মতো গুরুত্বপূর্ণ তথ্য প্রকাশ করা হতো। এ কমিটিতে গুরুত্বপূর্ণ বিশেষজ্ঞ ছিলেন বজলুল হক খন্দকার।

ড. বজলুল হক খন্দকার ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতি বিভাগের অধ্যাপক। ইংল্যান্ডের ইউনিভার্সিটি অব অরউইক থেকে স্নাতকোত্তর ও পিএইচডি ডিগ্রি সম্পন্ন করেন তিনি। দারিদ্র্য ও সামাজিক নিরাপত্তা কর্মসূচি, ডাটা অ্যানালাইসিস ও ইমপ্যাক্ট অ্যাসেসমেন্ট, নীতি প্রণয়ন, আঞ্চলিক বৈষম্য, রাজস্বের প্রভাব, অন্তর্ভুক্তিমূলক উন্নয়নসহ নানা বিষয়ে তার গবেষণা রয়েছে। তিনি বিভিন্ন দেশের সোশ্যাল অ্যাকাউন্টিং ম্যাট্রিক্স প্রণয়ন, রাজস্ব ব্যবস্থা সংস্কার কিংবা আয় বণ্টন সহায়ক নীতি প্রণয়নে ভূমিকা রেখেছেন। সিজি মডেলিংয়ের মাধ্যমে প্রবৃদ্ধির হিসাব নির্ধারণে তার খ্যাতি রয়েছে। দেশের কয়েকজন ‘সিজি মডেল’ এক্সপার্টের মধ্যে তিনি অন্যতম। তবে তার এসব বিশেষজ্ঞ জ্ঞান বিগত সরকারের পরিসংখ্যানগত উন্নতিতে কতটা কাজে লেগেছে, তা নিয়ে প্রশ্ন রয়েছে।

গত ২০১৫-১৬ সালে জিডিপি রিভিশনের জন্য একটি টেকনিক্যাল কমিটি করা হয়। এ কমিটির পরামর্শে জিডিপির হিসাবে নীতিগত পরিবর্তন আনা হয়। এ কমিটিরও অন্যতম সদস্য ছিলেন বজলুল হক খন্দকার। শুধু টেকনিক্যাল কমিটিই নয়, বরং সরকারের উপদেষ্টা কমিটিতেও ছিলেন তিনি।

২০২১ সালে সরকার জাতীয় পরিসংখ্যান উপদেষ্টা কমিটি গঠন করে। এতে বিভিন্ন মন্ত্রণালয় ও সরকারি বিভাগের প্রতিনিধিদের মধ্যে বজলুল হক খন্দকার ছিলেন অন্যতম। বলতে গেলে সরকারের বাইরে থেকে জায়গা পাওয়া কয়েক সদস্যের মধ্যে তিনি ছিলেন অন্যতম। ২০২২ সালে একই ধরনের একটি কমিটি গঠন করা হয়। সেখানেই তিনি ছিলেন। অর্থাৎ বিগত সরকারের প্রায় দেড় দশকে পরিসংখ্যানগত গুরুত্বপূর্ণ সব কমিটিতে বজলুল হক খন্দকার ছিলেন অপরিহার্য।

বিশ্বব্যাংক, এশীয় উন্নয়ন ব্যাংক (এডিবি) এবং আইএমএফ ছাড়াও অনেক আন্তর্জাতিক সংস্থা বিগত সরকারের পরিসংখ্যান নিয়ে আপত্তি জানিয়েছিল। তবে সম্প্রতি বিবিএসের নিজস্ব জরিপেও সংস্থাটির প্রতি বিশ্বাসহীনতার নজির উঠে এসেছে। তাদের তথ্যকে নির্ভরযোগ্য মনে করেন না এক-তৃতীয়াংশেরও বেশি মানুষ। মূল্যস্ফীতির পরিসংখ্যান নিয়ে অবিশ্বাস সবচেয়ে বেশি। 

‘ব্যবহারকারী সন্তুষ্টি জরিপ-২০২৪ শীর্ষক এ জরিপের ফল বলছে, ৩৩ দশমিক ১৬ শতাংশ বিবিএসের মূল্যস্ফীতিসংক্রান্ত পরিসংখ্যানকে নির্ভরযোগ্য মনে করেন না। ব্যবহারকারীদের ২৭ দশমিক ৪৪ শতাংশ মনে করেন, এ-সংক্রান্ত তথ্যের নির্ভরযোগ্যতা কম। আর একেবারেই অনির্ভরযোগ্য মনে করেন ৫ দশমিক ৭২ শতাংশ। একইভাবে কৃষি, শিক্ষা, শিল্প এবং আয় ও দারিদ্র্যের পরিসংখ্যান নিয়েও কম নির্ভরতা পান প্রায় এক-চতুর্থাংশ ব্যবহারকারী।

বিবিএসের প্রতি মানুষের আস্থাহীনতা তৈরির পেছনে টেকনিক্যাল কমিটি গঠনের দুর্বলতাকেও একটি কারণ বলে মনে করা হয়। বেসরকারি গবেষণা সংস্থা ইকোনমিক রিসার্চ গ্রুপের (ইআরজি) নির্বাহী পরিচালক ও অর্থনীতিবিদ ড. সাজ্জাদ জহির বণিক বার্তাকে বলেন, ‘প্রকল্পের মাধ্যমে বিবিএস ডাটা তৈরি করে থাকে। আর এসব প্রকল্পে কয়েকটি প্রতিষ্ঠান পরামর্শক হিসেবে জড়িত রয়েছে। এক্ষেত্রে কমিটি গঠনের প্রক্রিয়ায় দুর্বলতা রয়েছে। রাজনৈতিক প্রভাবও থাকে।’

বিশ্বের বিভিন্ন দেশের পরিসংখ্যানগত পারফরম্যান্স বিবেচনায় স্কোর প্রকাশ করে থাকে বিশ্বব্যাংক। ২৫টি সূচক বিবেচনায় এমন তালিকা তৈরি হয়। ২০১৪ সালে প্রকাশিত স্ট্যাটিস্টিক্যাল ক্যাপাসিটি ইন্ডিকেটরে বাংলাদেশের সার্বিক স্কোর ছিল একশর মধ্যে ৮০। আর পদ্ধতিগত স্কোর ছিল ৭০। কিন্তু এরপর থেকে দুটি স্কোরই ধারাবাহিকভাবে কমতে থাকে। ২০১৮ সালে সার্বিক স্কোর দ্রুত হ্রাস পেয়ে ৬২-তে নেমে যায়। ২০২০ সালে নেমে আসে ৬০-এ, যেখানে দক্ষিণ এশিয়ার গড় স্কোর ছিল ৬৯। সে সময় মেথডোলজি বা পদ্ধতিগত সূচকে সবচেয়ে বড় পতনের মুখে পড়ে বাংলাদেশ। এ সূচকে ২০১৪ সালের ৭০ স্কোর থেকে ২০২০ সালে তা অর্ধেকের বেশি কমে ৩০-এ নেমে আসে। তখন পরিকল্পনামন্ত্রীর দায়িত্বে ছিলেন আ হ ম মুস্তফা কামাল। তার আমল থেকেই সরকারি পরিসংখ্যান সবচেয়ে বেশি প্রশ্নবিদ্ধ হয়েছিল বলে মনে করা হয়। যদিও বানোয়াট পরিসংখ্যানের পুরস্কারস্বরূপ পরবর্তী সময়ে তাকে অর্থমন্ত্রী করা হয়।

তৎকালীন বিবিএসের প্রকাশিত তথ্যের সঙ্গে বিশ্বব্যাংক ও এডিবির মতো আন্তর্জাতিক প্রতিষ্ঠানগুলোর তথ্যগত পার্থক্য বেড়েই চলছিল। ২০১৮ সালে প্রবৃদ্ধির তথ্যে বিস্তর ফারাক নিয়ে বিশ্বব্যাংকের সঙ্গে দ্বন্দ্বে জড়ান মুস্তফা কামাল। ২০১৭-১৮ অর্থবছরে দেশের প্রবৃদ্ধির লক্ষ্যমাত্রা ছিল ৭ দশমিক ৪ শতাংশ। যদিও লোটাস কামাল ওই বছরের এপ্রিলে প্রবৃদ্ধি লক্ষ্যমাত্রা ছাড়িয়ে ৭ দশমিক ৬৫ শতাংশ হবে বলে দাবি করেন। অন্যদিকে বিশ্বব্যাংকের পূর্বাভাস ছিল, বাংলাদেশের প্রবৃদ্ধি হবে বড়জোর ৬ দশমিক ৬৫ শতাংশ। এডিবির পক্ষ থেকেও সরকারের সঙ্গে দ্বিমত পোষণ করা হয়। এতে ক্ষুব্ধ হয়ে সরকারের পক্ষ থেকে বিশ্বব্যাংকের ডাটাকে চ্যালেঞ্জ করে সংবাদ সম্মেলন করা হয়েছিল। 

অর্থ মন্ত্রণালয়ের এক কর্মকর্তা জানান, শুধু বিবিএসে নয়, বজলুল হক খন্দকারসহ কয়েকজন বিশেষজ্ঞ পরিকল্পনা কমিশন ও মন্ত্রণালয়ের গুরুত্বপূর্ণ সব কমিটিতে কাজ করেন। জিইডিতেও তারা বিভিন্ন কমিটিতে কাজ করে থাকেন।

শুধু সরকারি প্রতিষ্ঠানের পরামর্শক নয়, বজলুল হক খন্দকার জড়িত আছেন একাধিক বেসরকারি গবেষণা প্রতিষ্ঠানের সঙ্গেও। এর মধ্যে গবেষণা সংস্থা সাউথ এশিয়ান নেটওয়ার্ক অন ইকোনমিক মডেলিংয়ের (সানেম) চেয়ারম্যান তিনি। রিসার্চ অ্যান্ড পলিসি ইন্টিগ্রেশন ফর ডেভেলপমেন্টে (র‍্যাপিড) আছেন ভাইস চেয়ারম্যান পদে। পরিচালক হিসেবে আছেন পলিসি রিসার্চ ইনস্টিটিউটে (পিআরআই)। 

পরিসংখ্যানের বিভ্রান্তির পদ্ধতি নিয়ে খন্দকার বজলুর হক বণিক বার্তাকে বলেন, ‘পণ্যের দাম কম দেখিয়ে বা ওজন বাড়িয়ে-কমিয়ে মূল্যস্ফীতির হার কম-বেশি করা যায়।’ এসব বিভ্রান্তিকর পরিসংখ্যান প্রস্তুতের সময় বিভিন্ন কমিটির সদস্য হিসেবে দায় এড়াতে পারেন কিনা জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘আমরা কমিটির পক্ষ থেকে নীতি নির্ধারণের কাজগুলো করতাম। তবে সরাসরি প্রবৃদ্ধি হিসাবের সঙ্গে আমরা জড়িত ছিলাম না। তাই এ দায় আমাদের নয়।’

পরিসংখ্যানের বিভ্রান্তি নিয়ে কমিটিতে আলোচনা হতো কিনা, এমন প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, ‘কিছু আলোচনা হলেও বিস্তারিত আলোচনা হতো না। মূল্যস্ফীতির বাস্কেট পরিবর্তন করার কথা আমরা বলতাম। দারিদ্র্য হার নিয়েও আমরা কথা বলেছি। তবে সব বিষয়ে আমাদের পরামর্শ গ্রহণ করা হতো না। সেখানে মন্ত্রী, প্রতিমন্ত্রী ও সচিবরা থাকতেন।’

এই বিভাগের আরও খবর

আরও পড়ুন