অর্থনীতির হালচাল

বাজার কারসাজি, দুর্নীতি ও সিন্ডিকেট অর্থনীতিকে আরো চাপে ফেলেছে

মোহাম্মদ আবদুল মজিদ

ছবি : বণিক বার্তা

তড়িঘড়ি করে জোরপূর্বক ব্যাংক একীভূতকরণের মানে ব্যাংক খাতে অব্যাহত দায়মুক্তির যে প্রয়াস-প্রচেষ্টা তা বতর্মানে বোঝার উপায় নেই। স্বেচ্ছাচারীভাবে চাপিয়ে দেয়া কয়েকটি ব্যাংক একীভূতকরণের ঘোষণা এবং এ প্রক্রিয়ায় থাকা ভালো ব্যাংকগুলোর অস্বস্তি, একীভূত হতে কোনো কোনো দুর্বল ব্যাংকের অনীহা, সব মিলিয়ে ব্যাংক খাতে শঙ্কা, অস্থিরতা ও অনিশ্চয়তা গভীরতর করেছে, যা একীভূতকরণের পুরো প্রক্রিয়াটিকে শুরুর আগেই প্রশ্নের মুখে ফেলে দিয়েছিল।

একীভূতকরণের মাধ্যমে খেলাপি ঋণে জর্জরিত দুর্বল ব্যাংকের মন্দ ঋণ ব্যবস্থাপনা এবং জবাবদিহিসংক্রান্ত বিষয়গুলোয় যে ধরনের অস্পষ্টতা তৈরি করা হয়েছে, তা মূল সমস্যাকে পাশ কাটিয়ে ঋণখেলাপি ও জালিয়াতির জন্য দায়ী মহলকে ‘দায়মুক্তি’ প্রদানের নামান্তর কিনা বিষয়টি এখনো স্পষ্ট হয়নি। 

‘গণমাধ্যমের খবর অনুযায়ী, একটি দুর্বল ব্যাংক ছাড়া কোনো ব্যাংকই নিজ উদ্যোগে একীভূত হওয়ার ব্যাপারে আগ্রহ দেখায়নি, আবার এ প্রক্রিয়ায় নাম আসা সবল ব্যাংকগুলো স্বেচ্ছায় ও সজ্ঞানে এতে যুক্ত হতে সম্মত হয়েছে, তাও নয়। অর্থাৎ পুরো প্রক্রিয়াটি প্রথম থেকেই স্বেচ্ছাচারিতার মাধ্যমে চাপিয়ে দেয়ার চেষ্টা চলছিল। দুর্বল ব্যাংকের সম্পদ ও দায়-দেনার পূর্ণাঙ্গ মূল্যায়ন ছাড়া আপাত সবল ব্যাংকের ঘাড়ে একীভূতকরণের নামে ঋণখেলাপি ও জালিয়াতির বোঝা চাপিয়ে দেয়ার যৌক্তিকতা ও ন্যায়সংগত অবস্থান পর্যালোচনার অবকাশ রয়েই যাচ্ছে। এটি যেন ক্যান্সার চিকিৎসায় প্যারাসিটামল প্রয়োগের নামান্তর না হয়ে দাঁড়ায়, একীভূতকরণের নামে একদিকে ব্যাংক খাতে খেলাপি ঋণ ও জালিয়াতির জন্য যারা দায়ী, ব্যাংক ঋণখেলাপি এবং যারা অবৈধ আর্থিক কেলেঙ্কারিতে জড়িত তাদের বিরুদ্ধে আইনগত ব্যবস্থা না নিয়ে তাদের যেমন সুরক্ষা দিয়ে খেলাপি ঋণের সংস্কৃতিকে গভীরতর করা হচ্ছে, অন্যদিকে সবল ব্যাংকগুলোর সাফল্যের পরিণামে খারাপ ব্যাংক হজম করিয়ে দেয়ার জোর প্রচেষ্টায় পুরো খাতে অস্বস্তি ও শঙ্কার নতুন বাতাবরণ ছড়িয়ে দিতে পারে বলে প্রতীয়মান হয়। 

প্রত্যাশিত ফল পেতে সংশ্লিষ্ট খাতে খ্যাতিসম্পন্ন নিরপেক্ষ বিশেষজ্ঞ মতামতের ভিত্তিতে এবং আন্তর্জাতিক মানদণ্ড ও অভিজ্ঞতার আলোকে ব্যাংক একীভূতকরণ নীতিমালায় প্রয়োজনীয় সংস্কার ও সে অনুযায়ী ব্যবস্থা গ্রহণ জরুরি।

বাংলাদেশ অর্থনীতির জন্য এ-যাবৎ একটি ইতিবাচক দিক হলো আগেও অনেক চ্যালেঞ্জ ছিল। বাংলাদেশ সেগুলো ভালোভাবে মোকাবেলা করেছে। কিন্তু বর্তমানে বাংলাদেশের অর্থনীতি বেশকিছু চ্যালেঞ্জের মধ্য দিয়ে যাচ্ছে। করোনা-পরবর্তী সময়ে ঘুরে দাঁড়ানোর যে চেষ্টা করা হয়েছিল, রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের কারণে এবং অভ্যন্তরে সুশাসনের অভাবে অনিয়ম অব্যাহত থাকায় সেটি সম্ভব হয়নি। এ কারণে বাংলাদেশের অর্থনীতি বেশ চাপে পড়ে। যেসব ক্ষেত্রে অর্থনীতির চাপ ঘনীভূত হচ্ছে, সেগুলো হলো রাজস্ব আহরণের ধীরগতি, নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যের ঊর্ধ্বগতি, ব্যাংকের তারল্য সংকট, বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ কমে যাওয়া। উচ্চ মূল্যস্ফীতি নিম্নআয়ের মানুষের ক্রয়ক্ষমতা খেয়ে ফেলছে। দেশে অনেক দিন ধরেই উচ্চ মূল্যস্ফীতি বিরাজ করছে। এ বাস্তবতায় অনেকে সঞ্চয়পত্র ভেঙে ফেলছেন; ব্যাংক থেকেও আমানত তুলে নিচ্ছেন। মূল্যস্ফীতির রাশ টানতে সুদহার বাড়ানো হয়েছে। ঋণ প্রবৃদ্ধির লক্ষ্যমাত্রা কমানো হয়েছে; স্বাভাবিকভাবে বিনিয়োগ ও কর্মসংস্থানে তার প্রভাব পড়ছে। অর্থনীতির সংগঠিত ক্ষেত্রে তার প্রভাব দেখা যাচ্ছে, যেমন শিল্প ও সেবা খাতের প্রবৃদ্ধি কমে গেছে।

বাজার কারসাজি, দুর্নীতি ও সিন্ডিকেট অর্থনীতিকে আরো চাপে ফেলেছে। অর্থনীতি এখন আন্তঃসৃষ্ট বহুবিধ চ্যালেঞ্জ মোকাবেলা করছে এবং সত্যিকার অর্থে একটি সন্ধিক্ষণে দাঁড়িয়ে আছে। একমাত্র আশা, নীতিনির্ধারকরা এটি বুঝবেন এবং স্বীকার করবেন যে, গতানুগতিক পন্থায় কাজ হবে না। কেবল নিঃস্বার্থ শক্তিশালী রাজনৈতিক নেতৃত্ব সংস্কারের কঠিন পথে যেতে পারে এবং অর্থনীতিকে উদ্ধার করতে পারে।

ঋণের ফাঁদ তৈরি হয়েছে। সাম্প্রতিক বছরগুলোয় বৈদেশিক ঋণ এবং ঋণ পরিশোধের বাধ্যবাধকতার হার বেড়েছে, যা সরকারকে অপর্যাপ্ত রাজস্ব আদায়ের মধ্যে ঋণ পরিশোধের জন্য ক্রমাগত কঠিন শর্তের নতুন ঋণ নিতে বাধ্য করছে। প্রকৃতপক্ষে পাবলিক ও পাবলিকলি গ্যারান্টিযুক্ত ঋণের দায়বদ্ধতার একটি বড় অংশ পরিশোধের জন্য ঋণ নিতে হচ্ছে। দেশী-বিদেশী ঋণ ২০২৩ সালের সেপ্টেম্বরে ১০০ বিলিয়ন ডলার অতিক্রম করেছে। বর্তমানে বিদেশী ঋণ-জিডিপি অনুপাত ২১ দশমিক ৬ শতাংশ তুলনামূলকভাবে বেশি না হলেও ঋণ পরিশোধের সক্ষমতা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। ঋণ পোর্টফোলিওর গঠন দ্রুত পরিবর্তিত হচ্ছে। রেয়াতি ঋণের অনুপাত কমছে, অন্যদিকে রেয়াতি ও বাজারভিত্তিক ঋণের অংশ বাড়ছে। ঋণের শর্তাবলিও আরো কঠোর হচ্ছে। বিশেষ করে জিডিপি, রাজস্ব আয়, রফতানি, রেমিট্যান্স ও বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভের সঙ্গে তুলনা করলে বৈদেশিক ঋণ ও ঋণ পরিশোধের দায়বদ্ধতার দ্রুত বৃদ্ধি নিয়ে যথেষ্ট উদ্বেগ সৃষ্টি হয়েছে। 

অভ্যন্তরীণ যে আয় হচ্ছে, তা সরকার পরিচালনা ও সুদের কিস্তি পরিশোধে ব্যয় হচ্ছে। আর ঋণের টাকায় বাস্তবায়ন হচ্ছে বার্ষিক উন্নয়ন কর্মসূচি (এডিপি)। মূল্যস্ফীতি ও মুদ্রা ব্যবস্থাপনায় বিশৃঙ্খলার কারণে অর্থনীতিতে চাপ তৈরি হয়েছে। রাজস্ব আহরণ কাঙ্ক্ষিত মাত্রায় হচ্ছে না। দুর্নীতি ও ব্যবস্থাপনাগত ত্রুটিতে কস্ট অব ডুইং বিজনেস বাড়ার কারণে এবং রাজস্ব আহরণ প্রত্যক্ষ করের পরিবর্তে পরোক্ষকর আহরণ অভিমুখী হওয়ায় মূল্যস্ফীতি বাড়ছে এবং অর্থনীতিতে আয়বৈষম্য বেড়েই চলেছে। 

মূলত ও মুখ্যত উচ্চ মূল্যস্ফীতি নিম্নআয়ের মানুষের ক্রয়ক্ষমতা কেড়ে নিচ্ছে। বাজার পরিস্থিতি আরো উসকে দিচ্ছে সিন্ডিকেট। ফলে অর্থনীতি অভূতপূর্ব চ্যালেঞ্জের মধ্য দিয়ে যাচ্ছে, যা কমে যাওয়ার লক্ষণ দেখা যাচ্ছে না। নীতিনির্ধারকদের প্রধান কাজ হওয়া উচিত বর্তমান অর্থনৈতিক বাস্তবতা বিবেচনায় নিয়ে সামষ্টিক অর্থনীতির স্থিতিশীলতা পুনরুদ্ধার করা। বাংলাদেশের রাজস্ব-জিডিপি অনুপাত বিশ্বের মধ্যে অন্যতম সর্বনিম্ন। এর সঙ্গে ঋণ বহনের সক্ষমতা ও ঋণ পরিশোধের সক্ষমতা উদ্বেগ তৈরি করেছে। দিন শেষে অভ্যন্তরীণ সম্পদ সংগ্রহ গুরুত্বপূর্ণ, যা অভ্যন্তরীণ ও বিদেশী উভয় ঋণ পরিশোধের জন্য বিবেচনা করতে হবে।

ব্যাংকে লেনদেন কমে যাওয়া অর্থনীতির সার্বিক অবস্থার প্রতিফলন। দেশে দুই বছরেরও বেশি সময় ধরে চলছে উচ্চ মূল্যস্ফীতি। এ সূচক ৯ শতাংশ ছাড়িয়ে গেছে। এর প্রভাব যে জনজীবনে অনুভূত হচ্ছে, তার প্রমাণ সরকারি পরিসংখ্যানেই পাওয়া যাচ্ছে। দিনকে দিন দেশে ব্যাংকিং লেনদেন কমছে। ২০২৪ সালের জানুয়ারির তুলনায় ফেব্রুয়ারিতে ব্যাংকে চেকের মাধ্যমে লেনদেন কমেছে ১২ শতাংশের বেশি। সবচেয়ে বেশি লেনদেন কমেছে ক্রেডিট কার্ডে। জানুয়ারিতে এর মাধ্যমে লেনদেন হয়েছে ২ হাজার ৯০৩ কোটি টাকা; ফেব্রুয়ারিতে এই কার্ডভিত্তিক লেনদেন নেমে আসে ১ হাজার ৮৩৪ কোটি টাকায়। অর্থাৎ লেনদেন কমেছে প্রায় ৩৭ শতাংশ; লেনদেন কমেছে ডেবিট কার্ডেও। লেনদেনের এ ঋণাত্মক চিত্র অর্থনীতির শ্লথগতির পরিচায়ক। বর্তমানে অর্থনীতির যে চালচিত্র, তার সঙ্গে ব্যাংক লেনদেন কমে যাওয়ার পরিসংখ্যান মিলে যায়।

মানুষের হাতে ব্যয় করার মতো অর্থ থাকলে সাধারণত শহর অনেক রাত পর্যন্ত জেগে থাকে। সম্প্রতি ব্লুমবার্গে প্রকাশিত এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, লন্ডনের মতো শহর একসময় সারা রাত জেগে থাকলেও এখন আর সে বাস্তবতা নেই। শহরের যেসব এলাকা নাইট লাইফের জন্য বিখ্যাত ছিল, সেসব এলাকার দোকানপাট বেশ তাড়াতাড়ি বন্ধ হয়ে যাচ্ছে। কভিডের পর থেকেই এ প্রবণতা শুরু হয়েছে। কারণ হিসেবে বলা হয়েছে, মানুষের হাতে ব্যয়যোগ্য অর্থের পরিমাণ কমে যাওয়া।

ব্লুমবার্গের সেই সংবাদের পরিপ্রেক্ষিতে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ঢাকার পরিস্থিতি নিয়েও আলোচনা শুরু হয়েছে। অনেকে বলছেন, ঢাকার যেসব এলাকা একসময় সারা রাত জেগে থাকত, যেমন মিরপুর-১০, পল্টন, নীলক্ষেত সেগুলো এখন আর সারা রাত জেগে থাকছে না। এর সঙ্গে মানুষের হাতে ব্যয়যোগ্য অর্থ কমে যাওয়ার সম্পর্ক আছে বলেই ধারণা করা যায়।

এদিকে সুদহার বৃদ্ধির সঙ্গে ডলার সংকট মোকাবেলায় এখনো আমদানি নিয়ন্ত্রণ করা হচ্ছে। মোট আমদানির প্রায় ৭৫ শতাংশ শিল্পের যন্ত্রপাতি, যন্ত্রাংশ ও মধ্যবর্তী পণ্য; সে কারণে সুদহার বাড়ানোর প্রভাব প্রবৃদ্ধিতে পড়ছে। এতে বিনিয়োগ ও নতুন কর্মসংস্থান সৃষ্টি ব্যাহত হচ্ছে; প্রভাব পড়ছে রাজস্ব আয়ে। রাজস্ব আয় কমে যাওয়ায় সরকারের ঋণ বাড়ছে, উন্নয়ন প্রকল্প ঠিকমতো বাস্তবায়ন হচ্ছে না। ২০২৩-২৪ অর্থবছরের প্রথম আট মাস জুলাই-ফেব্রুয়ারিতে বার্ষিক উন্নয়ন কর্মসূচির (এডিপি) ৩১ দশমিক ১৭ শতাংশ বাস্তবায়ন হয়েছে। অর্থবছরের আট মাস বিবেচনায় এটি গত ১০ বছরের মধ্যে এডিপির সর্বনিম্ন বাস্তবায়নের হার।

ব্যবসা-বাণিজ্যের গতি কমে যাওয়ার ফলেই রাজস্ব আয়ে নেতিবাচক প্রভাব পড়ছে। চলতি অর্থবছরের প্রথম সাত মাসে (জুলাই-জানুয়ারি) রাজস্ব আদায়ে ঘাটতি হয়েছে ১৭ হাজার ৭৫১ কোটি টাকা।

বাংলাদেশের অর্থনৈতিক উন্নয়ন প্যারাডক্স বা আপাত স্ববিরোধী বিষয় নয় এবং এ উন্নয়ন বিস্ময়করভাবে হয়নি, বরং প্রথাগতভাবেই দেশের উন্নয়ন হয়েছে। বিভিন্ন নিয়ামকের সমন্বয়ের মধ্য দিয়ে তা হয়েছে। দেশে সামষ্টিক ও ব্যক্তিগত উদ্যোগের মিলন হয়েছে। সরকার ও বাজারের মধ্যে এক ধরনের মিথোজীবিতার সম্পর্ক তৈরি হয়েছে। এটাই উন্নয়নের চালিকাশক্তি। ফলে সম্পদ বা সুশাসনের অভাব দেশের উন্নয়নের পথে বাধা হয়ে দাঁড়াতে পারেনি। এত দিন দেশের উন্নয়নের যেসব চালিকা শক্তি ছিল, সেগুলো যে চিরকাল একইভাবে থাকবে, তা নয়। অর্থনৈতিক চালিকাশক্তির বাইরে আরো কিছু বিষয় দেশের উন্নয়নে প্রভাবকের ভূমিকা পালন করে। সেটা হলো, মানুষের ব্যক্তিত্বের বিপ্লব; মানুষের মধ্যে শত প্রতিকূলতার মধ্যেও টিকে থাকা বা লড়াই করার যে প্রবণতা তৈরি হয়েছে, সেটা। এ প্রবণতার কারণে দেশের মানুষ এগিয়ে যাচ্ছে।

২০২৬ সালে বাংলাদেশের এলডিসি উত্তরণ হতে যাচ্ছে। ফলে বিশ্ব বাণিজ্যে বাংলাদেশ এতদিন যেসব সুযোগ-সুবিধা পেয়েছে, সেগুলো আর থাকবে না। বাংলাদেশকে নতুন পর্যায়ে যেতে হবে। কিন্তু এর মধ্যে দেশের উন্নয়নের জগতে অন্তর্ভুক্তিমূলক দূরদৃষ্টি থেকে বর্জনকামী দূরদৃষ্টির বড় একটি পরিবর্তন ঘটে গেছে। এখন ও ভবিষ্যতে অর্থনৈতিক এজেন্ডা রাজনৈতিক অ্যাজেন্ডায় রূপান্তরিত হচ্ছে ।

একসময় রাজনৈতিক অর্থনীতি নিয়ে অতটা উচ্চাশা ছিল না। এখন রাজনীতি নিয়ে হতাশা তৈরি হয়েছে; বরং অর্থনীতি ভালো অবস্থায় আছে। পরিবর্তনের যেমন ভালো দিক আছে, তেমনি মন্দ দিকও আছে। সেটা হলো, পরিবর্তনের জন্য মূল্য দিতে হয়।

স্বাধীনতার পর দেশের শস্য উৎপাদন বেড়েছে; উন্নতি হয়েছে গ্রামীণ যোগাযোগ ব্যবস্থার; এসেছে রেমিট্যান্স বা প্রবাসী আয়। এগুলোর সম্মিলিত ফল হচ্ছে উন্নয়ন। দেশের উদ্যোক্তা ও বাজার, নীতিনির্ধারণ ও গবেষণা, আলোচনা ও সংলাপের পৃথক পৃথক জগৎ গড়ে উঠেছে। এসবের মধ্যে সমন্বয় ছিল বলে উন্নয়ন ত্বরান্বিত হয়েছে। সরকার যে সবকিছু করে দিয়েছে, তা নয়; বরং উদ্যোক্তারাও অনেক কিছু করেছেন। দেশের যে আর্থসামাজিক উন্নয়ন হচ্ছে, এ উত্তরণ তারই প্রতিফলন। ২০১৫ সালে বাংলাদেশে নিম্নমধ্যম আয়ের দেশ হয়েছে এবং ২০২৬ সালে এলডিসি উত্তরণ হবে। কিন্তু এখন এ সমন্বয় বিনষ্ট হচ্ছে। আগে এ বিষয় যেভাবে কাজ করত, এখন সেভাবে করছে বা করবে না। 

এখন প্রশ্ন হচ্ছে, বাংলাদেশ মধ্যম আয় বা ঋণের ফাঁদে পড়ে কিনা। শ্রমঘন শিল্পের ওপর ভর করে এত দিন যে উন্নয়ন হয়েছে, সেখান থেকে পরবর্তী পর্যায়ে যেতে হবে। অর্থাৎ উচ্চ প্রযুক্তিভিত্তিক উৎপাদন ও রফতানিতে যেতে হবে। কিন্তু গত ১০ বছরে উচ্চ প্রযুক্তিতে উৎপাদিত পণ্য রফতানি ১ শতাংশের মধ্যে আটকে আছে। যদিও ভিয়েতনাম এক্ষেত্রে অনেকটা এগিয়ে গেছে। এ অবস্থায় বাংলাদেশের অর্থনীতি যেমন উঠতে পারে, তেমনি পিছলেও যেতে পরে। 

বাংলাদেশের প্রাতিষ্ঠানিক দুর্বলতার মধ্যে অপ্রাতিষ্ঠানিক খাতের বিকাশ হলেও উন্নয়নের পরবর্তী ধাপে এটি আর সেভাবে কাজ করবে কিনা এ নিয়ে সংশয় সৃষ্টি হয়েছে। অপ্রাতিষ্ঠানিক খাতের বিষয়ে এতদিন এক ধরনের রাজনৈতিক ঐকমত্য ছিল। কিন্তু এলডিসি উত্তরণের পর বাংলাদেশ কি এফডিআই নির্ভর হবে, নাকি অর্থনৈতিক অঞ্চলভিত্তিক উন্নয়ন করবে, তা নিয়ে ঐকমত্য নেই। দুর্নীতির ক্ষেত্রে দেশে এক ধরনের স্থিতিশীলতা আছে। এ চক্র ভাঙতে রাজনৈতিক সদিচ্ছা প্রয়োজন, তা না হলে সংস্কার হবে না এবং সরকারের রাজস্ব আহরণের সক্ষমতাও বাড়বে না।

দেশের উন্নয়ন নিয়ে যখন কথা বলা হয়, তখন গড় সূচক নিয়ে কথা বলা হয়। এর মধ্য দিয়ে প্রকৃত চিত্র উঠে আসে না। দেশে চরম দারিদ্র্য কমলেও বৈষম্য বাড়ছে। বিশ্বব্যাংকের মতে, দেশে যেমন অসমতার হার সবচেয়ে বেশি, তেমনি ধনীদের সঞ্চয়ের হারও অনেক বেশি। সেজন্য ধনী ও গরিবের সূচক পৃথকভাবে দেখানো দরকার। দেশের মানুষের শ্রম ব্যবহারের মধ্য দিয়েই উন্নয়ন হলেও যারা এ শ্রম দিয়েছেন, তাদেরই সবচেয়ে বেশি মূল্য দিতে হয়েছে বা হচ্ছে। শিল্প খাতের শ্রমিক ও প্রবাসী শ্রমিকরা অনেক কষ্ট করে দেশের উন্নয়নে অবদান রাখছেন। কিন্তু অনেক ক্ষেত্রেই শিল্প শ্রমিকদের প্রকৃত মজুরি কমেছে; অর্থাৎ মূল্যস্ফীতির সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণভাবে মজুরি বাড়েনি। এছাড়া যারা বিদেশ থেকে প্রবাসী আয় পাঠাচ্ছেন, তারা নানা ধরনের হয়রানি ও অধিকারহানির শিকার হচ্ছেন। 

মোহাম্মদ আবদুল মজিদ: সাবেক সচিব ও এনবিআরের সাবেক চেয়ারম্যান

এই বিভাগের আরও খবর

আরও পড়ুন