আইএমএফ: রাজস্ব আহরণের লক্ষ্য পূরণ হয়নি

রাজস্ব আয় বাড়াতে করের ভিত্তি বাড়ানো ও ব্যয়ের জবাবদিহি নিশ্চিত করতে হবে

ছবি : বণিক বার্তা

আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিল (আইএমএফ) ৪৭০ কোটি ডলার ঋণ অনুমোদনের সময় যেসব শর্ত বেঁধে দিয়েছিল, এর মধ্যে অন্যতম ছিল রাজস্ব আয় বাড়ানো। অর্থাৎ জিডিপির অনুপাতে কর রাজস্বের পরিমাণ বৃদ্ধি। সংস্থাটি একটি লক্ষ্যমাত্রাও দিয়েছিল। তবে এ বছরের জুন শেষে সংস্থাটির লক্ষ্যমাত্রা অনুসারে রাজস্ব আহরণ করা যায়নি। আইএমএফের দেয়া বিবৃতি অনুযায়ী, গত অর্থবছর অর্থাৎ এ বছরের জুন শেষে আইএমএফের বেঁধে দেয়া রাজস্ব আহরণের লক্ষ্যমাত্রা ছিল ৩ লাখ ৯৪ হাজার ৫৩০ কোটি টাকা। কিন্তু ২০২৩-২৪ অর্থবছরে দেশের কর রাজস্ব আয় হয়েছে ৩ লাখ ৬৯ হাজার ২৯০ কোটি টাকা। এক্ষেত্রে আইএমএফের লক্ষ্যমাত্রার তুলনায় ২৫ হাজার ২৪০ কোটি টাকা বা ৬ দশমিক ৪০ শতাংশ কর রাজস্ব কম আয় হয়েছে।

কেবল আইএমএফের নির্ধারিত লক্ষ্যমাত্রা নয়, বাজেটে উল্লিখিত রাজস্ব আহরণের লক্ষ্যমাত্রাও পূরণে বারবার ব্যর্থ হচ্ছে দেশ। যে কারণে বহুমুখী চ্যালেঞ্জের মধ্য দিয়েও যেতে হচ্ছে। তাই কেবল আইএমএফে ঋণের অর্থছাড়ের তাগিদেই নয়, দেশের অর্থনীতির বর্তমান চ্যালেঞ্জ মোকাবেলায় রাজস্ব আয় উল্লেখযোগ্য পরিমাণে বাড়ানো প্রয়োজন। এজন্য আয়কর বা প্রত্যক্ষ কর বাড়ানোয় মনোযোগী হওয়া জরুরি।

বহু প্রচেষ্টা করেও উচ্চ মূল্যস্ফীতির লাগাম আজও টেনে ধরা যায়নি। যথাযথভাবে প্রত্যক্ষ কর আহরণ না করে পরোক্ষ কর বাড়ানোর প্রভাবে মূল্যস্ফীতি আরো স্ফীত হতে থাকে। কারণ পরোক্ষ কর বাড়ানো মানেই হলো মূসক ও শুল্ক বৃদ্ধি। দীর্ঘদিন ধরেই পরোক্ষ কর না বাড়নোর পরামর্শ দিচ্ছেন অর্থনীতিবিদরা। তাদের মতে, করহার না বাড়িয়ে করযোগ্য মানুষ যারা এখনো কর দেন না, তাদের করের আওতায় আনা প্রয়োজন। জাতীয় রাজস্ব বোর্ডসহ (এনবিআর) সংশ্লিষ্টদের এ বিষয়ে উদ্যোগী হতে হবে।

চলতি বাজেটে (২০২৪-২৫ অর্থবছর) রাজস্ব আয়ের লক্ষ্যমাত্রা ধরা হয়েছে ৫ লাখ ৪১ হাজার কোটি টাকা। এর মধ্যে ৪ লাখ ৮০ হাজার কোটি টাকার জোগান দেবে এনবিআর। এ অর্থের ১ লাখ ৭৭ হাজার ৬০০ কোটি টাকা আসবে প্রত্যক্ষ কর (আয়কর ও ভ্রমণ কর) থেকে, যা মোট লক্ষ্যমাত্রার ৩৭ শতাংশ। বাকি দুই-তৃতীয়াংশ বরাবরের মতোই আহরণ হবে পরোক্ষ কর (মূসক ও শুল্ক) থেকে।

পরোক্ষ কর খাতে আমদানি-রফতানি পর্যায়ে শুল্ককরের লক্ষ্য নির্ধারণ হয়েছে ১ লাখ ২৪ হাজার ৮০০ কোটি টাকা, যা মোট লক্ষ্যমাত্রার ২৬ শতাংশ। জাতীয় পর্যায়ে মূল্য সংযোজন কর ও অন্যান্য খাতে ১ লাখ ৭৭ হাজার ৬০০ কোটি টাকা রাজস্ব আহরণের লক্ষ্য নির্ধারণ হয়েছে, যা লক্ষ্যমাত্রার ৩৭ শতাংশ। সব মিলিয়ে পরোক্ষ কর থেকে আহরণের লক্ষ্য ৬৩ শতাংশ রাজস্ব। যদিও বিশেষজ্ঞরা বরাবরই বলে আসছেন, রাজস্ব বাড়াতে হলে পরোক্ষ করের ওপর নির্ভরশীল না হয়ে প্রত্যক্ষ কর বাড়াতে হবে। 

এনবিআর সূত্রে জানা যায়, ২০২২-২৩ অর্থবছরে এনবিআর মূল্য সংযোজন কর (মূসক) থেকে সর্বোচ্চ ৩৭ শতাংশ কর আহরণ করেছে। আয়কর থেকে ৩৪ কাস্টমস (শুল্ক) থেকে ২৯ শতাংশ কর আহরণ করেছে। অর্থাৎ প্রত্যক্ষ করের চেয়ে গত অর্থবছরেও পরোক্ষ করের ওপর নির্ভরতা বেশি ছিল।

এদিকে বাংলাদেশের কর-জিডিপি অনুপাত বিশ্বের মধ্যে অন্যতম সর্বনিম্ন। ২০২১-২২ অর্থবছরে কর-জিডিপি অনুপাত ছিল ৭ দশমিক ৫৪ শতাংশ। ২০২২-২৩ অর্থবছরে এটি আরো কমে ৭ দশমিক ৩০ শতাংশে দাঁড়ায়। আশঙ্কা রয়েছে, তথ্যবিভ্রান্তি দূর করার জন্য আইবাসের হিসাবে রাজস্ব আহরণ গণনা হলে কর-জিডিপি অনুপাত আরো কমে যাবে।

এনবিআরের হিসাবে দেশে নিবন্ধিত করদাতার সংখ্যা ধীরে ধীরে বাড়লেও। রিটার্ন জমা দেয়া ব্যক্তির সংখ্যা সে তুলনায় কম। গত অর্থবছর শেষে দেশে করদাতা শনাক্তকরণ নম্বর (টিআইএন) ছিল ১ কোটি ৪ লাখ। আয়কর রিটার্ন জমা দিয়েছেন মাত্র ৪৩ লাখ। বিশেষজ্ঞদের মতে, অনেক করদাতা কাগজপত্র এড়াতে ও কর প্রশাসন থেকে হয়রানির শিকার হওয়ার আশঙ্কায় আয়কর রিটার্ন জমা দেন না।

প্রত্যক্ষ কর উল্লেখযোগ্য মাত্রায় বৃদ্ধি না পাওয়া এনবিআরের দুর্বলতাকে নির্দেশ করে। এনবিআরের দুর্বলতাগুলো খুঁজে বের করা দরকার এবং এটির কর কাঠামোর সংস্কার আবশ্যক। এছাড়া প্রত্যক্ষ কর আহরণের ক্ষেত্রে অন্যতম বাধা হলো কর জমাদানের প্রক্রিয়াটি এখনো সেভাবে সহজ করা যায়নি। অনেকের মধ্যে এ বিষয়ে জানাশোনা কম আছে। করদাতাদের স্বেচ্ছায় কর প্রদানে উদ্বুদ্ধ করতে হবে। এজন্য জটিলতা কমিয়ে আনতে হবে। পুরো সিস্টেম অটোমেটেড হওয়া দরকার। করারোপ, হিসাবায়ন ও জমাদান পদ্ধতি বা প্রক্রিয়া করদাতাবান্ধব কিংবা সহজ করতে হবে। এতে করদাতা ও আহরণকারীর মধ্যে দূরত্বও কমবে। পাশাপাশি করজালের সম্প্রসারণ ঘটবে বলে আশা করা যায়। আয়করযোগ্য ব্যক্তিদের করের আওতায় আনা গেলে রাজস্ব বহুগুণে বেড়ে যাবে। এক্ষেত্রে আবার ধার্য ও আদায়কৃত আয়কর যথাসময়ে ও প্রকৃত পরিমাণে কোষাগারে আসার ব্যাপারে নজরদারিও জোরদার করা জরুরি।

রাজস্ব আহরণের বিষয়ে অনেক সমালোচনার মধ্যে একটি হলো লক্ষ্যমাত্রা উচ্চাভিলাষী। গত মাসে এ বিষয়ে অর্থ ও বাণিজ্য উপদেষ্টা জানিয়েছেন যে রাজস্ব আয়ের লক্ষ্যমাত্রা কমানো হবে না। বাজেট ঘাটতি মেটাতে বড় অংশ বাইরে থেকে ঋণ হিসেবে আনতে হয়। এতে দিন দিন ঋণের বোঝা বাড়ছে। তাই চেষ্টা করতে হবে নিজেরাই অর্থের সংস্থান করার। তিনি পরমুখাপেক্ষী না হওয়ার ব্যাপারে খেয়াল রাখতে বলেছেন। এ নিয়ে আমরাও আশাবাদী হতে চাই। পাশাপাশি সরকারের ব্যয় কমিয়ে আনা উচিত। জনগণের যদি মনে হয় যে তাদের দেয়া করের টাকা অপচয় হচ্ছে, তাহলে তারা কর পরিশোধে নিরুৎসাহিত হতে পারে। 

সম্প্রতি রাজস্ব আহরণের লক্ষ্যমাত্রা পূরণে ব্যর্থতার কারণ জানতে চেয়েছিল আইএমএফ। এনবিআরের পক্ষ থেকে জানানো হয়, সংস্থাটি মূসক লক্ষ্যমাত্রা অর্জন করতে পেরেছে। আয়কর ও শুল্ক আহরণ করতে পারেনি। কারণ গত অর্থবছরে আমদানি কমেছে। ফলে আমদানিতে অগ্রিম কর কম আহরণ করা হয়েছে। একই সমস্যা হয়েছে শুল্ক আহরণেও। দেশের বিরাজমান অর্থনৈতিক সংকট, শিল্পের অস্থিরতা ও জুলাই-আগস্ট আন্দোলন ঘিরে স্থবিরতায় রাজস্বের যে ঘাটতি প্রথম দুইমাসে হয়েছে সেটি উল্লেখ করে চলতি অর্থবছরের জন্য নির্ধারিত দশমিক ৫ শতাংশ রাজস্ব আহরণ লক্ষ্যমাত্রা কমানোরও আহ্বান আইএমএফকে জানানো হয়েছে।

আইএমএফেরও উচিত বিষয়টি বিবেচনায় রাখা। অবশ্য আগেও আইএমএফ রাজস্বসংক্রান্ত শর্ত শিথিল করে কিস্তিতে ঋণের অর্থছাড় দিয়েছে। প্রত্যাশা করা যায়, এবারো সংস্থাটি বাস্তবতার নিরিখে সিদ্ধান্ত নেবে এবং ঋণের চতুর্থ কিস্তি ছাড় বাধাপ্রাপ্ত হবে না।

এই বিভাগের আরও খবর

আরও পড়ুন