ক্রেডিট রেটিং ‘ট্রিপল এ’

‘ডাচ্‌-বাংলার অফশোর ব্যাংকিং হবে স্বতন্ত্র মানের’

ছবি : বণিক বার্তা

বিশ্বব্যাপী দ্রুত জনপ্রিয় হয়ে উঠছে অফশোর ব্যাংকিং। ডলার সংস্থানের বিকল্প ব্যবস্থা হিসেবে বিশেষ এ ব্যাংকিং সেবায় মনোযোগ বাড়িয়েছে বাংলাদেশও। প্রবাসী ও বিদেশীরা এখন সহজেই দেশের ব্যাংকগুলোয় বৈদেশিক মুদ্রায় হিসাব খোলার সুযোগ পাচ্ছেন। অফশোর ব্যাংকিং নিয়ে বণিক বার্তার কাছে নিজেদের পরিকল্পনা তুলে ধরেছেন ডাচ্-বাংলা ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক (এমডি) ও প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা (সিইও) আবুল কাশেম মো. শিরিন

অফশোর ব্যাংকিং অ্যাকাউন্ট নিয়ে আপনারা কী ধরনের প্রডাক্ট চালু করেছেন? 

ডাচ্‌-বাংলা ব্যাংক একটি বহুল প্রচলিত ও জনপ্রিয় ব্যাংক। আমাদের গ্রাহক সংখ্যা প্রায় ৫ কোটি ৩০ লাখ। প্রতি বছরই বিভিন্ন সেক্টরে আমাদের গ্রোথ লক্ষণীয়। বাংলাদেশ ব্যাংকের নির্দেশিত পদ্ধতি অনুসরণ করে আমরা অফশোর ব্যাংকিং কার্যক্রম পরিচালনা করছি। প্রবাসী বাংলাদেশী ও বিদেশীদের জন্য বিভিন্ন বৈদেশিক মুদ্রায় প্রধানত দুই ধরনের অর্থাৎ চলতি অ্যাকাউন্ট ও বিভিন্ন মেয়াদের ফিক্সড ডিপোজিট অ্যাকাউন্ট চালু করেছি। চলতি অ্যাকাউন্টের মধ্যে রয়েছে ফরেন কারেন্সি ও ইন্টারন্যাশনাল ব্যাংকিং (আইবি)। আর বিভিন্ন মেয়াদের ফিক্সড ডিপোজিট অ্যাকাউন্টের মধ্যে রয়েছে তিন মাস, ছয়, ১২, ২৪, ৩৬, ৪৮ ও ৬০ মাসভিত্তিক। অফশোর ব্যাংকিংয়ের ফিক্সড ডিপোজিট অ্যাকাউন্টে আমরা সর্বোচ্চ ৮ দশমিক ৪০ শতাংশ পর্যন্ত মুনাফা দিই। তাছাড়া ফিক্সড ডিপোজিট অ্যাকাউন্ট বিভিন্ন কারেন্সি যেমন—মার্কিন ডলার, কানাডিয়ান ডলার, অস্ট্রেলিয়ান ডলার, ব্রিটিশ পাউন্ড, ইউরো ইত্যাদিতে খোলা যায়। 

এখন পর্যন্ত প্রবাসীদের সাড়া কেমন পেলেন? 

প্রবাসীদের কাছ থেকে আমরা ব্যাপক সাড়া পেয়েছি। স্বল্প সময়ের মধ্যেই আমাদের ব্যাংকে ১০০ জনের অধিক গ্রাহক অফশোর ব্যাংকিং ফরেন কারেন্সি অ্যাকাউন্ট খুলেছেন। সে অ্যাকাউন্টগুলোয় এখন পর্যন্ত প্রায় ১ মিলিয়ন ডলার আমানত জমা হয়েছে এবং প্রতিদিনই আমাদের গ্রাহক সংখ্যা বাড়ছে। মূলত যুক্তরাষ্ট্র, কানাডা, অস্ট্রেলিয়া, সিঙ্গাপুর, আরব আমিরাতসহ মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলো থেকেই আমরা বেশি সাড়া পাচ্ছি।

কোনো বিদেশী নাগরিক এখন পর্যন্ত ডাচ্‌-বাংলা ব্যাংকে অফশোর ব্যাংকিং হিসাব চালু করেছে?

এখন পর্যন্ত কোনো বিদেশী নাগরিক অফশোর ব্যাংকিং হিসাব চালু করেনি। তবে কয়েকটি অ্যাকাউন্ট প্রক্রিয়াধীন আছে। অনেকেই আমাদের সঙ্গে যোগাযোগ করছেন, খোঁজখবর নিচ্ছেন। আশা করছি বিদেশীরাও অ্যাকাউন্ট খুলেবেন। 

গ্রাহক কেন ডাচ্‌-বাংলা ব্যাংকে আরএফসিডি কিংবা অফশোর ব্যাংকিং অ্যাকাউন্ট খুলবেন?

বাংলাদেশের ব্যাংকিং জগতে ডাচ্-বাংলা ব্যাংক একটি বিশ্বস্ত ও নির্ভরযোগ্য নাম। তিন বছর ধরে দেশের ক্রেডিট রেটিং এজেন্সি সিআরএবির ‘এএএ’ রেটিং পেয়ে আসছে। তাছাড়া দেশের হাতেগোনা কয়েকটি ব্যাংক আন্তর্জাতিক কোম্পানি দিয়ে রেটিং করিয়েছে, ডাচ্-বাংলা ব্যাংক এর মধ্যে অন্যতম। আন্তর্জাতিক ক্রেডিট রেটিং কোম্পানি মুডি’স-এর ‘বি২’ ও এসঅ্যান্ডপি গ্লোবালের ‘বি’ রেটিংপ্রাপ্ত একটি ব্যাংক ডাচ্-বাংলা। উভয় রেটিং কোম্পানিই আমাদের ব্যাংকের আউটলুক স্টেবল হিসেবে বর্ণিত করেছে। 

ডাচ্-বাংলা ব্যাংকের ২০২৩ সালের নেট প্রফিট (সলো) ছিল ৮০১ কোটি টাকা, যা বাংলাদেশের প্রাইভেট ব্যাংকগুলোর মধ্যে সর্বোচ্চ। একই বছর ৩৫ শতাংশ ডিভিডেন্ড দিয়েছে আমাদের ব্যাংক, যা ছিল ব্যাংকগুলোর মধ্যে সর্বোচ্চ। 

ডাচ্-বাংলা ব্যাংকের ক্যাপিটাল অ্যাডিকোয়েসি রেশিও ১৬ দশমিক ১৬ শতাংশ, যেখানে ব্যাসেল-থ্রি অনুযায়ী এর প্রয়োজন ১২ দশমিক ৫০ শতাংশ। অর্থাৎ ব্যাংকটির ক্যাপিটাল খুবই শক্তিশালী। তাছাড়া ২০২৩ সাল শেষে আমাদের ব্যাংকের এনপিএল ছিল ৪ দশমিক ১৪ শতাংশ, যেখানে গড় এনপিএল ৯ শতাংশের কিছু বেশি। সে হিসেবে ডাচ্-বাংলার অ্যাসেট কোয়ালিটিও অনেক ভালো। এসএলআর বা সিআরআর ঘাটতি ও প্রভিশন ঘাটতি নেই। বিগত ডলার সংকটকালীন এলসি পেমেন্টে ডাচ্-বাংলা ব্যাংক কখনো ডিফল্ট করেনি। অর্থাৎ ব্যাংকটি যথাসময়ে সব এলসির পেমেন্ট করতে সক্ষম হয়েছে। ডাচ্-বাংলা ব্যাংকের লিকুইডিটি খুবই ভালো। তাই ব্যাংকটি কখনো লিকুইডিটি ক্রাইসিসে পড়েনি। এ লিকুইডিটির ৯০ শতাংশই লো-কস্ট ডিপোজিট দিয়ে গঠিত। এটি প্রমাণ করে যে ডাচ্-বাংলা ব্যাংকের প্রতি সাধারণ মানুষের ব্যাপক আস্থা রয়েছে। 

একটি টেক-স্যাভি ব্যাংক ডাচ্-বাংলা। আমাদের রয়েছে সাত হাজার এটিএম বা সিআরএম, যা সারা দেশে অর্ধেকেরও বেশি। তাছাড়া ব্যাংকটির রয়েছে দেড় কোটি ডেবিট কার্ড ও সাড়ে তিন লাখ ক্রেডিট কার্ড। আমাদের আরো রয়েছে নেক্সাসপে নামে একটি জনপ্রিয় মোবাইল অ্যাপ, যা যেকোনো দেশ থেকে ব্যবহার করা যায়। আর্থিক অন্তর্ভুক্তির জন্য ডাচ্-বাংলা ব্যাংকের রয়েছে রকেট নামে একটি এমএফএস এবং ফিঙ্গার প্রিন্টের মাধ্যমে পরিচালিত এজেন্ট ব্যাংকিং সিস্টেম, যা গ্রামাঞ্চলে বিপুল জনপ্রিয়তা অর্জন করেছে। ব্যাংকটির কার্ড, আইটি সিস্টেম ও ডেটা সেন্টার পিসিআই-ডিএসএস, আইএসও/আইইসি ২৭০০১:২০১৩ ও টিয়ার-৪ সার্টিফিকেট প্রাপ্ত। তাছাড়া রয়েছে দুটি অ্যাক্টিভ-অ্যাক্টিভ ডাটা সেন্টার।

আমাদের ব্যাংক সিএসআর খাতে এ পর্যন্ত ১ হাজার ৮২ কোটি টাকা ব্যয় করেছে। ডাচ্-বাংলা ব্যাংক দুবার ডিএইচএল-ডেইলি স্টার বেস্ট ফাইন্যান্সিয়াল ইনস্টিটিউট অ্যাওয়ার্ড পেয়েছে, যা ব্যাংক কোম্পানির ক্ষেত্রে বিরল। একই সঙ্গে পরপর চারবার এশিয়ান ডেভেলপমেন্ট ব্যাংক থেকে টিএফপি অ্যাওয়ার্ড পেয়েছে। আইসিটি মিনিস্ট্রি ও বেসিসের বেস্ট ডিজিটাল ব্যাংক অ্যাওয়ার্ড অর্জন করেছে। পরপর পাঁচবার বাংলাদেশ ব্যাংকের রেমিট্যান্স অ্যাওয়ার্ড পেয়েছে ডাচ্-বাংলা ব্যাংক।

অফশোর ব্যাংকিং অ্যাকাউন্ট জনপ্রিয় করে তুলতে কোন ধরনের পরিকল্পনা নিয়ে এগোচ্ছেন আপনারা?

প্রবাসীদের কাছে অফশোর ব্যাংকিং অ্যাকাউন্ট জনপ্রিয় করে তোলার জন্য আমরা বিভিন্ন পদক্ষেপ নিয়েছি। অ্যাকাউন্ট খোলার প্রক্রিয়াটি খুবই সহজ করেছি, যাতে গ্রাহক আমাদের ওয়েবসাইটে ঢুকে নিজেই অ্যাকাউন্ট খুলতে পারেন। তাছাড়া আমরা বিভিন্ন দেশী-বিদেশী মিডিয়ার (ইলেকট্রনিক, প্রিন্ট ও সোশ্যাল) মাধ্যমে অফশোর ব্যাংকিংয়ের সুবিধাসংবলিত বিজ্ঞাপন ব্যাপকভাবে প্রচার করছি। অফশোর ব্যাংকিংয়ের ওপর একটি বুকলেটও তৈরি করে আমাদের সব শাখা-উপশাখা ও এজেন্ট ব্যাংকিং আউলেটে সম্ভাব্য গ্রাহকদের মধ্যে বিতরণ করছি। পাশাপাশি গ্রাহকের যেকোনো সাপোর্টের জন্য একটি হটলাইন সেবা সার্ভিস চালু করেছি, যেখানে গ্রাহক যেকোনো সময় (রাত-দিন ২৪ ঘণ্টা সপ্তাহে সাতদিন) যোগাযোগ করতে পারেন। আমাদের অফশোর ব্যাংকিং টিম সার্বক্ষণিক তাদের সেবায় নিয়োজিত।

অফশোর ব্যাংকিং প্রডাক্টের মাধ্যমে আমরা প্রাথমিকভাবে ৩০ মিলিয়ন ডলার সংগ্রহের লক্ষ্য নির্ধারণ করে এগোচ্ছি। এজন্য কিছু এক্সক্লুসিভ অফার চালু করেছি। যেমন ১ লাখ মার্কিন ডলার, কানাডিয়ান ডলার, অস্ট্রেলিয়ান ডলার, ব্রিটিশ পাউন্ড, ইউরো বা তার চেয়ে বেশি পরিমাণের ফিক্সড ডিপোজিট করলে একটি প্রায়োরিটি পাসসহ ভিসা বা মাস্টারকার্ড ব্র্যান্ডের ইন্টারন্যাশনাল ডেবিট কার্ড দেয়া হয়। এ কার্ডধারীরা প্রতিবার বিদেশ ভ্রমণকালে চারজনের জন্য বিশ্বের বিভিন্ন আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর ও ঢাকা আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরের বলাকা লাউঞ্জ সম্পূর্ণ ফ্রিতে ব্যবহার করতে পারবেন। সেই সঙ্গে থাকছে ডাচ্-বাংলা ব্যাংকের নির্ধারিত শাখায় ভিআইপি লাউঞ্জ সুবিধা; ঢাকা আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে ফ্রি এয়ারপোর্ট পিক অ্যান্ড ড্রপ ও মিট অ্যান্ড গ্রিটের সুবিধা; স্কয়ার, ইউনাইটেড ও এভারকেয়ার হাসপাতালে বছরে একবার ফ্রি স্বাস্থ্য পরীক্ষা; এফসি অ্যাকাউন্ট থেকে ইন্টারন্যাশনাল ডেবিট কার্ডের মাধ্যমে বিশ্বের যেকোনো জায়গায় ক্যাশ ওঠানোর সুবিধা (অফশোর ব্যাংকিং ফিক্সড ডিপোজিট অ্যাকাউন্ট থেকে ক্যাশ উত্তোলন করতে হলে তা রিডেম্পশন করে এফসি অ্যাকাউন্টে নিয়ে উত্তোলন করতে হবে)।

এনআরবিরা কীভাবে ডাচ্‌-বাংলা ব্যাংকে অফশোর ব্যাংকিং অ্যাকাউন্ট খুলবেন?

অফশোর ব্যাংকিং ফিক্সড ডিপোজিট করতে হলে বৈদেশিক মুদ্রা পাঠানোর জন্য প্রথমেই একটি ফরেন কারেন্সি (এফসি) অ্যাকাউন্ট খুলতে হবে। বিশ্বের যেকোনো স্থান থেকে www.dutchbanglabank.com/offshorebanking ভিজিট করে এফসি অ্যাকাউন্ট খোলা যায়। এ অ্যাকাউন্ট খোলার পর ব্যাংক থেকে গ্রাহকের কাছে ই-মেইলে ইন্টারনেট ব্যাংকিং আইডি ও পাসওয়ার্ড পাঠানো হয়। তারপর গ্রাহককে তার বিদেশের অ্যাকাউন্ট থেকে ডাচ্‌-বাংলা ব্যাংকের এফসি অ্যাকাউন্টে সুইফটের মাধ্যমে ফান্ড ট্রান্সফার করতে হবে। সবশেষে ইন্টারনেট ব্যাংকিংয়ের মাধ্যমে www.dutchbanglabank.com/offshorebanking ভিজিট করে গ্রাহক নিজেই ফিক্সড ডিপোজিট অ্যাকাউন্ট খুলতে পারবেন। প্রয়োজনে মেয়াদ পূর্তির আগেই গ্রাহক ফিক্সড ডিপোজিট অ্যাকাউন্ট ভাঙিয়ে মুনাফাসহ ফান্ড ফেরত নিতে পারবেন। মেয়াদ পূর্তির পর অটো রিনিউয়ালের সুবিধা নিতে পারবেন।

আরএফসিডি হিসাবকে জনপ্রিয় করতে কী ধরনের উদ্যোগ নেয়া হয়েছে?

নিবাসী বাংলাদেশীরা ডাচ্‌-বাংলা ব্যাংকের যেকোনো অথরাইজড ডিলার (এডি) শাখা থেকে আরএফসিডি অ্যাকাউন্ড খুলতে পারবেন। আমাদের ব্যাংক দীর্ঘদিন ধরে আরএফসিডি অ্যাকাউন্ট সেবা দিয়ে আসছে। বর্তমানে বিপুলসংখ্যক নিবাসী বাংলাদেশী এ অ্যাকাউন্ট খুলেছেন, যার বর্তমান স্থিতি কয়েক মিলিয়ন ডলার। 

আরএফসিডি হিসাবকে জনপ্রিয় করার জন্য আমরা দেশের আপামর জনসাধারণকে এ বিষয়ে বিস্তারিত ধারণা দিয়ে যাচ্ছি। আরএফসিডি হিসাব কী; কারা, কীভাবে এ হিসাব খুলতে পারেন তা বিস্তারিতভাবে বিভিন্ন প্রিন্ট মিডিয়া ও সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে অবহিত করছি।

এই বিভাগের আরও খবর

আরও পড়ুন