আলোকপাত

জনজীবনে স্বস্তি ফেরাতে কার্যকর উদ্যোগ জরুরি

ড. মো. আব্দুল হামিদ

ছবি : বণিক বার্তা ( ফাইল ছবি)

বিগত সরকার পতনের পর কয়েক দিন নিত্যপ্রয়োজনীয় দ্রব্যমূল্য হ্রাসের খবর শোনা গেল। গণমাধ্যম জানাল রাস্তাঘাটে চাঁদাবাজি বন্ধ এবং ক্ষমতাধর ব্যবসায়ী সিন্ডিকেট ভেঙে পড়ায় জিনিসপত্রের দাম কমতে শুরু করেছে। কিন্তু আমজনতার কপালে সুখ স্থায়ী হবার নয়। তাই সপ্তাহ না পেরোতেই দ্রব্যমূল্য বাড়তে শুরু করে। 

বর্তমানে চাল, তেল, আলু, পেঁয়াজ ও ডিমের মতো অতিপ্রয়োজনীয় দ্রব্যাদির খুচরা মূল্য যেকোনো সময়ের চেয়ে বেশি। রাজনৈতিক দলের সরকারকে দলীয় নেতাকর্মীদের স্বার্থ দেখতে হয়। তাই তারা চাইলেও দ্রব্যমূল্য বৃদ্ধির সিন্ডিকেট ও চাঁদাবাজদের বিরুদ্ধে কঠোর হতে পারে না। অন্তর্বর্তী সরকারের তো তেমন কোনো দায় নেই। তাহলে অসাধু ব্যবসায়ী ও চাঁদাবাজদের প্রতি কঠোর হতে সমস্যা কোথায়? 

নতুন সরকার গঠনের প্রাক্কালে সাধারণ শিক্ষার্থী-জনতা ট্রাফিক ব্যবস্থায় শৃঙ্খলা ফেরাতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে। তাদের ওই-সংক্রান্ত কোনো প্রশিক্ষণ ছিল না; বিনিময়ে কোনো সুবিধাও ছিল না। তার পরও তারা দারুণ কাজ করেছে। পরবর্তী সময়ে ট্রাফিক পুলিশের কাজে ফেরার পরিপ্রেক্ষিতে তাদের আর রাস্তায় না নামতে অনুরোধ করা হয়। 

কিন্তু সংশ্লিষ্টরা কাজ শুরু করার পর ট্রাফিক ম্যানেজমেন্টে দৃশ্যমান কোনো উন্নতি হয়নি। দায়িত্ব পালনকারীদের দায়সারা আচরণে মাঝেমধ্যেই যানজট ভয়াবহ আকার ধারণ করছে। এক্ষেত্রে দায়িত্বে অবহেলার কারণে কাউকে শাস্তি দেয়া হয়েছে বলে শোনা যায়নি। এমনটা চলতে থাকলে সংশ্লিষ্টদের দায়িত্বে অবহেলার প্রবণতা বাড়বে। এতে জনজীবন অতিষ্ঠ হবে। সরকারের ব্যর্থতাগুলো খালি চোখেই প্রকটভাবে ধরা পড়বে। 

আমাদের মোট রফতানি আয়ের প্রায় ৮২ শতাংশ আসে তৈরি পোশাক খাত থেকে। এ সেক্টরে ৫০ লাখের বেশি মানুষের সরাসরি কর্মসংস্থান হয়েছে। তাছাড়া এ খাতের অধিকাংশ লেনদেন হয় বিদেশী প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে। তারা নির্ধারিত সময়সীমার ব্যাপারে অত্যন্ত সিরিয়াস। এমন একটি স্পর্শকাতর খাতে মাসাধিককাল অস্থিরতা চলছে। অথচ সরকার এ সমস্যা সমূলে উৎপাটন করতে পারছে না। গুটিকতক প্রতিষ্ঠান ও শ্রমিক নেতা নাকি এ সমস্যাগুলোর মূলে রয়েছেন। সাধারণ শ্রমিকরা কর্মক্ষেত্রে শান্তি-শৃঙ্খলা বজায় রাখার পক্ষে। তাহলে সংশ্লিষ্টদের সঙ্গে আলোচনা করে কেন এটার সমাধান করা যাচ্ছে না? 

যৌক্তিক সমাধানের পরও যদি তারা অস্থিরতা জিইয়ে রাখতে চায় তবে কঠোর হতে সমস্যা কোথায়? এমন অস্থিরতায় বিদেশী ক্রেতারা একবার মুখ ফিরিয়ে নিলে গত চার দশকে তিলে তিলে গড়ে ওঠা আমাদের বিশাল মার্কেট (বিশ্ববাজারের প্রায় সাড়ে ৬ শতাংশ) হাতছাড়া হবে। বিপুল পরিমাণ শ্রমিক কর্ম হারাবেন। আর্থসামাজিক অস্থিরতা বাড়বে। তাই এ 

ব্যাপারে উদাসীন বা কম মনোযোগী থাকার সুযোগ কোথায়? 

এর আগে কেয়ারটেকার সরকারের সময় দুর্নীতিবাজরা ভয়ে তটস্থ থাকত। ক্ষমতাসীন থাকাকালীন অপকর্মের জন্য আইনের মুখোমুখি হওয়ার ভয়ে তারা লেজ গুটিয়ে পালিয়ে বেড়াত। সাধারণ মানুষ সাময়িক স্বস্তি পেত। অসৎ লোকদের চক্রান্ত কিছুদিনের জন্য হলেও হ্রাস পেত। এতে সাধারণ মানুষ হাঁফ ছেড়ে বাঁচত। অথচ এখনো দুর্নীতিবাজ আমলারা সচিবালয়ে বসে নিয়োগ বাণিজ্য করছে! যারা ৩ কোটি টাকার বিনিময়ে একেক জেলার ডিসি নিয়োগ দিয়েছে বা নিয়োগ পেয়েছে তাদের বিরুদ্ধে কি শাস্তিমূলক কোনো ব্যবস্থা নেয়া হয়েছে? এটা প্রশাসনের অন্যদের কী বার্তা দেয়? 

অন্তর্বর্তী সরকার আগের কেয়ারটেকার সরকারগুলোর চেয়ে শক্তিশালী বলেই সাধারণ মানুষ বিশ্বাস করে। কিন্তু দায়িত্ব গ্রহণের প্রায় দুই মাস হতে চললেও বিস্ময়করভাবে দুর্নীতিবাজদের বিরুদ্ধে কোনো অভিযান লক্ষ করা যাচ্ছে না। আগস্টে পটপরিবর্তনের পর কয়েক দিন তারা চুপচাপ ছিল। এখন প্রচণ্ড দাপটের সঙ্গে প্রত্যাবর্তন করেছে। তাদের অপকর্ম অব্যাহত রাখতে কোনো সমস্যা হচ্ছে না। এমনকি এরই মধ্যে অনেককে ‘ম্যানেজ’ করেও ফেলেছে বলে নানা মাধ্যমে শোনা যাচ্ছে! 

তদুপরি সরকারের অগ্রাধিকার বিষয়ে স্পষ্ট ধারণা না থাকা, আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর আপাত নিষ্ক্রিয়তা, দুর্নীতি ও সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে কঠোর পদক্ষেপ না নেয়া প্রভৃতি কারণে দেশের নানা প্রান্তে বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি হচ্ছে। সেখানে সেনাবাহিনীর সদস্যরা তাৎক্ষণিক হাজির হয়ে পরিস্থিতি শান্ত করলেও তাদের কঠোর হতে দেখা যাচ্ছে না। ফলে দুষ্টু লোকেরা নানাভাবে সমস্যা সৃষ্টি করতে সদা সচেষ্ট থাকছে। কোনো একটি ঘটনায় দৃষ্টান্তমূলক পদক্ষেপ নেয়া হয়নি যা অপচেষ্টাকারীদের কঠোর বার্তা দেবে। এতে ‘মব জাস্টিস’ বাড়ছে। সাধারণ মানুষের আইন হাতে তুলে নেয়ার প্রবণতা বাড়ছে। এটা কঠোর হস্তে দমন করা দরকার। 

সম্প্রতি দেশের দুটি বিশ্ববিদ্যালয়ে পিটিয়ে মানুষ হত্যার ঘটনা সবার নজর কেড়েছে। দেশের সর্বোচ্চ শিক্ষিতরা দলবেঁধে কাউকে পিটিয়ে মেরে ফেলার উৎসবে মেতে উঠছে, বিষয়টা ভয়ংকর। অথচ সেই বিশ্ববিদ্যালয়গুলোয় ভিসি, প্রক্টর ও সংশ্লিষ্ট হলে দায়িত্বপ্রাপ্ত প্রভোস্ট ছিলেন। তারা কেন ওই দীর্ঘ (পিটিয়ে মারার) প্রক্রিয়ায় কোনো তথ্য পেলেন না, দ্রুত সেখানে পৌঁছতে ব্যর্থ হলেন? তবে কি সেখানে অতীতের ক্ষমতাসীনদের মতো বিশেষ কোনো গ্রুপ সৃষ্টি হয়েছে যাদের অপকর্ম প্রশাসন জানার পরও উপেক্ষা করেছে? 

অধিকাংশ পাবলিক ইউনিভার্সিটি প্রশাসন এখনো পুরোপুরি সক্রিয় হয়নি। অথচ ক্লাস-পরীক্ষা পুরোদমে শুরু হলে অনেক অনাকাঙ্ক্ষিত ঘটনা স্বয়ংক্রিয়ভাবে হ্রাস পেত। বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনগুলোকে যেকোনো সময়ের চেয়ে অনেক বেশি চ্যালেঞ্জ মোকাবেলা করতে হবে। বিশেষত গত দেড় দশকে যেসব বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা পেয়েছে সেগুলোর শিক্ষক-কর্মকর্তা-কর্মচারীরা নবনিযুক্ত প্রশাসনকে ব্যর্থ দেখতে চাইবে। তাদের জায়গা থেকে অসহযোগিতা এমনকি সুযোগ পেলেই ঝামেলা সৃষ্টি করবে। তাই শুধু কৃতী গবেষক বা গ্রহণযোগ্য শিক্ষক হওয়া যথেষ্ট নয়। প্রায় শতভাগ প্রতিকূল পরিবেশে হাল ধরার মতো নেতৃত্বের গুণাবলি থাকাও অপরিহার্য। নইলে ‘মেধাবী’ লোকেরা এসব পদে ফিট নয় বলে প্রমাণিত হওয়ার শঙ্কা রয়েছে। 

সম্প্রতি আমাদের পাহাড়ি অঞ্চল অস্থির হয়ে পড়ছে। দীর্ঘদিন থেকেই সেখানে বিভিন্ন গ্রুপ অস্থিরতা সৃষ্টির চেষ্টা করছে। বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর নিরলস চেষ্টায় তারা খুব একটা সুবিধা করতে পারেনি। কিন্তু এখন অধিকাংশ ক্ষেত্রে আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর নিষ্ক্রিয়তায় তারা সুযোগ নেবে সেটা স্বাভাবিক। তাছাড়া সারা দেশের আইন-শৃঙ্খলা রক্ষায় সেনাবাহিনী ব্যস্ত থাকায় তাদের সক্রিয় হয়ে ওঠা অপ্রত্যাশিত ছিল না। এ ব্যাপারে সরকারের সর্বোচ্চ পর্যায় থেকে আহ্বান জানানো হয়েছে। কিন্তু শুধু মুখের কথা যথেষ্ট নয়। বরং কঠোর পদক্ষেপের মাধ্যমে তাদের নিবৃত্ত করতে হবে। নইলে তা নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে যাওয়া অসম্ভব নয়। 

মিডিয়া বিস্তারের এ যুগেও কিছু উপদেষ্টার উপস্থিতি একদম টের পাওয়া যাচ্ছে না। নিজ মন্ত্রণালয়ের অধীন নানা সংকটেও তাদের ভূমিকা সাধারণ মানুষকে বিস্মিত করছে। মাঝেমধ্যে তাদের সিদ্ধান্তগুলো ঠিক কারা নিচ্ছে তা বোঝা যাচ্ছে না। স্বল্পমেয়াদের সরকারের জন্য প্রায় দুই মাস মোটেও কম সময় নয়। তাই পারফরম্যান্স মূল্যায়ন করে কয়েকজন উপদেষ্টাকে অব্যাহতি দেয়া যেতে পারে। উল্লেখ্য, তাদের কারো কারো পদচ্যুতি নিজ পরিবার ও বন্ধুবান্ধব ছাড়া আর কাউকে স্পর্শ করবে বলে মনে হয় না। তাহলে এমন জনবিচ্ছিন্ন ব্যক্তিদের অতি গুরুত্বপূর্ণ পদে বসিয়ে রাখার দরকার কী? 

তাদের অধিকাংশই কর্মজীবনে ব্যবস্থাপনার সঙ্গে যুক্ত ছিলেন। কিন্তু বর্তমান পদে ভালো পারফর্ম করার জন্য নেতৃত্বের গুণাবলি অপরিহার্য। সেটার ঘাটতির কারণেই সম্ভবত জনগণের ভোগান্তির বিষয়গুলো তাদের স্পর্শ করছে না। জনজীবন স্বাভাবিক করতে অগ্রাধিকার নির্ধারণ বিষয়ে তাদের উন্নাসিকতা মানুষের বিরক্তির কারণ হচ্ছে। তাই তরুণ, উদ্যমী, দক্ষ ও নেতৃত্বের গুণাবলিসম্পন্ন কয়েকজন নতুন উপদেষ্টা নিয়োগ দেয়ার ব্যাপারটি প্রধান উপদেষ্টা সিরিয়াসলি ভাবতে পারেন। নইলে প্রত্যাশার পুরো চাপ এককভাবে ড. মুহাম্মদ ইউনূসের ওপর ভর করছে যা অত্যন্ত ঝুঁকিপূর্ণ। 

যা-ই হোক, নানা শঙ্কার পাশাপাশি অন্তর্বর্তী সরকার দায়িত্ব গ্রহণের পর থেকে এ পর্যন্ত আশাবাদী হওয়ার মতো অনেক ঘটনাও লক্ষ করা গেছে। এ সরকারের প্রধান চ্যালেঞ্জ ছিল দেশের ডুবন্ত অর্থনীতিকে রক্ষা করা। এমনকি নবনিযুক্ত গভর্নর শুরুতে চরম হতাশাজনক তথ্য শেয়ার করেছিলেন। কিন্তু আমার মতে, এ খাতে দায়িত্বপ্রাপ্তরা এখন পর্যন্ত সর্বোত্তম উদ্যোগ গ্রহণ করেছেন। তাদের পদক্ষেপগুলো কাজ করতে শুরু করেছে। ডলারের দাম স্থিতিশীল হয়েছে, প্রয়োজনীয় পরিমাণ ডলার পাওয়া যাচ্ছে, বিলাসদ্রব্য ছাড়া সব পণ্যের এলসি মার্জিন তুলে দেয়া হয়েছে। বৈদেশিক মুদ্রা রিজার্ভের পরিমাণ বাড়ার লক্ষণ দেখা যাচ্ছে। ফলে আর্থিক খাতে আমরা আশাবাদী হতেই পারি। 

এছাড়া সরকার গঠনের ঊষালগ্নে দেশের ব্যাপক এলাকা ভয়াবহ বন্যায় আক্রান্ত হয়। সেই অঞ্চলগুলোয় ভয়াবহ মানবিক বিপর্যয় ঘটে। সরকার গুছিয়ে ওঠার আগেই গোটা দেশ ক্ষতিগ্রস্তদের সাহায্যার্থে এগিয়ে আসে। এমন প্রাকৃতিক দুর্যোগ জাতি হিসেবে আমাদের পারস্পরিক বন্ধনকে করেছে আরো মজবুত। তাই যে জাতি একাংশের বিপদে সর্বোচ্চ শক্তি নিয়ে ঝাঁপিয়ে পড়তে পারে তাদের ব্যাপারে আশাবাদী হওয়াই যায়। 

তবে মনে রাখতে হবে, দীর্ঘমেয়াদে কল্যাণরাষ্ট্র গঠনের জন্য সংস্কার জরুরি। কিন্তু সাধারণ মানুষ নিত্যপ্রয়োজনীয় দ্রব্যের দাম সহনীয় মাত্রায় পেতে চায়, আইন-শৃঙ্খলা পরিস্থিতি স্বাভাবিক চায়, দুর্নীতিবাজদের বিরুদ্ধে কার্যকর পদক্ষেপ দেখতে চায়। এগুলো নিশ্চিত করার পাশাপাশি রাষ্ট্র সংস্কারের কাজ চলমান থাকলে সমস্যা নেই। কিন্তু এগুলো উপেক্ষা করে যত ভালো উদ্যোগই নেয়া হোক না কেন গণ-অসন্তোষ বাড়তে থাকবে। দীর্ঘমেয়াদে অনির্বাচিত এক সরকারের জন্য যা মোটেও কল্যাণকর হবে না।

ড. মো. আব্দুল হামিদ: শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের ব্যবসায় প্রশাসন বিভাগের অধ্যাপক ও ‘মস্তিষ্কের মালিকানা’ বইয়ের লেখক

এই বিভাগের আরও খবর

আরও পড়ুন