হঠাৎ শক্তিশালী সিন্ডিকেট

বাজার ব্যবস্থাপনায় সরকারের দৃঢ় পদক্ষেপ কাম্য

ছবি : বণিক বার্তা

কৃষি দেশের সবচেয়ে বড় অনানুষ্ঠানিক খাত ও গ্রামীণ অর্থনীতির মূল চালিকাশক্তি। গ্রামীণ অর্থনীতিকে টিকিয়ে রেখেছে এ খাত। বলা চলে, দেশের খাদ্যনিরাপত্তা নিশ্চিতে এ খাতের ভূমিকা অন্যতম। বিগত বছরগুলোয় ফসলের উৎপাদন বেড়েছে। তার পরও বাজার সিন্ডিকেটের কারণে পণ্যের দাম বেশির ভাগ সময় ঊর্ধ্বমুখী থাকছে। পণ্যের দাম বাড়লেও এ খাতের চালক কৃষকরা পণ্যের দাম বৃদ্ধির সুবিধা থেকে বঞ্চিত। এর মূল কারণ বাজারে অবৈধ মজুদদারি, দালাল ও মধ্যস্বত্বভোগীদের আধিপত্য। মাঠ পর্যায় থেকে বাজার পর্যন্ত প্রতিটি স্তরেই তাদের প্রভাব বিদ্যমান। কৃষকের কাছ থেকে কম দামে পণ্য কিনে বাজারে পণ্য সরবরাহে কৃত্রিম সংকট তৈরি করে বাজারকে তাদের নিয়ন্ত্রণে রাখে। এছাড়া আমদানির নিয়ন্ত্রণও গুটিকয়েক কোম্পানির কাছে। বাজার তদারকির জন্য সরকারের বিভিন্ন সংস্থা কাজ করলেও নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যের দাম নিয়ন্ত্রণ করতে পারছে না। অথচ দেশের কৃষক যেন তার উৎপাদিত পণ্যের ভালো দাম পান সেটি নিশ্চিত করা সরকারের দায়িত্ব। এর জন্য দরকার পণ্যের বাজার ব্যবস্থা উন্নত করা ও বাজার তদারকি কঠোরভাবে নিয়ন্ত্রণ করা। এক্ষেত্রে সরকারের পাশাপাশি বেসরকারি খাতও ভূমিকা রাখতে পারে। সড়কে চাঁদাবাজি, পরিবহন ব্যবস্থাপনা ও সিন্ডিকেটের বিষয়ে সরকারকে কঠোরভাবে পদক্ষেপ নিতে হবে। অবৈধ মজুদদারি, দালাল ও মধ্যস্বত্বভোগীদের প্রভাব কমাতে বাজারে সরকারকে অবাধ প্রতিযোগিতামূলক পরিবেশ তৈরি করতে হবে। 

দেশের কৃষি খাতের বিকাশ নিয়ে বাংলাদেশে উন্নয়ন গবেষণা প্রতিষ্ঠানের (বিআইডিএস) এক সেমিনারে সরকারের সাবেক এক প্রতিমন্ত্রী বলেছেন, পচনশীল পণ্য হিসেবে মৌসুম, সময় বা চাহিদার ওপর ভিত্তি করে কৃষিপণ্যের দামের ওঠানামা থাকবে। এটি এর বৈশিষ্ট্য। কৃষক থেকে ভোক্তা পর্যন্ত যদি ৫০ শতাংশ দামের পার্থক্য না থাকে তাহলে এ পণ্য লাভজনক হবে না। প্রাথমিকভাবে মন্ত্রীর কথাটি যদি যৌক্তিক ধরে নিই, সেই ব্যবধানও তো বাজারে ঠিক থাকছে না। কেননা অনুষ্ঠানে আরেক বক্তা বলেছেন, মানিকগঞ্জের ২০ টাকা কেজি মরিচ মোহাম্মদপুরের বাজারে আসতে আসতে হয়ে যায় ৮০ টাকা। সেই হিসেবে কৃষক থেকে ভোক্তা পর্যন্ত দামের পার্থক্য হচ্ছে ৩০০ শতাংশ, যা তিন গুণ বেশি। দেশে উৎপাদিত নিত্যপ্রয়োজনীয় এ পণ্যটির দামের পার্থক্য কেন অস্বাভাবিক হচ্ছে, তার কারণ সবারই জানা। সেই অনুযায়ী ব্যবস্থা নিতে হবে। 

বিশ্ব খাদ্য কর্মসূচি (ডব্লিউএফপি) ‘বাংলাদেশ বাজার তদারকি প্রতিবেদন এপ্রিল ২০২৪’ প্রকাশ করেছে গত সপ্তাহে। প্রতিবেদন অনুসারে, চলতি বছরের এপ্রিল পর্যন্ত এক বছরে খাদ্য মূল্যস্ফীতি ১৫ দশমিক ৬ শতাংশ বেড়েছে। আর মাসিক ভিত্তিতে গত এপ্রিলে এটি বেড়ে দাঁড়িয়েছে ১০ দশমিক ২২ শতাংশে। 

যখনই দেশে খাদ্যপণ্যের দাম বাড়ে তখনই সরকার খোলাবাজারে চাল-আটাসহ নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্য বিক্রির উদ্যোগ নেয়। মূলত দেশের সাধারণ বা দরিদ্র মানুষের উদ্দেশেই বিক্রি করা হয়। সাধারণ বা দরিদ্র মানুষ পাচ্ছে কিনা তা নিরপেক্ষ বা তৃতীয় কোনো প্রতিষ্ঠান দিয়ে মূল্যায়ন করা উচিত। খাদ্যের দাম বেড়ে যাওয়ার কারণে সবচেয়ে ঝুঁকিতে থাকা মানুষের কাছে খাদ্য দ্রুত ও সহজে সঠিকভাবে পৌঁছছে কিনা সে বিষয়ে তদারকি প্রয়োজন। 

আমরা মনে করি, চালের বাজার আরো কঠোর তদারকির আওতায় আনা উচিত। কারণ ভাত আমাদের প্রধান খাদ্য। এ বাজারে যেকোনো ধরনের কারসাজি অনেকটা জাতীয় নিরাপত্তার জন্যই হুমকিস্বরূপ। তাই তা প্রতিরোধ করতে হবে কঠোরভাবে। সেই সঙ্গে চালের পর্যাপ্ত মজুদও নিশ্চিত করতে হবে। বস্তুত বাজারে পণ্যমূল্য নির্ভর করে চাহিদা ও জোগানের ওপর। জোগান কমে গেলে অথবা চাহিদা বেড়ে গেলে পণ্যের দাম বাড়ে, যা চালসহ অত্যাবশ্যকীয় সব পণ্যের ক্ষেত্রেই প্রযোজ্য।

কৃষিতে উৎপাদন বেড়েছে। ভোক্তা থেকে ক্রেতা পর্যন্ত পণ্যের দামের ব্যাপক পার্থক্য হলেও এর সুফল প্রান্তিক পর্যায়ের কৃষক পাচ্ছেন না। এর বড় সুবিধাভোগী দালাল ও মধ্যস্বত্বভোগী শ্রেণী। এ শ্রেণীর প্রভাব কমিয়ে আনতে হলে প্রয়োজন বাজার ব্যবস্থাপনা সঠিকভাবে তদারকি করা। পাশাপাশি কৃষিভিত্তিক তথ্যপ্রযুক্তির উন্নয়ন ঘটানো। বড় কৃষকরা প্রযুক্তির ব্যবহার বেশি করতে পারলেও ছোট কৃষকরা তা পারছেন না। ফলে বাজার প্রতিযোগিতায় ছোট কৃষকের টিকে থাকা কঠিন হয়ে পড়ছে। ন্যায্যমূল্যপ্রাপ্তি নিশ্চিত করতে হলে প্রান্তিক পর্যায়ে কৃষকের কাছে প্রযুক্তি ও তথ্যসেবা পৌঁছে দিতে হবে। সেজন্য স্থানীয় সরকার পর্যায়ে প্রয়োজনীয় উদ্যোগ নিতে হবে। পাশাপাশি পণ্য বিপণন ব্যবস্থা উন্নত করে তার সঙ্গে প্রান্তিক কৃষককে সরাসরি যুক্ত ও ঋণপ্রাপ্তি নিশ্চিত করতে হবে। 

দেশের খাদ্যনিরাপত্তা নিশ্চিত করতে হলে সেটি কৃষির মাধ্যমেই ঘটাতে হবে। কৃষির উন্নয়নের পরিকল্পনা এমনভাবে হওয়া উচিত যার ফলে কৃষক থেকে শুরু করে ভোক্তা পর্যায় পর্যন্ত যেন সুফল পাওয়া যায়। এক্ষেত্রে অন্তর্ভুক্তিমূলক উন্নয়নকে সর্বোচ্চ গুরুত্ব দিতে হবে। কৃষিকে কীভাবে দরিদ্র কৃষক ও ভোক্তাবান্ধব করা যায়, তা গবেষণার মাধ্যমে খুঁজে বের করা দরকার। 

বাজারে পণ্যের দাম নিয়ন্ত্রণে রাখতে বাজার তদারকিতে সরকারকে আরো কঠোর হতে হবে। আর অসাধু ব্যবসায়ী, দালাল, মধ্যস্বত্বভোগী ও অবৈধ মজুদদারদের আইনের আওতায় আনতে সরকারকে ব্যবস্থা নিতে হবে। এ কাজটি করতে হলে টিভি চ্যানেলের বাইরে গিয়ে কাজ করতে হবে। তাদের বিরুদ্ধে নেতিবাচক প্রতিবেদন পেলেই তাৎক্ষণিক পদক্ষেপ গ্রহণ করতে হবে। এক্ষেত্রে কোনো স্বজনপ্রীতির আশ্রয় নেয়া যাবে না। আর সরকারিভাবে বিভিন্ন পণ্যের মজুদ বাড়াতে হবে। বাজারে পণ্যের কৃত্রিম সংকট হলেই সরকারি মজুদ থেকে বাজারে পণ্য সরবরাহ করতে হবে। ফলে সরকারের পর্যাপ্ত মজুদ থাকলে কৃত্রিম মজুদকারীরাও পণ্য মজুদ থেকে বিরত থাকতে বাধ্য হবে। 

বর্তমানে দেশে পণ্য আমদানিতে হাতে গোনা কয়েকটি কোম্পানির নিবন্ধন রয়েছে। ফলে গুটিকয়েক ব্যক্তি বা কোম্পানির হাতে পণ্য আমদানি নিয়ন্ত্রিত রয়েছে। তাদের কাছেই বাজার জিম্মি। তাদের প্রভাব কমাতে ও বাজারে পণ্যের দাম স্বাভাবিক রাখতে হলে ছোট-বড় সব ধরনের কোম্পানিকে আমদানি নিবন্ধনের আওতায় আনার উদ্যোগ নিতে হবে। আমদানিকারকের সংখ্যা বাড়িয়ে বাজারে প্রতিযোগিতা তৈরি করতে হবে। আবার কোনো ধরনের প্রভাব ও প্রতিবন্ধকতা ছাড়াই যেন ছোট-বড় সব আমদানিকারক পণ্য আমদানি ও বিপণন করতে পারে সেটিও নিশ্চিত করতে হবে। আমদানিকারকের সংখ্যা বাড়লে আমদানির পরিমাণ বাড়বে এবং বাজারে পণ্যের সরবরাহ স্বাভাবিক থাকবে। পণ্যের দামও স্বাভাবিক থাকবে বলে আশা করা যায়। বাজার তদারকির ক্ষেত্রে এসব বিষয় সরকার বিবেচনায় নিতে পারে। 

বাণিজ্য মন্ত্রণালয়, কৃষি মন্ত্রণালয়, মৎস্য ও প্রাণিসম্পদ মন্ত্রণালয়, জাতীয় ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ অধিদপ্তরকে সম্মিলিতভাবে বাজার ব্যবস্থাপনার তদারকিতে জোরালো পদক্ষেপ নিতে হবে। এক্ষেত্রে স্বজনপ্রীতি বা বিচ্ছিন্ন উদ্যোগ ফলপ্রসূ হবে না। 

এই বিভাগের আরও খবর

আরও পড়ুন