ইলেকট্রিক ভেহিকলস

ব্যাপক নীতি ছাড় দিতে চায় শিল্প মন্ত্রণালয়, অনিচ্ছুক এনবিআর

নজরুল ইসলাম

ছবি : সংগৃহীত

শিল্প মন্ত্রণালয় ২০২১ সালের সেপ্টেম্বরে অটোমোবাইল শিল্প উন্নয়ন নীতিমালা প্রণয়ন করে। এতে বলা হয়, ২০৩০ সালের মধ্যে বেশির ভাগ যানবাহন, বিশেষ করে যাত্রীবাহী গাড়ি, বাস, ট্রাক থ্রি হুইলার বিদ্যুচ্চালিত যানে রূপান্তরের পরিকল্পনা করা হচ্ছে। বিদ্যুচ্চালিত গাড়ি অ্যাসেম্বলার উৎপাদনকারীদের ১০ বছরের জন্য কর অবকাশ সুবিধা দেয়া হবে। পাশাপাশি উৎপাদন বাড়িয়ে বায়ুদূষণের পরিমাণকে ন্যূনতম পর্যায়ে রাখার জন্য বিভিন্ন ধরনের আর্থিক প্রণোদনা দেবে সরকার। এছাড়া বিদ্যুচ্চালিত গাড়ির জন্য চার্জিং স্টেশন ব্যাটারি রিসাইক্লিং শিল্প চালু করা হবে। তবে বৈদ্যুতিক গাড়ি (ইভি) যেহেতু চার্জ দেয়া লিথিয়াম ব্যাটারিতে চলে, তাই এর ডিসপোজালের ব্যবস্থা না করে শুল্ক ছাড়ে অনিচ্ছুক এনবিআর।

সরকারের নীতিমালা প্রণয়ণের পরপরই দেশে লিথিয়াম ব্যাটারি উৎপাদনের ঘোষণা দেয় বাংলাদেশ লিথিয়াম ব্যাটারি লিমিটেড নামের একটি প্রতিষ্ঠান।

তারা চট্টগ্রামের মিরসরাইয়ে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব শিল্পনগরে একটি উৎপাদন কেন্দ্র স্থাপন করে। প্রকল্পে বিনিয়োগের পরিমাণ ৬০০ কোটি টাকা। কেন্দ্রটির বার্ষিক সক্ষমতা হবে গিগাওয়াট ঘণ্টা। অর্থাৎ এখানে বৈদ্যুতিক গাড়ি এবং আইপিএস ইউপিএস সিস্টেমের মতো শক্তি সঞ্চয়ী ব্যবস্থাগুলোর (এনার্জি স্টোরেজ অ্যাপ্লিকেশন) জন্য উচ্চমানের ব্যাটারি তৈরি করা যাবে।

তবে এনবিআরের শুল্ক নীতি বিভাগের একজন কর্মকর্তা বণিক বার্তাকে বলেন, ‘লিথিয়াম ব্যাটারির ডিসপোজালের ব্যবস্থা না নেয়া পর্যন্ত কোনো সিদ্ধান্ত দেয়া যাচ্ছে না। ব্যাটারি ডিসপোজাল নীতিমালা যদি না হয়, আমাদের নদী-নালা, খাল-বিল ধ্বংস হবে, দূষণ বাড়বে। তাছাড়া ইভি থেকে মুখ ফিরিয়ে নিচ্ছে উন্নত বিশ্ব। তাই আলোচনা হওয়া উচিত কীভাবে লিথিয়াম ব্যাটারি ডিসপোজাল বা রিসাইকেল করা হবে, সেই বিষয়ে। তারপর শুল্ক ছাড়ের প্রশ্ন। এছাড়া লিথিয়াম ব্যাটারি ভূমির উর্বরতা কতটুকু নষ্ট করে, সেই বিষয়েও কোনো গবেষণা নেই।

এখনই নীতিসহায়তা দিতে এনবিআরের অনিচ্ছা প্রসঙ্গে শিল্প মন্ত্রণালয়ের সিনিয়র সচিব জাকিয়া সুলতানা বণিক বার্তাকে বলেন, ‘এটা একেবারেই ক্রসকার্টিং ইস্যু। একটার সঙ্গে আরেকটার ইন্টার লিংক। এনবিআরের কথাও অমূলক নয়। নীতিমালাটা দেয়া হয়, পলিসি সাপোর্ট দেয়া হয়, যেন এগুলো করতে পারে। করতে গিয়ে যে বাধাগুলো হয়, কারণে এগুলোকে বলা হয় লিভিং ডকুমেন্ট। যখন যেটা আসে, সেটা অ্যাড্রেস করা হয়। আমাদের পলিসি অব্যাহত আছে। কেউ যদি করতে চান সেখানে কোনো বাধা নেই। 

২০২৪ সালের প্রথম প্রান্তিকে উৎপাদনে যাওয়ার ঘোষণা দিয়ে এখন ধীরগতির কারণ সম্পর্কে বাংলাদেশ লিথিয়াম ব্যাটারি লিমিটেডের এমডি মীর মাসুদ কবির বণিক বার্তাকে বলেন, ‘এনবিআর এখনো বিষয়ে কোনো ঘোষণা দেয়নি। এতে বন্দরে এসে মাল আটকে পড়ে থাকবে। বেজা কর্তৃপক্ষও পানি, বিদ্যুৎ গ্যাস সরবরাহে প্রস্তুত নয়। গ্যাস পাইপলাইন এখনো আসেনি। তারপরও আমরা আগামী সেপ্টেম্বরে উৎপাদনে যেতে চাই। ডলার সংকটও ছিল। আমরা আমদানি পর্যায়ে কাঁচামালের ওপর শুল্ক ছাড়ও চেয়েছি।

লিথিয়াম ব্যাটারির সব কাঁচামাল আমদানি করতে হবে জানিয়ে পরিবেশ দূষণের বিষয়ে মীর মাসুদ কবির বণিক বার্তাকে বলেন, ‘লিথিয়াম ব্যাটারির লাইফ সাইকেল ১০-৩০ বছর পর্যন্ত, মাল্টিপল কেমিস্ট্রিসম্পন্ন। তিন থেকে সাত হাজার বার চার্জ দেয়া যায়। প্রতিদিন চার্জ দিলে ১০ বছর চলে। কম চার্জ দিলে ১৫-২০ বছর চলে। তারপর ওই ব্যাটারিটাই স্টোরেজে ব্যবহৃত হয়। এটার লাইফসাইকেল প্রায় ৩০-৪০ বছর। তারপর ডিসপোজিংয়ের কথা আসে।

তিনি দাবি করেন, ব্যবহৃত লিথিয়াম আয়রন ফসফেট ব্যাটারির উপাদান পরিবেশের জন্য ক্ষতিকারক নয়। এতে মাটিরও কোনো ক্ষতি হয় না। বরং পরিবহন খাতে খরচ কমবে ৯০ শতাংশ। জ্বালানি তেল আমদানি কমবে কর্মসংস্থান বাড়বে।

উদ্যোক্তা আরো বলেন, ‘দেশীয় কারখানায় ইভি উৎপাদনের জন্য কাঁচামাল করশূন্য আমদানির সুযোগ দেয়া হলে জনগণ সবচেয়ে কম দামে ইভি পাবে। রেজিস্ট্রেশন অগ্রিম কর (এআইটি) মওকুফ করলে জনগণ ইভি ব্যবহারে উৎসাহিত হবে।

বাংলাদেশে আইপিএস ইউপিএসে সাধারণত লেড-অ্যাসিড ব্যাটারি ব্যবহৃত হয়। সেই জায়গাটা নিতে চায় লিথিয়াম। থ্রি হুইলার যানবাহনগুলোও লেড-অ্যাসিড ব্যাটারিতে চলে। এসব ব্যাটারি বদলে লিথিয়াম ব্যাটারি ব্যবহার করা যাবে। বুয়েটের ইলেকট্রিক্যাল অ্যান্ড ইলেকট্রনিক ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগের অধ্যাপক . মো. জিয়াউর রহমান খান বণিক বার্তাকে বলেন, ‘লেড অ্যাসিড ব্যাটারির চেয়ে লিথিয়াম ব্যাটারিতে হেভি মেটাল কম থাকে। তাই এটা পরিবেশের জন্য ততটা ক্ষতিকর নয়। তবে ব্যাটারির ডিসপোজাল ব্যবস্থা আমাদের দেশে নেই, ভারতে রয়েছে। আমরা অনেক দিন থেকে বলছি এটার ব্যবস্থা করার জন্য।

সৌর বায়ুর মতো উৎসগুলো থেকে নবায়নযোগ্য শক্তি সঞ্চয় করার জন্য গ্রিড এনার্জি স্টোরেজের মতো বড় আকারের এনার্জি মজুদ ব্যবস্থায় লিথিয়াম ব্যাটারি ব্যবহৃত হয়। সিস্টেমগুলো বিদ্যুৎ সরবরাহ চাহিদার ভারসাম্য বজায় রাখতে, বৈদ্যুতিক গ্রিডগুলোকে স্থিতিশীল করতে এবং বিদ্যুৎ বিভ্রাটের সময় ব্যাকআপ সরবরাহ করতে সহায়তা করে।

শিল্প মন্ত্রণালয়ের উপসচিব (বিএসইসি) সঞ্জয় কুমার ঘোষ বণিক বার্তাকে বলেনএটার জন্য ট্রিটমেন্ট, স্টোরেজ অ্যান্ড ডিসপোজাল ফ্যাসিলিটিজ (টিএসডিএফ) করা হবে। জাইকার অর্থায়নে প্রথমে চট্টগ্রামে এটি স্থাপন করা হবে। সেখানে শিপ রিসাইক্লিং শিল্প-কারখানার বর্জ্য রিসাইক্লিং করা হবে। তবে এখনো জায়গা নির্ধারণ করা হয়নি।

ওজনে হালকা এবং শক্তির ঘনত্ব বেশি হওয়ায় মহাকাশযান, স্যাটেলাইট বিমানে লিথিয়াম ব্যাটারি ব্যবহার করা হয়। যোগাযোগ, নেভিগেশন জরুরি সরঞ্জামসহ গুরুত্বপূর্ণ সিস্টেমগুলোকে শক্তি জোগায় ব্যাটারি। পেসমেকার, ডিফিব্রিলেটর, ইনসুলিন পাম্প বহনযোগ্য চিকিৎসা সরঞ্জামাদির মতো মেডিকেল ডিভাইসগুলোয়ও এটি ব্যবহৃত হয়।

এই বিভাগের আরও খবর

আরও পড়ুন