বাজেট বিশ্লেষণ

১৫ শতাংশ হারে কর দিয়ে কালো টাকা সাদা করার বিধান নৈতিকতাবিরোধী

আব্দুল বায়েস

ছবি : বণিক বার্তা ( ফাইল ছবি)

জাতীয় সংসদে পাস হয়ে গেল ২০২৪-২৫ অর্থবছরের জাতীয় বাজেট। অর্থনীতির একটা অস্বস্তিকর এবং পীড়াদায়ক পরিবেশে দেশের নতুন অর্থমন্ত্রী আবুল হাসান মাহমুদ আলী এমপি সংসদের অনুমোদনের জন্য বাজেট পেশ করেছিলেন। অর্থমন্ত্রী হিসেবে হয়তো তিনি নতুন কিন্তু অর্থনীতির শিক্ষক, কূটনীতিক, সংসদ সদস্য এবং পররাষ্ট্র ও দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা মন্ত্রণালয়ের মন্ত্রীর অভিজ্ঞতায় তিনি প্রাংশু। এবার অন্তত অতীতের দু-একটা ‘ব্যবসায়ীবান্ধব’ বাজেট থেকে অর্থমন্ত্রী সরে এসেছেন বলে মনে হয়; তা যে কারণেই হোক। 

দুই.

গেলবারের তুলনায় এবারের বাজেটের আকার তুলনামূলক কম অথচ করোনার আগ পর্যন্ত বাজেটের আকার বেড়েছিল ১০-১২ শতাংশ হারে। মূলত দুটো কারণে বাজেটের আকার ছোট রেখে তিনি প্রজ্ঞার পরিচয় দিয়েছেন। প্রথমত, ব্যয় নির্বাহের জন্য অভ্যন্তরীণ বা বৈদেশিক উৎস থেকে ঋণ গ্রহণের অবকাশ ক্রমে সংকুচিত হয়ে আসছে; দ্বিতীয়ত, মূল্যস্ফীতি বা বাজারের আগুন নিয়ন্ত্রণে আনতে হলে সব ধরনের ব্যয় কমাতে হবে। বিশেষত যখন অর্থ সরবরাহ বৃদ্ধি মূল্যস্ফীতির অন্যতম শক্ত নিয়ামক। সন্দেহ নেই যে, এতে করে প্রবৃদ্ধির হার হ্রাস পাবে। তবে আপাতত উচ্চতর জিডিপি প্রবৃদ্ধির হার অর্জনের দিকে মনোনিবেশের পরিবর্তে, সামষ্টিক অর্থনৈতিক স্থিতিশীলতা পুনরুদ্ধারের দিকে মনোনিবেশ করেছেন বলে মনে হয়। নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যের ক্রমবর্ধমান মূল্যের লাগাম টেনে ধরতে হলে এর বিকল্প নেই। তবে এও ঠিক যে, আমরা আশা করেছিলাম অর্থমন্ত্রী বাজেট বক্তৃতায় বলবেন কেন অন্যান্য দেশে মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণে এলেও বাংলাদেশে তা অধরা রয়ে গেল; বিশেষ করে আমরা জানতে আগ্রহী ছিলাম কেন বাংলাদেশের বাজার ব্যবস্থা যথাযথভাবে কাজ করছে না বা পাস থ্রু এফেক্ট দুর্বল কী জন্য। 

তিন. 

সংসদে যে বাজেট অনুমোদিত হয়েছে, আশা করব সে বাজেটে খাদ্য উৎপাদন, সামাজিক সুরক্ষা, কৃষিতে ভর্তুকি এবং জ্বালানি, বিদ্যুৎ, স্বাস্থ্য ও শিক্ষা খাতে ‘প্রকৃত’ বরাদ্দের বৃদ্ধি বাস্তবায়নে যথাযথ মনোযোগ দেয়া হবে। সরকারের দেয়া ভর্তুকির সিংহভাগ রাঘববোয়াল ব্যবসায়ী, শিল্পপতিরা চেটেপুটে খায় বলে অভিযোগ আছে। সুতরাং পুরো ভর্তুকি প্রক্রিয়ায় পরিবর্তন আনা অত্যন্ত জরুরি, যাতে করে অপেক্ষাকৃত ক্ষুদ্র এবং দুর্বলের কাছে প্রবেশগম্যতা পায়। 

এ অঞ্চলে বাংলাদেশের কর-জিডিপি অনুপাত সবচেয়ে কম—এটা এমনকি আমজনতার ধারণা। এবার সে স্থবির অনুপাত টপকে যাওয়ার লক্ষ্য ঘোষণা প্রশংসনীয়, তবে পথ ও পাথেয় নিয়ে বিতর্ক আছে। গবেষকরা বলছেন, করজাল বিস্তৃত করে, আয়কর বাড়িয়ে পরোক্ষ করের চাপ কিছুটা হলেও লাঘব করা যায়। 

চার.

নীতিগত বিষয়ে কিছুটা অগ্রগতি তো আছেই এবং তা জানা দরকার। প্রায় দুই বছরের ব্যবধানের পর অবশেষে বৈদেশিক মুদ্রা ব্যবস্থা এবং মুদ্রানীতিকে যথাস্থানে রাখা হয়েছে সমন্বয়ের মাধ্যমে। এ সাহসী নীতিগত সিদ্ধান্ত ভালোভাবে বাস্তবায়ন হলে মুদ্রাস্ফীতি কমাতে এবং বিনিময় হার স্থিতিশীলে সাহায্য করবে বলে মনে করেন পলিসি রিসার্চ ইনস্টিটিউটের বিশিষ্ট অর্থনীতিবিদ সাদিক আহমেদ।

সমন্বয় প্রক্রিয়ার পরবর্তী ধাপ হলো রাজস্ব নীতি সমন্বয়ের সঙ্গে এ নীতি সংস্কারের কার্যকারিতা বাড়ানো। কেননা মুদ্রাস্ফীতি কমাতে রাজস্ব নীতি সংস্কার বিশেষভাবে গুরুত্বপূর্ণ। রাজস্ব সংক্রান্ত সমন্বয়ের প্রয়োজনীয়তা অনুধাবন করা খুব সহজ। যেমন মূল্যস্ফীতি কমাতে অভ্যন্তরীণ চাহিদা কমানো প্রয়োজন। এটি করতে হলে স্বভাবতই মোট ঋণের প্রবৃদ্ধি হ্রাস করার দিকে ইঙ্গিত আসে। ধর্তব্য যদিও ঋণের মোট চাহিদায় বেসরকারি খাতের প্রাধান্য রয়েছে, বছরের পর বছর ধরে সরকারি খাতও ঋণের বাজারে একটি গুরুত্বপূর্ণ শক্তি হিসেবে আবির্ভূত হয়েছে। সুতরাং ব্যক্তি খাতে ঋণ কমালেই মূল্যস্ফীতি কমবে সেটা মনে করা বোধ হয় ঠিক নয়। 

সন্দেহ নেই যে, মুদ্রানীতি সংশোধনের ফলে সুদের হার বেড়েছে, এর ফলে বেসরকারি খাতের ঋণের চাহিদা কমেছে এবং আমরা ধরে নিতে পারি যে, এটা অভ্যন্তরীণ মুদ্রাস্ফীতি ও বিনিময় হার উভয়ের ওপর চাহিদার চাপ কমাতে সাহায্য করবে। কিন্তু সরকারি খাতের বা সরকারের ঋণের চাহিদা মূলত বাজেট ঘাটতি এবং কীভাবে এ ঘাটতি অর্থায়ন করা হয় তার ওপর নির্ভর করে। বলা যেতে পারে যে, রাজস্ব ঘাটতির মাত্রা যত কম হবে এবং বিদেশী ও নন-ব্যাংক প্রাইভেট ফাইন্যান্সিংয়ের শেয়ার যত বেশি হবে, সরকারি খাতে ব্যাংক ঋণের চাহিদা তত কম হওয়ার সম্ভাবনা থাকে।

পাঁচ.

২০২৪-২৫ অর্থবছরের বাজেট মাত্র ক’দিন আগে পেশ করা হলো; রাজস্ব ঘাটতির লক্ষ্য নির্ধারণ করা হয়েছে জিডিপির ৪ দশমিক ৬ শতাংশ। এর মধ্যে জিডিপির প্রায় ১ দশমিক ৭ শতাংশ বৈদেশিক ঋণের মাধ্যমে অর্থায়ন করা হবে এবং জিডিপির শূন্য ৪ শতাংশ নন-ব্যাংক ব্যক্তিগত ঋণের মাধ্যমে অর্থায়ন করা হবে। তার মানে, ব্যাংকের মাধ্যমে অর্থায়নের মাত্রা হবে জিডিপির ২ দশমিক ৫ শতাংশ। চুলচেরা হিসাবে প্রতীয়মান হয় যে, মুদ্রাস্ফীতি নিয়ন্ত্রণের লক্ষ্যে মুদ্রানীতির লক্ষ্যমাত্রা দ্বারা নির্ধারিত মোট ঋণ বৃদ্ধির সীমা বেঁধে দেয়া হলে রাজস্ব ঘাটতির জন্য ব্যাংক অর্থায়নের এ মাত্রা বেসরকারি খাতের ব্যাংক ঋণকে উল্লেখযোগ্যভাবে বাইরে ঠেলে দেবে। অর্থাৎ ব্যক্তি খাত সরকারি খাতের কনুইর গুঁতায় রিংয়ের বাইরে অবস্থান নিতে বাধ্য। সুতরাং মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণের সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ ঋণের সীমিত সরবরাহের জন্য বেসরকারি খাত সরকারের সঙ্গে প্রতিযোগিতায় নামা মানেই সুদের হার বেড়ে যাবে।

অন্যদিকে বেসরকারি খাতের রাজনৈতিক চাপ সম্ভবত বাংলাদেশ ব্যাংককে ঋণ বৃদ্ধির লক্ষ্যমাত্রা শিথিলে বাধ্য করবে এবং এ উদ্যোগ মুদ্রস্ফীতি নিয়ন্ত্রণ কৌশলের সঙ্গে আপস করতে হবে বলে ধারণা করা চলে এবং এটাই হবে সবচেয়ে দুর্ভাগ্যজনক। বেসরকারি খাতের প্রতি ন্যায্য হয়ে বলতে হয়, জিডিপি প্রবৃদ্ধির ইঞ্জিন হিসেবে কাজ করে এমন বেসরকারি খাতের ওপর সব সমন্বয়ের চাপ দেয়া এক অর্থে খারাপ অর্থনৈতিক ব্যবস্থাপনা। তাই এমন ক্রান্তিলগ্নে সরকারের উচিৎ হবে রাজস্ব ঘাটতি মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণের সঙ্গে সংগতিপূর্ণ করে রাখা।

ছয়.

তিনটি রাজস্ব নীতি ব্যবস্থার মাধ্যমে ঘাটতি অর্থায়ন ঝামেলা সহজেই মিটমাট করা যেতে পারে বলে মনে করছেন অর্থনীতিবিদ সাদিক আহমেদ। প্রথমত, নৌকা দুলে যাওয়ার ভয়ে সরকার ধনী ও ক্ষমতাবানদের করের ক্ষেত্রে সাহসী পদক্ষেপ নিতে অনিচ্ছুক, সেক্ষেত্রে উচিত হবে রাষ্ট্রীয় মালিকানাধীন উদ্যোগগুলোর কিছু মৌলিক সংস্কারের আশ্রয় নিয়ে সরকারের আয় বাড়াতে সাহায্য করা। এ উদ্যোগে সরকারের বিনিয়োগ থেকে আয় বৃদ্ধি পাবে। এটা কীভাবে সম্ভব তার বিস্তারিত নিয়ে অর্থ মন্ত্রণালয় এরই মধ্যে অবহিত আছে বলে জানতে পারি। 

দ্বিতীয়ত, সরকার জীবাশ্ম জ্বালানি, বিদ্যুৎ, রফতানি এবং রেমিট্যান্সের ওপর ভর্তুকি বাদ দিতে পারে যা জিডিপির প্রায় ১ দশমিক ২ শতাংশ বাজেট সাশ্রয় করবে। আবার বিনিময় হার মুক্ত করলে রফতানি ও রেমিট্যান্সে ভর্তুকি অপ্রয়োজনীয় হয়ে পড়বে। মনে রাখা দরকার, জীবাশ্ম জ্বালানিতে ভর্তুকি প্রদান কার্বন নির্গমন কমাতে সরকারের প্রতিশ্রুতির সঙ্গে অসংগতিপূর্ণ।

বিদ্যুৎ খাতে, আইপিপি এবং রেন্টাল পাওয়ার কন্ট্রাক্টে যে ভুলগুলো হয়েছে সেগুলো ভর্তুকি দিয়ে অতিরিক্ত খরচের অর্থায়ন না করে বরং সংশোধন করতে হবে। কম খরচে বিদ্যুৎ উৎপাদনকে সর্বনিম্ন খরচের উৎসে ফিরে যেতে হবে। বিদ্যুতের দাম কোনো ভর্তুকি ছাড়াই বিদ্যুৎ উৎপাদনের প্রকৃত খরচ প্রতিফলিত করতে হবে।

তৃতীয়ত এবং পরিশেষে, সরকারের উচিত ছিল ২০২৪-২৫ অর্থবছরে বার্ষিক উন্নয়ন কর্মসূচির (এডিপি) আকারকে আরো কম এবং বাস্তবসম্মত স্তরে পুনর্মূল্যায়ন করা। তবে অবশ্যই শিক্ষা, প্রশিক্ষণ, স্বাস্থ্য, জল এবং সামাজিক সুরক্ষার জন্য বরাদ্দ বাড়াতে হবে এবং দীর্ঘমেয়াদি মেগা অবকাঠামো প্রকল্পগুলোর জন্য বরাদ্দ কমাতে হবে। এ পুনর্বণ্টন জিডিপি প্রবৃদ্ধি এবং দারিদ্র্য হ্রাসকে দীর্ঘমেয়াদি মেগা পরিবহন অবকাঠামো প্রকল্পগুলোর তুলনায় ভালোভাবে রক্ষা করবে। যা শুধু দীর্ঘমেয়াদে সুবিধা প্রদান করবে।

সাত.

সাধারণ মানুষ মনে করে সরকারের অর্থের অভাব নেই। জিডিপির ৪০ শতাংশ কর কর্তৃপক্ষের ধরাছোঁয়ার বাইরে এবং ধনীরা কর দেয় না; উদ্যোগ নিতে হবে এগুলো সংগ্রহ করে কোষাগারে আনা। প্রভাবশালীদের রুষ্ট করে সরকার সমুচিত সংস্কার সাধনে কতটা প্রত্যয়ী তাও প্রশ্নের মুখোমুখি। ১৫ শতাংশ হারে কর দিয়ে কালো টাকা সাদা করার বিধান, ঋণখেলাপিদের জন্য নানা প্রণোদনার ব্যবস্থা করা নৈতিকতার নিরিখে বেমানান।

এখন কঠিন সময়। কঠোর না হলে চলবে না। 

আব্দুল বায়েস: সাবেক উপাচার্য, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়

এই বিভাগের আরও খবর

আরও পড়ুন