আমার শিক্ষক ড. তাসনিম সিদ্দিকী

ড. শামসুন্নাহার

ছবি : বণিক বার্তা

একজন শিক্ষার্থীর শিক্ষাজীবনের বিভিন্ন পর্যায়ে অনুকরণীয় শিক্ষক থাকবে—এটাই স্বাভাবিক। আমার ক্ষেত্রেও তার ব্যতিক্রম নয়। কিন্তু কোনো শিক্ষকের ব্যক্তিত্ব এবং জীবনাচরণ যখন কোনো শিক্ষার্থীর শিক্ষাজীবন, ব্যক্তিজীবন, কর্মজীবন এমনকি কর্ম-পরবর্তী জীবনের ভাবনাকেও প্রভাবিত করতে পারে—সেখানেই বোধ হয় একজন শিক্ষকের প্রকৃত স্বার্থকতা। হ্যাঁ, আমার ক্ষেত্রে সেই শিক্ষক হলেন ড. তাসনিম সিদ্দিকী। তার সঙ্গে আমার সম্পর্ক টানা ৩২ বছরের। ১৯৯২-তে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের রাষ্ট্রবিজ্ঞানে ভর্তি হয়েছিলাম। সেই সুবাদেই তাকে প্রথম দেখি সম্ভবত ১৯৯২ সালের কোনো একদিন যখন তিনি কলাভবনের রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগের করিডোর দিয়ে চুলের পেছনে লাল রঙের বো ক্লিপ এবং থ্রি-পিসের এক সাইডে ওড়না পরে এদিক-ওদিক তাকিয়ে কিছুটা দ্রুত গতিতে হেঁটে যাচ্ছিলেন। তার চলার মধ্যেই কেমনভাবে যেন প্রতিফলিত হচ্ছিল একটি আত্মপ্রত্যয়ী এবং ব্যক্তিত্বসম্পন্ন ভঙ্গি। ১৯৯৩ সালে যখন আমি দ্বিতীয় বর্ষে তখন তাকে সরাসরি কোর্স শিক্ষক হিসেবে পাই। এর পর থেকেই তাকে নিয়মিত দেখতাম। আর খেয়াল করতাম তিনি যখন ক্লাস নিতেন কিংবা বিভাগের করিডোর দিয়ে হেঁটে ক্লাসে যেতেন তখন তার ব্যক্তিত্ব আমাদের দুষ্ট বন্ধুদের মুখও যেন আটকে দিত। যারা কিনা কারো সাজ পোশাকে একটু ব্যতিক্রম দেখলেই যে কাউকেই টিজ করতে ছাড়ত না। উপরন্তু তার বেলায় তাদের চোখে-মুখে প্রস্ফুটিত হতো শ্রদ্ধাবনত দৃষ্টি।

যতদূর মনে পড়ছে, তিনি আমাদের Qualitative & Quantitative Approach to Study Politics, Modernization of Political Development and Social Change—এ কোর্সগুলো পড়াতেন। আমার স্পষ্টভাবেই মনে পড়ে যে, অনেক কঠিন বিষয়কে তিনি অনেক বিস্তৃতভাবে ব্যাখ্যা করতেন এবং শেষের দিকে পুরো বিষয়বস্তুকে গুছিয়ে এনে ছোট্ট করে আমাদের মগজে ঢুকিয়ে দিতেন। একইভাবে তিনি আমাদের কাছ থেকে পড়া বুঝে নেয়ার ক্ষেত্রেও ছিলেন অত্যন্ত কঠোর। সেখানে ফাঁকি দেয়ার কোনো সুযোগই ছিল না। এক কথায় শিক্ষার ধারাবাহিকতা ও মান বজায় রাখতে তিনি ছিলেন আপসহীন। তার পাঠদান কৌশল ও দক্ষতা সম্পর্কে এটা আমার সেই সময়ের সুস্পষ্ট অনুভূতি।

এসব অনুভূতি নিয়েই ১৯৯৯ সালে তাকে আমার এমফিলের সুপারভাইজার হিসেবে পাই। শুরু হয় মেন্টর হিসেবে তাকে কাছ থেকে জানার ও বোঝার। আমার গবেষণায় হাতেখড়ি তার মাধ্যমেই। গবেষণার ছোটখাটো প্রতিটি বিষয় তার শত ব্যস্ততার মধ্যেও অত্যন্ত সুস্পষ্ট এবং সুনির্দিষ্টভাবে বুঝিয়ে দিতেন। পরবর্তী সময়ে ২০০১ সালে আমি এএসপি হিসেবে বাংলাদেশ পুলিশ বিভাগে যোগদান করি। সে কারণে সঠিকভাবে পড়ালেখায় সময় দেয়া কষ্টসাধ্য হয়ে পড়ে। কিন্তু তার উৎসাহ ও সহযোগিতায় ২০০৫ সালে আমি এমফিল সম্পন্ন করি। ২০০৬ সালে Chevening স্কলারশিপ নিয়ে ইংল্যান্ডের বার্মিংহাম বিশ্ববিদ্যালয়ে এমবিএ করতে যাই। সে সময় আমার ডিসার্টেশন লেখার সময়ও তার পরামর্শ নিতাম। এমবিএ শেষ করে দেশে ফিরে ২০০৮ সালে তার তত্ত্বাবধানে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে পিএইচডি প্রোগ্রামে ভর্তি হই। যেহেতু আমার পূর্ণকালীন চাকরির কারণে খুব একটা সময় পাই না। তাই তিনি আমার এমবিএর ডিসার্টেশন টপিকের সঙ্গে মিল রেখে পিএইচডি গবেষণার বিষয় নেয়ার পরামর্শ দিলেন। সে অনুসারেই পিএইচডির টপিক নির্ধারণ করলাম এবং আমি আমার গবেষণা কাজ শুরু করলাম। এর মাধ্যমে তার সঙ্গে যেন আমার অনন্তকালের সম্পর্কের একটি সেতুবন্ধ তৈরি হলো। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হলাম ঠিকই কিন্তু মন আমার টানে বিদেশের কোনো বিশ্ববিদ্যালয় থেকে পিএইচডি করার জন্য। বিষয়টি আমি তাকে জানাই এবং আমার পিএইচডির তত্ত্বাবধায়ক হওয়া সত্ত্বেও তিনি বলেন, ‘‌হ্যাঁ, হ্যাঁ, বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ে লিখো এবং আমাকে কী করতে হবে বলো’। আমি তখন তাকে বললাম, ‘আপনাকে আমার Referee হিসেবে দিতে চাই’। তিনি বললেন ‘অবশ্যই, কী লিখতে হবে লিখে নিয়ে আসো সাইন করে দিচ্ছি।’ সেদিন তার সেই কথার মাধ্যমে তিনি আমার অন্তরে একজন উদার এবং উন্নত মনের মানুষ হিসেবে প্রতিষ্ঠিত হলেন। এভাবেই একটু একটু কাজ করি, সময় বাড়াই, চাকরি করি আর ফাঁকে ফাঁকে বাইরের বিশ্ববিদ্যালয়গুলোয় আবেদন করি। কিন্তু ২০০৯-১৪ পর্যন্ত পূর্ব তিমুর এবং ইতালিতে দুই দফায় চার বছর জাতিসংঘে চাকরি করার কারণে পড়ালেখায় মনোনিবেশ করা খুব একটা সম্ভব হয়নি। এরপর ইতালি থেকে দেশে ফিরে চাঁদপুর জেলার এসপি থাকা অবস্থায় ২০১৬ সালে যুক্তরাষ্ট্রে পিএইচডির সুযোগ পেয়েও যাওয়া হয়নি। এদিকে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে আর সময় বাড়ানোর খুব বেশি সুযোগ নেই। জেলার এসপি হিসেবে দায়িত্ব পালনও অনেক গুরুত্বপূর্ণ। তাই বিদেশে পিএইচডি করার চিন্তা বাদ দিই। অবশেষে মনঃস্থির করে তার দেয়া সাহস ও উৎসাহের কারণেই গবেষণা কাজে মনোনিবেশ করি। এভাবেই তার সুস্পষ্ট দিকনির্দেশনা ও পরামর্শ অনুযায়ী আমি আমার গবেষণাকর্ম সম্পন্ন করে ২০২১ সালে পিএইচডি ডিগ্রি অর্জন করি।

আর এ দীর্ঘ পথপরিক্রমায় পড়ালেখার পাশাপাশি জীবনের চ্যালেঞ্জ এবং জীবনাচরণ সংক্রান্ত অনেক কিছুই তার সঙ্গে শেয়ার করা হয়। যার মাধ্যমে তিনি শিক্ষক থেকে মেন্টর এবং মেন্টর থেকে আমার মনে একজন বন্ধুতে পরিণত হয়ে যান। তার সঙ্গে আমার টানা ৩২ বছরের স্মৃতি ৩ মিনিটে সীমাবদ্ধ করা কঠিন বললে ভুল হবে, আসলেই অসম্ভব। একটি উদাহরণ—পড়ানোর ফাঁকে কোনো কিছুই তার দৃষ্টি এড়াত না। একদিন আমি আর আমার বিশ্ববিদ্যালয় জীবনের সবচেয়ে কাছের বান্ধবী (স্বপ্না) পাশাপাশি বসে দেখাদেখি করে টিউটোরিয়াল পরীক্ষা দিচ্ছিলাম। তিনি ধীরে ধীরে কাছে গিয়ে বললেন, ‘‌দুই বন্ধু সবসময় একসঙ্গে কিন্তু পরীক্ষার সময় তো একসঙ্গে বসা যাবে না।’ তার সেই কথার মাধ্যমে আমার মধ্যে অনুভূত হয়েছিল—একদিকে স্নেহ অন্যদিকে শাসন। সবচেয়ে বেশি আকৃষ্ট হয়েছিলাম যখন তিনি আমাদের দুই বান্ধবী না বলে দুই বন্ধু বলে সম্বোধন করলেন। যার মাধ্যমে আমার মনে হয়েছিল আমাদের সমাজসৃষ্ট সীমাবদ্ধ চিন্তাচেতনার ঊর্ধ্বে তার অবস্থান।

সর্বোপরি তার মেধা, পাঠদানের দক্ষতা, কথা বলার ধরন, চলনভঙ্গি, মনের বিশালতা ও ইংরেজিতে কথা বলা—সবকিছুই আমাকে দারুণ আকৃষ্ট করে। আর সবচেয়ে বেশি আকৃষ্ট হই তার পরিপাটি সংসার এবং যেভাবে তিনি তার স্বামী, সন্তানদের ও নাতি-নাতনিদের সময় দেন তা দেখে। আর এ দেখাই আমার ব্যক্তিজীবন, শিক্ষাজীবন, কর্মজীবন এমনকি কর্ম-পরবর্তী জীবনের ভাবনাকেও প্রভাবিত করে। এখানেই তার স্বার্থকতা। এভাবেই ড. তাসনিম সিদ্দিকী একজন সফল-স্বার্থক শিক্ষক হিসেবে শিক্ষার্থী মনে সুপ্রতিষ্ঠিত।

ড. শামসুন্নাহার: অতিরিক্ত ডেপুটি ইন্সপেক্টর জেনারেল, বাংলাদেশ পুলিশ

এই বিভাগের আরও খবর

আরও পড়ুন