খাদ্যনিরাপত্তা

বাংলাদেশে খাদ্যনিরাপত্তা পরিস্থিতির হালনাগাদ এবং জরুরি কিছু নীতিনির্দেশনা

মোহাম্মদ আসাদুজ্জামান

ছবি : বণিক বার্তা

বাংলাদেশে প্রথমবারের মতো বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরো (বিবিএস) কর্তৃক ‘খাদ্যনিরাপত্তা পরিবীক্ষণ এবং ফুড ইনসিকিউরিটি এক্সপেরিয়েন্স স্কেল (এফআইইএস) জরিপ ২০২৩’ পরিচালিত হয়েছে। এটি জাতীয় পর্যায়ে প্রতিনিধিত্বশীল একটি জরিপ যেখানে খাদ্যনিরাপত্তা, পুষ্টি পরিস্থিতি, আর্থসামাজিক বৈশিষ্ট্য ইত্যাদি বিষয়ে হালনাগাদ প্রামাণ্য তথ্য-উপাত্ত পেশ করা হয়েছে। আটটি প্রশাসনিক বিভাগের অন্তর্গত গ্রামীণ (রুরাল), শহুরে (আরবান) এবং সিটি করপোরেশন এলাকাগুলোয় নির্বাচিত ১ হাজার ৪৮৮টি প্রাথমিক নমুনা একক (পিএসইউ) জুড়ে মোট ২৯ হাজার ৭৬০ নমুনা বসতবাড়িতে জরিপটি পরিচালিত হয়েছে। এর মুখ্য উদ্দেশ্য, এসডিজি-২-এর শর্তানুযায়ী প্রধানত খাদ্য ও পুষ্টি খাতের তথ্য-উপাত্তের ঘাটতি পূরণ এবং সপ্তম পঞ্চবার্ষিক পরিকল্পনায় বিবৃত জাতীয় অগ্রাধিকারস্বরূপ কৃষিসংশ্লিষ্ট খাতগুলোর জন্য প্রয়োজনীয় তথ্য সরবরাহ করা।

বাংলাদেশে খাদ্যনিরাপত্তা ও পুষ্টি পরিস্থিতি সম্পর্কে ওই জরিপের প্রধান উপাদান ‘খাদ্যনিরাপত্তা পরিবীক্ষণ’ বেশকিছু চমকপ্রদ ও উদ্বেগজনক ফলাফল পেশ করেছে। জাতীয় পর্যায়ে ‘তীব্র খাদ্য অনিরাপত্তা’ ও ‘মাঝারি বা তীব্র খাদ্য অনিরাপত্তায়’ ভোগা বসতবাড়ির পরিমাণ যথাক্রমে দশমিক ৮২ ও ২১ দশমিক ৯২ শতাংশ। কিন্তু দেশের গ্রামীণ এলাকায় এর প্রভাব সর্বাধিক, যথাক্রমে দশমিক ৯২ শতাংশ বসতবাড়ি ‘তীব্র খাদ্য অনিরাপত্তা’ এবং ২৩ দশমিক ৮৯ শতাংশ বসতবাড়ি ‘মাঝারি বা তীব্র খাদ্য অনিরাপত্তায়’ ভুগছে। শহুরে এলাকা এবং সিটি করপোরেশনগুলোয় ‘মাঝারি বা তীব্র খাদ্য অনিরাপত্তায়’ ভোগা বসতবাড়ির পরিমাণ যথাক্রমে ২০ দশমিক ৫৬ এবং ১৩ দশমিক শূন্য ৬ শতাংশ, শহুরে এলাকার জন্য যা বেশ আশঙ্কাজনক। বিভাগীয় পর্যায়ে তিনটি অঞ্চলে সর্বাধিক ‘মাঝারি বা তীব্র খাদ্য অনিরাপত্তায়’ ভোগা বসতবাড়ির অস্তিত্ব পাওয়া গেছে, যেগুলো হলো রংপুরে ২৯ দশমিক ৫৩ শতাংশ, ময়মনসিংহে ২৮ দশমিক ১০ শতাংশ ও সিলেটে ২৭ দশমিক ৪২ শতাংশ। অন্যান্য বিভাগেও এর পরিমাণ ২০ শতাংশের বেশি। কেবল সর্বনিম্ন ‘মাঝারি বা তীব্র খাদ্য অনিরাপত্তা’ পীড়িত অঞ্চলগুলো হলো ঢাকা (১৭ দশমিক শূন্য ৫ শতাংশ) ও চট্টগ্রাম (১৯ দশমিক শূন্য ৪ শতাংশ)। তাছাড়া ‘তীব্র খাদ্য অনিরাপত্তা’র তালিকায়ও শীর্ষে রয়েছে সিলেট (১ দশমিক ৩৭ শতাংশ), অন্যদিকে মাঝারি পর্যায়ে তুলনামূলকভাবে ভালো হলেও এক্ষেত্রে চট্টগ্রামের অবস্থান (১ দশমিক ১১ শতাংশ) অসন্তোষজনক। 

যেসব খানার আয়ের প্রধান উৎস রেমিট্যান্স (১৮ দশমিক ৯১ শতাংশ) ও শিল্প খাত (১৯ দশমিক শূন্য ৯ শতাংশ), তারা তুলনামূলকভাবে কম ‘মাঝারি বা তীব্র খাদ্য অনিরাপত্তা’ অনুভব করেছে, অন্যথায় কৃষিজীবী খানাগুলো সর্বাধিক নিরাপত্তাহীনতার সম্মুখীন হয়েছে যার পরিমাণ ২৬ দশমিক ১৩ শতাংশ। উল্লেখযোগ্যভাবে আমরা দেখতে পাই যে, রংপুর, ময়মনসিংহ, রাজশাহী, ইত্যাদি বিভাগ, যেখানে ‘মাঝারি বা তীব্র খাদ্য অনিরাপত্তা’র হার সবচেয়ে বেশি, সেখানে রেমিট্যান্স গ্রহণের হারও অনেক কম। আর্থসামাজিক দিক বিবেচনায় কাঁচা বসতবাড়ি, খোলা জলাশয়কে পানীয় জলের উৎস হিসেবে ব্যবহার করা খানাগুলো এবং ‘দরিদ্রতম’ ও ‘দরিদ্র’ আয়ের কোয়ান্টাইলে থাকা খানাগুলো সবচেয়ে বেশি ‘মাঝারি বা তীব্র অনিরাপত্তা’ অনুভব করে। লক্ষণীয় বিষয় হলো, জাতীয় পর্যায়ে ২৫ দশমিক ৫ শতাংশ খানাকে তাদের খাদ্যের মৌলিক চাহিদা মেটাতে বিভিন্ন আনুষ্ঠানিক ও অনানুষ্ঠানিক উৎস থেকে ঋণ নিতে হয়েছে, আর গ্রামীণ এলাকায় এ ঋণ নেয়ার হার জাতীয় পর্যায়ের চেয়ে সামান্য বেশি। খাদ্যনিরাপত্তার যে সার্বিক চিত্র উল্লিখিত আলোচনায় এল, বাংলাদেশের জন্য তা মোটেই সুখকর নয়, এমনকি তুলনামূলকভাবে সবচেয়ে ভালো অবস্থানে থাকা ঢাকার (১৭ দশমিক শূন্য ৫ শতাংশ) চিত্রও নীতিনির্ধারকদের উদ্বেগের কারণ হতে পারে। তাছাড়া রেমিট্যান্সের গতি-প্রকৃতির সঙ্গেও খাদ্যনিরাপত্তার একটা কার্যত যোগসূত্র থাকার আভাস উল্লিখিত বিশ্লেষণে রয়েছে। 

বসতবাড়ি ও জনসংখ্যার বৈশিষ্ট্যগুলো লক্ষ করলে আমরা দেখি, জাতীয় পর্যায়ে খানার গড় সদস্য সংখ্যা ৪ দশমিক শূন্য ৯ জন, যা গ্রামীণ ও শহুরে এলাকায় প্রায় একই রকম হলেও সিটি করপোরেশনগুলোয় (৩ দশমিক ৮৮) বেশ কম। তবে একক পরিবারের (দু-তিনজন সদস্য) হার সিটি করপোরেশন এলাকায় সর্বাধিক, যা গ্রামীণ এলাকার তুলনায় ৫ দশমিক ৭৭ শতাংশ বেশি। প্রথাগত যৌথ ও বৃহৎ পরিবারগুলো উল্লেখযোগ্যভাবে হ্রাস (১ দশমিক ১২ শতাংশ) পেয়েছে, যা একসময়কার গ্রামীণ কৃষিপ্রধান পরিবারের অন্যতম প্রধান বৈশিষ্ট্য ছিল। জাতীয় পর্যায়ের পরিসংখ্যান থেকে এটি স্পষ্ট বলা যায় যে, একক (দু-তিনজন সদস্য) এবং মাঝারি (চার-পাঁচজন সদস্য) পরিবারগুলো বাংলাদেশে ধীরে ধীরে মূলধারায় পরিণত হচ্ছে, যথাক্রমে ৩৪ দশমিক ২৯ শতাংশ ও ৪৭ দশমিক ৫০ শতাংশ হারে।

সিটি করপোরেশন এলাকায় খানাগুলোর মালিকানায় ‘মালিক’ এবং ‘ভাড়াকৃত’ ধরনের মধ্যে বৈপরীত্য উল্লেখযোগ্য, যেখানে অধিকাংশ পরিবার ভাড়াকৃত খানায় থাকে (৭২ দশমিক শূন্য ৭ শতাংশ)। অন্যদিকে গ্রামীণ এলাকায় ৯৩ দশমিক ৮৯ শতাংশ খানা মালিকানাধীন। এ চিত্র বিদ্যমান শ্রমশক্তির কাজের প্রকৃতি, আয় সৃষ্টিকারী খাত ও তাদের ভৌগোলিক অবস্থান এবং গ্রাম থেকে শহরে অভ্যন্তরীণ অভিবাসনের সঙ্গে কার্যত যুক্ত হতে পারে, কারণ শহরেই বেশির ভাগ শিল্প এবং সেবামূলক কর্মসংস্থান অবস্থিত। খানাগুলোর আয়ের প্রধান উৎস বিবেচনা করলে এ চিত্র আরো স্পষ্ট হবে। শিল্প (১৮ দশমিক শূন্য ২ শতাংশ) ও সেবা খাতের (৭৪ দশমিক ৫৬ শতাংশ) কর্মসংস্থান ও আয় প্রধানত সিটি করপোরেশন এলাকায় কেন্দ্রীভূত হলেও গ্রামীণ এলাকায় শিল্প এবং সেবা খাত হয়ে খানার কর্মসংস্থান ও আয় যথাক্রমে মাত্র ৬ দশমিক ৩৪ শতাংশ ও ৪০ দশমিক শূন্য ৬ শতাংশ। লক্ষণীয় যে, এমনকি শহুরে এলাকায়ও শিল্প থেকে খানার আয়ের পরিমাণ মাত্র ৮ দশমিক ৩৭ শতাংশ। যার অর্থ হলো, আয় সৃষ্টিকারী খাত বিবেচনায় শিল্পের প্রসারণ কৃষি বা সেবা খাতের তুলনায় উল্লেখযোগ্যভাবে পিছিয়ে রয়েছে।

বসতবাড়িতে বিদ্যুৎ ব্যবহারের পরিসংখ্যান থেকে লক্ষণীয় বিষয় হলো, গ্রামীণ, শহুরে ও সিটি করপোরেশন এলাকায় সৌরবিদ্যুৎ ব্যবহারের পরিমাণ যথাক্রমে মাত্র ১ দশমিক ৪৩ শতাংশ, ১ দশমিক ৩৪ শতাংশ ও দশমিক ১৯ শতাংশ, যেখানে ৯৮ শতাংশ বিদ্যুৎ সরবরাহ জাতীয় গ্রিড থেকে আসে। এসব অঞ্চলে অফ গ্রিড সৌরবিদ্যুৎ ব্যবস্থার প্রসার জনপ্রিয় করা গেলে ভোক্তা পর্যায়ে আত্মনির্ভরতা বৃদ্ধি, সার্বিক জ্বালানি নিরাপত্তা উন্নতি, ক্রমবর্ধমান গ্রিড সম্প্রসারণ এবং ব্যবস্থাপনা খরচ কমানো ও লোডশেডিং সংকট প্রশমিত করা সম্ভব হতে পারে।

গত দুই দশকে বাংলাদেশ সামষ্টিক অর্থনীতির অনেক ক্ষেত্রে উল্লেখযোগ্য উন্নতি করেছে, যথা জিডিপি প্রবৃদ্ধি, স্থিতিশীল বিপিও অ্যাকাউন্ট, বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ, রফতানি আয়, কর্মসংস্থান সৃষ্টি, রেমিট্যান্স ইত্যাদি। তবু আলোচ্য খাদ্যনিরাপত্তা পরিবীক্ষণে কিছু অত্যন্ত জরুরি বহুমাত্রিক সমস্যা উন্মোচিত হয়েছে, যেগুলো দারিদ্র্য, আর্থিক বৈষম্য, অঞ্চলভিত্তিক বৈষম্য, খাতওয়ারি আয় সৃষ্টির সক্ষমতা এবং সর্বোপরি খাদ্যনিরাপত্তা, জনস্বাস্থ্য ও সামগ্রিক জীবনযাত্রার মানের সঙ্গে সম্পর্কিত। এ প্রতিবন্ধকতাগুলো কাটিয়ে উঠতে নির্দিষ্ট নীতিমালা এবং দৃঢ় বাস্তবায়ন ও তদারকি ব্যবস্থা প্রয়োজন, যা সংশ্লিষ্ট যাবতীয় মন্ত্রণালয় ও অংশীদারদের সমন্বিত প্রচেষ্টার মাধ্যমে পরিচালিত হবে। রংপুর ও ময়মনসিংহ বিভাগকে নীতিনির্ধারণী প্রক্রিয়া ও প্রণোদনায় অগ্রাধিকার দেয়া উচিত। কারণ বেশির ভাগ মানদণ্ডে তাদের শোচনীয় ফলাফল পাওয়া গেছে। জাতীয় সামাজিক নিরাপত্তা প্রোগ্রামগুলোর (এসএসএনপি) ব্যাপ্তি ও সুবিধা সর্বাধিক নাজুক জনগোষ্ঠীর কাছে অগ্রাধিকারের ভিত্তিতে প্রসারিত করা উচিত।

জরিপটি ২০২৩ সালের জুনে পরিচালিত হয়েছিল, যদি এতে খাদ্যনিরাপত্তার ওপর কভিড মহামারীর প্রভাব এবং খানাগুলোর ওপর চলমান মূল্যস্ফীতির প্রভাব এবং তাদের মোকাবেলা কৌশলের ব্যাপারে যথাযথ তথ্য সংগ্রহের মাধ্যমে আলোকপাত করা যেত, তাহলে জরিপের রিপোর্ট আরো তাৎপর্যপূর্ণ হতে পারত। উপরন্তু এতে বিভিন্ন অঞ্চলের ‘তীব্র খাদ্য অনিরাপত্তা’ ও ‘মাঝারি বা তীব্র খাদ্য অনিরাপত্তায়’ ভোগা বসতবাড়ির ওপর জাতীয় সামাজিক নিরাপত্তা প্রোগ্রামগুলোর (এসএসএনপি) আওতা ও কার্যকারিতার বর্তমান অবস্থার সঙ্গে সম্পর্কিত গুরুত্বপূর্ণ অন্তর্দৃষ্টির অভাব রয়েছে। খাদ্যনিরাপত্তা ও পুষ্টি পরিস্থিতিতে লিঙ্গ ও বয়সভিত্তিক চিত্র প্রতিফলিত করার জন্য আরো খতিয়ে দেখার প্রয়োজন আছে, যাতে জরুরি সামাজিক অন্তর্ভুক্তির মানদণ্ড বজায় রাখা যায় এবং অন্তর্ভুক্তিমূলক নীতিমালা প্রণয়ন করা যায়।

পরিশেষে বলা যায়, খাদ্যনিরাপত্তা পরিবীক্ষণ জরিপ প্রমাণভিত্তিক নীতিনির্ধারণ, প্রকল্প বাস্তবায়ন এবং সংশ্লিষ্ট খাতগুলোয় তথ্যের ব্যবধান পূরণের জন্য একটি গুরুত্বপূর্ণ পদক্ষেপ। আমরা আশা করি যে, উল্লিখিত বিদ্যমান সীমাবদ্ধতাগুলো অতিক্রম করে এ জরিপ ভবিষ্যতে নিয়মিত আমাদের আরো প্রামাণিক অন্তর্দৃষ্টি এবং নীতিনির্দেশনা প্রদান করবে।

মোহাম্মদ আসাদুজ্জামান: গবেষণা সহযোগী, সাউথ এশিয়ান নেটওয়ার্ক অন ইকোনমিক মডেলিং (সানেম)

এই বিভাগের আরও খবর

আরও পড়ুন