শিক্ষা ভাবনা

পুরনো শিট ও লেকচার নোটনির্ভর পড়াশোনা শিক্ষা খাতের ‘ফরমালিন’

ড. মো. এরশাদ হালিম

ছবি : বণিক বার্তা ( ফাইল ছবি)

বাণিজ্যিকভাবে ফরমালডিহাইডের ৩৭-৪০ শতাংশ জলীয় দ্রবণ বাজারে ফরমালিন নামে পরিচিত যার রাসায়নিক সংকেত H-CHO। ফরমালডিহাইড মূলত সাদা রঙের একটি পাউডার যা পানিতে সহজেই দ্রবীভূত হয়। অধিকন্তু ফরমালিনে ১০-১৫ শতাংশ মিথানল মিশ্রিত থাকে। ফরমালডিহাইড ও মিথানল উভয়ই বিষাক্ত, ক্ষতিকর রাসায়নিক পদার্থ, যার প্রভাব মানবদেহে বিভিন্নভাবে পরিলক্ষিত হয়। লিভার বা যকৃতে মিথানল এনজাইমের উপস্থিতিতে জারণ প্রক্রিয়ায় প্রথমে ফরমালডিহাইড এবং পরে ফরমিক অ্যাসিডে রূপান্তরিত হয়। অন্যদিকে মানবদেহে ফরমালিন এবং ফরমালডিহাইডও একই প্রক্রিয়ায় ফরমিক এসিডে রূপান্তরিত হয়। ফলে রক্তের অ্যাসিডিটি বেড়ে যায় এবং শ্বাস-প্রশ্বাস অস্বাভাবিকভাবে ওঠানামা করে। 

পাশাপাশি ফরমালিনযুক্ত খাবার গ্রহণ করায় পাকস্থলী, ফুসফুস ও শ্বাসনালিতে ক্যান্সার হতে পারে। অস্থিমজ্জা আক্রান্ত হওয়ার ফলে দেখা দিতে পারে রক্তশূন্যতাসহ মরণব্যাধি ব্লাড ক্যান্সারের ঝুঁকি। শিশুদের বুদ্ধিমত্তা মারাত্মকভাবে হ্রাস পেতে পারে। দেখা দিতে পারে গর্ভবতী মায়েদের সন্তান প্রসবকালীন জটিলতাসহ শিশুর জন্মগত বিভিন্ন ত্রুটি। শিশু জন্মগতভাবেই বরণ করতে পারে প্রতিবন্ধিত্ব। ফরমালিনযুক্ত খাবার ভক্ষণে কিডনি, লিভারের সমস্যাসহ নানা ধরনের চর্মরোগ, ডায়রিয়া ও পেটের ক্রনিক পীড়ার ঝুঁকিও রয়ে যায়। 

এছাড়া ফরমালিনের রয়েছে বহুমুখী ব্যবহার। এটি পরীক্ষাগারে জৈব সংশ্লেষণে বিকারক হিসেবে ব্যবহার হয়। শিল্প-কারখানায়ও রয়েছে ফরমালিনের ব্যাপক ব্যবহার। ফরমালিন টেক্সটাইল, প্লাস্টিক, পেপার, রঙ ও বিভিন্ন কনস্ট্রাকশন শিল্পসহ মেডিকেল গবেষণাগারে মরদেহ সংরক্ষণে ব্যবহার হয়। বাজারে বিভিন্ন ধরনের ফল, শাকসবজি ও মাছ সংরক্ষণেও প্রয়োগ করা হয় ফরমালিন। কাজেই ফরমালিন ব্যবহারে ভালো ও মন্দ দুটো দিকই রয়েছে যার নিয়ন্ত্রণ সম্পূর্ণরূপে আমাদের বিবেচনাধীন।

একইভাবে শিক্ষা অমূল্য এক সম্পদ, জাতির মেরুদণ্ড। কারণ শিক্ষাই মানুষের ভেতরকার সুপ্ত আত্মাকে জাগরিত করে এবং তাদের করে তোলে বুদ্ধি-বিবেকসম্পন্ন। শিক্ষা ছাড়া কোনো জাতিই আলোর মুখ দেখতে পায় না। শিক্ষকরা সেই শিক্ষার ধারক, বাহক ও কাণ্ডারি। তাই জাতি গঠনে একজন শিক্ষকের ভূমিকা অনস্বীকার্য। মূলত শিক্ষকরাই কোনো একটি জাতির প্রকৃত স্থপতি। 

শিক্ষকতা এমন একটি পেশা যেখানে শিক্ষার্থীর পাশাপাশি শিক্ষককেও সারা জীবন ধরে শুধু শিখতে হয় যা একটি চলমান প্রক্রিয়া। জ্ঞান আহরণ ও জ্ঞান বিতরণই পেশাগতভাবে একজন শিক্ষকের প্রধান কাজ। জ্ঞান বিতরণের কাজটি আবার এতটা সহজসাধ্যও নয়। দুনিয়ার সবচেয়ে কঠিন কাজগুলোর একটি হচ্ছে জ্ঞান আহরণ। তাই জ্ঞান অর্জনের পথ যতটা প্রশস্ত হয়, জ্ঞান বিতরণের মাত্রাও হয় ততটা সমৃদ্ধ। এ কারণেই শিক্ষকতা খুবই দায়িত্বশীল এবং মহান একটি পেশা। 

ক্লাসে পড়ানোর আগে যথাযথ অনুশীলনের মাধ্যমে একজন শিক্ষককে পুরো বিষয়বস্তু নখদর্পণে রাখতে হয়। কোর্সের পাঠ্যসূচি পরিষ্কারভাবে অনুধাবন করা অনস্বীকার্য। পাশাপাশি তাকে লেকচার শিট সঙ্গে বহন করতে হয় যদিও বিজ্ঞানের আশীর্বাদে তথ্য-প্রযুক্তির যুগে লেকচার শিটের জায়গাটি দখল করে নিয়েছে ইউএসবি বা পেন ড্রাইভ সংবলিত পড়াশোনা যা পাওয়ার পয়েন্ট প্রেজেন্টেশনের মাধ্যমে ছাত্রছাত্রীদের সম্মুখে প্রদর্শন করা হয়। পাশাপাশি শিক্ষক সংশ্লিষ্ট বিষয়গুলোর ওপর লেকচার দেন এবং শিক্ষার্থীদের কৌতূহলপ্রসূত বিভিন্ন প্রশ্নাবলির উত্তর দেন। এতে লেকচার প্রদান অনেকটাই সহজ হয়ে যায়। একবার লেকচার তৈরি করে নিলেই সারা জীবনের জন্য দফারফা শেষ। অন্তত চক-ডাস্টার ব্যবহারের বিড়ম্বনা থেকে রেহাই পাওয়া যায়। পরবর্তী সময়ে শ্রেণীকক্ষে গিয়ে শুধু বায়োস্কোপ দেখিয়ে পাঠদান করলেই দায়িত্ব শেষ হয়ে যায়। ১৫ বছর আগে এবং পরে একই স্লাইড সমান তালে চলতে থাকে বিরতিহীন ইঞ্জিনের মতো যার ক্ষয় একসময় অবশ্যম্ভাবী। আসলে উচ্চ শিক্ষার দর্শন পুরোপুরি এমনটা নয়। এখানে কিছুদিন পরপর লেকচার শিট বা স্লাইডগুলো আপডেট করতে হয়, নিত্যনতুন তথ্যবলি সংবলিত পাঠ্যসূচি যোগ করতে হয়। পুরনো অনেক তথ্যকে পুনরায় সংস্করণ করতে হয় যেভাবে পাঠ্যবইগুলোর বিভিন্ন এডিটেড ভার্সন কয়েক বছর পরপর বাজারে বের হয়। পাশাপাশি বিজ্ঞান গবেষণা কখনো বসে থাকে না। দেখা যায়, পরমাণুর ব্যাখ্যা দিতে গিয়ে বিজ্ঞানী বোর ও রাদারফোর্ড দুই যুগে দুই রকম কথা বলেন। সময়ের সঙ্গে অনেক কিছুই বদলে যায়। কাজেই নতুন তথ্য চলে এলে ফরমালিনে চুবানো পুরনো তথ্য অনেকটাই অচল হয়ে যায়। তাই সময়ের সঙ্গে লেকচার শিটগুলো সংস্কার না করলে জ্ঞানের পরিধি প্রসার হয় না। বছরের পর বছর ধরে ফরমালিনে সংরক্ষিত পচন ধরা শিটগুলো ব্যবহার করে লেকচার দিয়ে ক্লাসগুলো কোনোভাবে পার করে দেয়া যায় কিন্তু সৃজনশীলতা এবং সময়োপযোগী শিক্ষা ও তথ্য থেকে বঞ্চিত হয় শিক্ষার্থীরা। ফরমালিনে ভেজানো আম-জাম-কলা খেলে মুখে ঠিকই মিষ্টি স্বাদ পাওয়া যায়, কিন্তু তা যথাযথ পুষ্টিগুণ সরবরাহ করতে পারে না। পুরনো শিট ও লেকচার নোটও একই রকম, কোনোমতে কাজ সাড়া যায় কিন্তু শিক্ষার মূল উদ্দেশ্য সাধন হয় না। এ ধরনের ব্যবস্থায় শিক্ষক ও শিক্ষার্থীদের মাঝ থেকে হারিয়ে যায় উদ্ভাবনী ধ্যান-ধারণা। সঠিক ও যুগোপযোগী জ্ঞান অর্জন এবং বিতরণ দুটোই হয়ে যায় স্তব্ধ। পাশাপাশি একসময় ডেকে আনে সংশ্লিষ্ট শিক্ষকের জ্ঞানের দীনতা ও কর্তব্য-কর্মে অথর্বতা যেভাবে ফরমালিনের বিষাক্ত প্রভাব মানবদেহকে কুঁরে কুঁরে শেষ করে। 

অধিকন্তু ফরমালিনে চুবানো পুরনো ধাঁচের প্রশ্নপত্রও একইভাবে ক্ষতিকর। একজন শিক্ষককে সবসময় পুরো সিলেবাস পড়েই সৃজনশীল টাইপের প্রশ্নপত্র প্রণয়ন করা উচিত যাতে ছাত্রছাত্রী সিনিয়র ভাইয়া-আপুদের ফরমালিনে সংরক্ষিত হাতেগোনা পুরনো কিছু শিট বাদ দিয়ে সিলেবাস অনুসরণে মূল বইগুলো পড়তে বাধ্য হয়। প্রশ্নপত্র প্রণয়নের সময় শিক্ষকরা পুরনো প্রশ্নপত্র অনুসরণ করবেন শিক্ষার্থীদের স্বার্থে—খুবই স্বাভাবিক। তবে কয়েক বছরের সিলেক্টেড কিছু প্রশ্নপত্র অনুকরণ করলে তৈরিকৃত প্রশ্নপত্রটিও হবে ফরমালিনে চুবানো প্রশ্নপত্রের মতোই। উচ্চ শিক্ষায় পরীক্ষার হলে প্রশ্ন কমন পড়বে এমনটা ভাবার কোনোই অবকাশ নেই। বিশ্ববিদ্যালয় অঙ্গন মূলত মুক্তবুদ্ধি চর্চার চারণভূমি। শিক্ষক শ্রেণীকক্ষে এমনভাবে পড়াবেন যাতে প্রশ্ন কমন পড়ুক আর নাই পড়ুক, নিজেদের অর্জিত জ্ঞান ও সৃজনশীলতাকে কাজে লাগিয়ে শিক্ষার্থীরা প্রশ্নগুলোর সঠিক উত্তর ঠিকই প্রদান করতে পারে। এভাবেই শ্রেণীকক্ষে নতুনত্ব সংবলিত পাঠদান এবং সৃজনশীল চিন্তাভাবনাপ্রসূত প্রশ্নপত্র প্রণয়ন পদ্ধতি শিক্ষা ব্যবস্থায় আনতে পারে আমূল পরিবর্তন। অন্যথায় ফরমালিনে চুবানো বহু বছরের পুরনো লেকচার শিট এবং প্রণীত গৎবাঁধা প্রশ্নপত্র সৃজনশীলতাকে দিনে দিনে বিনাশ করে বস্তাপচা শিক্ষা ব্যতীত কিছুই জাতিকে উপহার দিতে পারবে না। কাজেই যুগোপযোগী সৃজনশীল শিক্ষা ব্যবস্থার স্বার্থেই একাডেমিক ফরমালিন দূরীকরণ অনেকটা ফরজ না হলেও ওয়াজিব হয়ে গেছে। 

ড. মো. এরশাদ হালিম: অধ্যাপক, সিনথেটিক অর্গানিক কেমিস্ট্রি অ্যান্ড কম্পোজিট ম্যাটেরিয়ালস, রসায়ন বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়

এই বিভাগের আরও খবর

আরও পড়ুন