ঋণ শ্রেণীকরণ পদ্ধতিতে বড় পরিবর্তন

ব্যাংক খাতে মন্দ ঋণের প্রকোপ কমাতে সহায়ক হতে পারে

ছবি : বণিক বার্তা

ব্যাংক ব্যবস্থা হচ্ছে একটি দেশের অর্থনীতির গুরুত্বপূর্ণ চলক। ব্যাংক ব্যবস্থা যত সুশৃঙ্খল, যত বেশি গাইডলাইন মেনে চলে, তত বেশি এ ব্যবস্থা ভালোভাবে চলতে পারে। তাতে ব্যাংকেরও ভালো হয়, দেশেরও ভালো হয় এবং সরকারের অগ্রাধিকার খাতে তা অবদান রাখতে পারে। কিন্তু দেশের ব্যাংকগুলো ঋণ প্রদানের ক্ষেত্রে ঋণগ্রহীতার সক্ষমতা ও ঋণের ঝুঁকি কম বিবেচনায় নেয়। এসব ক্ষেত্রে প্রভাবশালীদের অনৈতিক হস্তক্ষেপে ব্যাংকগুলোর অবস্থা নাজুক হয়ে পড়েছে। অনাদায়ী বা খেলাপি ঋণ দেশের ব্যাংক খাতের অন্যতম বড় ক্ষত। বছরের পর বছর খেলাপি ঋণের পরিমাণ বাড়ছে। খেলাপি ঋণ আদায়ে কিংবা নিয়ন্ত্রণে দেশের ব্যাংক খাতের নিয়ন্ত্রক সংস্থা কেন্দ্রীয় ব্যাংকের কোনো শক্ত পদক্ষেপ লক্ষ করা যায়নি। বরং বরাবরই কৌশলে ঋণখেলাপিদের সুবিধা দেয়া হয়েছে। এ কারণেই বেড়েছে খেলাপি ঋণ। খেলাপির মতো মেয়াদোত্তীর্ণ ঋণের পরিমাণও ব্যাপক মাত্রায় বাড়ছে, যা পরবর্তী সময়ে খেলাপি ঋণে পরিণত হচ্ছে। আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিলের (আইএমএফ) সঙ্গে বাংলাদেশের প্রতিশ্রুতি অনুযায়ী ঋণ শ্রেণীকরণ ও সঞ্চিতি বিধিমালা শক্তিশালীকরণের কাজ চলছে। যথাযথভাবে এর বাস্তবায়ন হলে প্রাথমিকভাবে খেলাপি ঋণের পরিমাণ বাড়বে। পাশাপাশি ব্যাংক খাতের প্রকৃত চিত্র ফুটে উঠবে, যা দীর্ঘমেয়াদে ভালো ফল পাওয়া যেতে পারে। ২০২৫ সালের মার্চ শেষে ঋণ পরিশোধের নির্ধারিত সময়ের একদিন পর থেকেই তা মেয়াদোত্তীর্ণ হিসেবে গণ্য হবে। মেয়াদোত্তীর্ণ ঋণ বারবার পুনঃতফসিলের সুযোগ আর থাকবে না। 

আগামী ডিসেম্বরের মধ্যে এটি বাস্তবায়নের লক্ষ্যমাত্রা রয়েছে। পাশাপাশি দুর্দশাগ্রস্ত সম্পদের প্রকৃত চিত্র শনাক্তে ইন্টারন্যাশনাল ফাইন্যান্সিয়াল রিপোর্টিং স্ট্যান্ডার্ড ৯ (আইএফআরএস৯) গ্রহণের পরিকল্পনা প্রণয়নের প্রতিশ্রুতি দেয়া হয়েছে। আগামী বছরের জুনের মধ্যে এ পরিকল্পনা প্রণয়নের লক্ষ্যমাত্রা রয়েছে। ব্যাংক খাতে আইএফআরএস৯-এর পূর্ণাঙ্গ বাস্তবায়ন করতে হবে ২০২৭ সালের মধ্যে। এটি বাস্তবায়নে আইএমএফের কাছে কারিগরি সহায়তাও চেয়েছে বাংলাদেশ।

নতুন পরিকল্পনা অনুসারে, এ বছরের এপ্রিল-সেপ্টেম্বরে যেসব ঋণের মেয়াদ শেষ হবে সেগুলোর ক্ষেত্রে নির্ধারিত সময়ের সঙ্গে ১৮০ দিন যোগ করে মেয়াদোত্তীর্ণ ঋণ হিসাব করা হবে। এর পর থেকে বছরের শেষ পর্যন্ত যেসব ঋণের মেয়াদ শেষ হবে সেগুলোর ক্ষেত্রে নির্ধারিত সময়ের সঙ্গে ৯০ দিন যোগ করে মেয়াদোত্তীর্ণ ঋণ হিসাব করা হবে। এর পর থেকে ৯০ দিনের গ্রেস পিরিয়ড তুলে দেয়া হবে। আর ২০২৫ সালের মার্চ শেষে ঋণ পরিশোধের নির্ধারিত সময়ের একদিন পর থেকেই তা মেয়াদোত্তীর্ণ হিসেবে গণ্য করা হবে। 

দেশের ব্যাংক খাতে শৃঙ্খলা ফেরাতে আন্তর্জাতিক হিসাবমান খুবই গুরুত্বপূর্ণ। ঋণ শ্রেণীকরণের ক্ষেত্রে ছাড় দেয়ার কারণে আন্তর্জাতিক হিসাবমান পুরোপুরি বাস্তবায়ন হচ্ছে না। ঋণ শ্রেণীকরণ ও আন্তর্জাতিক হিসাবমান বাস্তবায়ন হলে খেলাপি ঋণ ও মেয়াদোত্তীর্ণ ঋণের পরিমাণ প্রাথমিকভাবে অনেক বেড়ে যাবে। বর্তমানে যেসব সম্পদকে ভালো দেখানো হচ্ছে সেগুলোর বড় একটি অংশ মন্দমানে চলে যাবে। তখন এর বিপরীতে সঞ্চিতি সংরক্ষণ করতে হবে। এতে ব্যাংক খাতের আয় ও মুনাফাও কমে যাবে। সাময়িকভাবে সমস্যার সম্মুখীন হলেও দীর্ঘমেয়াদে এর সুফল পাওয়া যাবে এবং ব্যাংক খাতের প্রকৃত চিত্র উঠে আসবে। যেকোনো খাতের উন্নয়নে সঠিক উপাত্ত গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। সঠিক উপাত্ত জানা থাকলে নীতিনির্ধারকদের সঠিক ও কার্যকরী সিদ্ধান্ত নেয়া সহজ হয়। 

বিগত বছরগুলোয় খেলাপি ঋণ বেড়েই চলেছে। এর পরও খেলাপি ঋণ উদ্ধারে সরকারের তেমন কোনো তৎপরতা দৃশ্যমান হয়নি। এ ঋণ আদায়ে সরকারকে শক্ত পদক্ষেপ নিতে হবে। প্রয়োজনে বিশেষ আইন করে ঋণখেলাপিদের বিচারের আওতায় এনে খেলাপি ঋণ আদায়ে উদ্যোগ নিতে হবে। কেননা ব্যাংকগুলো বর্তমানে তারল্য সংকটে ভুগছে। এ সংকটের কারণে দেশের ব্যবসায়ীরা বিভিন্ন জটিলতায় পড়ছেন। অপরাধকে অপরাধ হিসেবে গণ্য করতে হবে। এখানে স্বজনপ্রীতি কিংবা ক্ষমতার প্রভাবকে কোনো প্রশ্রয় দেয়া যাবে না। 

এছাড়া ঋণ প্রদানে কোনো ঝুঁকি বা পরিশোধের সক্ষমতা পুঙ্খানুপুঙ্খ যাচাই-বাছাই করেই ঋণ ছাড় করতে হবে। বড় ঋণ ছাড় কিংবা ঋণ অনুমোদনে যেসব অনৈতিক হস্তক্ষেপ হয়ে থাকে সেগুলো চিরতরে নির্মূল করে ব্যাংক খাতে পেশাদারত্ব নিশ্চিত করতে হবে। এটি সরকারেরই দায়িত্ব। ঋণের ঝুঁকি ও ঋণ প্রদানের সক্ষমতা বিবেচনা না করে যদি কোনো ঋণ মঞ্জুর করা হয়, সেক্ষেত্রে যারা এ প্রক্রিয়ায় জড়িত তাদের বিরুদ্ধে তদন্ত করে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নিতে হবে।

চলতি বছরের মার্চ শেষে ব্যাংক খাতে খেলাপি ঋণের পরিমাণ দাঁড়িয়েছে ১ লাখ ৮২ হাজার ২৯৫ কোটি টাকা। আগের বছর মার্চ শেষে খেলাপি ঋণ ছিল ১ লাখ ৩১ হাজার ৬২০ কোটি এবং ২০২২ সালের একই সময় শেষে ছিল ১ লাখ ১৩ হাজার ৪৪০ কোটি টাকা। সে হিসাবে দুই বছরের ব্যবধানে খেলাপি ঋণের পরিমাণ বেড়েছে প্রায় ৬১ শতাংশ। 

আইএমএফের কাছে খেলাপি ঋণ কমিয়ে আনার বিষয়েও প্রতিশ্রুতি দিয়েছে বাংলাদেশ। এক্ষেত্রে সার্বিকভাবে ব্যাংক খাতের খেলাপি ঋণ ৮ শতাংশে নামিয়ে আনার লক্ষ্যমাত্রা রয়েছে। এর মধ্যে ২০২৫-২৬ অর্থবছর শেষে রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংকের খেলাপি ঋণ ১০ শতাংশে এবং বেসরকারি বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলোর খেলাপি ঋণ ৫ শতাংশে নামিয়ে আনার কথা রয়েছে।

নির্ধারিত সময়ের মধ্যে খেলাপি ঋণ ৮ শতাংশে নামিয়ে আনার প্রতিশ্রুতি বাস্তবায়ন করতে হলে ব্যাংক খাতে প্রয়োজনীয় সংস্কারের পাশাপাশি শক্ত পদক্ষেপ নিতে হবে। আইনের বাস্তবায়ন না হলে শুধু সংস্কারে তেমন ফল দেবে না, সে বিষয়টিও সরকারকে বিবেচনায় নিতে হবে। তাই আইনের কার্যকর বাস্তবায়ন জরুরি। 

বর্তমানে বাংলাদেশ ব্যাংকের পক্ষ থেকে বিভিন্ন প্রবিধির মাধ্যমে আইএফআরএস৯-এর বাস্তবায়নের বিষয়টি স্থগিত রাখা হয়েছে। এতে ব্যাংক খাতের স্বচ্ছতা প্রশ্নের সম্মুখীন হচ্ছে। পুরো বিশ্বেই আইএফআরএস৯ বাস্তবায়ন করা হয়েছে। এটি একটি বৈশ্বিক চর্চা। বৈশ্বিক আর্থিক ব্যবস্থা ও পুঁজিবাজারের সঙ্গে দেশের সংযোগ বাড়াতে হলে আর্থিক প্রতিবেদন ও নিরীক্ষায় বৈশ্বিক মান বজায় রাখা অতীব জরুরি।

এই বিভাগের আরও খবর

আরও পড়ুন