বিশ্ব অর্থনীতি

কেন্দ্রীয় ব্যাংক আসলেই স্বাধীন নাকি তা কেবলই এক মিথ

রবার্ট স্কিডেলস্কি

ছবি : বণিক বার্তা

ব্যাংক অব ইংল্যান্ড (বিওই) গত ৪০ বছরের মধ্যে সবচেয়ে ভয়াবহ মূল্যস্ফীতির পূর্বাভাস দিতে ব্যর্থ হয়েছে। এর কারণ অনুসন্ধান করতে গিয়ে হাউজ অব লর্ডস ইকোনমিক অ্যাফেয়ার্স কমিটি মোটাদাগে একটি বিষয় পেয়েছেন—যুক্তরাজ্যের আর্থিক নীতি অনিয়ন্ত্রিত ও ভঙ্গুর। পাশাপাশি সাম্প্রতিক এক প্রতিবেদনে এই কমিটি বিওইর অভ্যন্তরীণ নীতি ও পূর্বাভাসের মডেলগুলোর সমালোচনা এবং ২০২৫ সালের মধ্যে মূল্যস্ফীতি ২ শতাংশে নামিয়ে আনার লক্ষ্যমাত্রা পূরণের সক্ষমতা নিয়ে সন্দেহ প্রকাশ করে। 

২০২২ সালের অক্টোবরে যুক্তরাজ্যের বার্ষিক মূল্যস্ফীতি পৌঁছেছিল ১১ দশমিক ১ শতাংশে, যা গত চার দশকে সর্বোচ্চ। এর ফলে গত তিন বছরে সামগ্রিক মূল্যস্ফীতি বেড়ে দাঁড়ায় ২২ শতাংশে। হাউজ অব লর্ডস ওই প্রতিবেদনে উল্লেখ করে, কর্তৃপক্ষের মধ্যে বিরাজমান গোষ্ঠীচিন্তা, ক্রমান্বয়ে নেয়া দুর্বল নীতি (যা এখন জলবায়ু পরির্বতনের মতো বিষয়কে বিবেচনায় রাখে) ও পূর্বাভাস টুলসগুলোর জন্য বিওইর ভুলগুলোর জন্য দায়ী। বিওই তার কর্মক্ষমতা পর্যালোচনা, বিশেষ করে অকার্যকর নীতিগুলো পর্যালোচনার জন্য সাবেক মার্কিন ফেডারেল রিজার্ভের চেয়ার বেন বার্নানকে নিযুক্ত করে। কমিটি কেন্দ্রীয় ব্যাংকারদের ‘‌আমলাতান্ত্রিক ক্ষমতা’ সম্পর্কেও যুক্তিসংগত উদ্বেগ উত্থাপন করেন। 

১৯৯৭ সালে তৎকালীন অর্থমন্ত্রী গর্ডন ব্রাউন যুক্তরাজ্যের বার্ষিক মূল্যস্ফীতির লক্ষ্যমাত্রা ২ দশমিক ৫ শতাংশ (পরে ২ শতাংশ কমেছিল) নির্ধারণ করেছিলেন। এ লক্ষ্যমাত্রা অর্জনে তিনি বিওইকে দিয়েছিলেন পরিচালনার স্বাধীনতা। ওই সময় থেকেই ব্যাংকটি আর্থিক নীতির ওপর আরো বেশি নিয়ন্ত্রণ নেয় এবং ২০০৮-০৯ সালের বৈশ্বিক অর্থনৈতিক সংকটের মুখেও যুক্তরাজ্যের অর্থনীতি পরিমাণগত সহজীকরণ কর্মসূচির মাধ্যমে ৮৭৫ বিলিয়ন ডলারে (১ দশমিক ১ ট্রিলিয়ন) পরিণত হয়। ইকোনমিক অ্যাফেয়ার্স কমিটি চেয়ার জর্জ ব্রিজের পর্যবেক্ষণমতে, সরকারের কাছ থেকে কেন্দ্রীয় ব্যাংকারদের কাছে সামষ্টিক অর্থনীতির নীতি গ্রহণের ক্ষমতা হস্তান্তর করাই উন্নত অর্থনীতিতে একটি আদর্শ অনুশীলন হয়ে দাঁড়িয়েছে। এটি নির্বাচিত প্রতিনিধিদের কাছ থেকে অনির্বাচিত কর্মকর্তাদের কাছে বিপুল ক্ষমতা হস্তান্তরের প্রতিনিধিত্ব করে। 

যেহেতু সুদের হার কেবল অর্থের মানকে নয় বেকারত্ব, প্রবৃদ্ধি ও বিতরণকেও প্রভাবিত করে, তাই বলা যেতে পারে যে রাজস্বনীতির মতো মুদ্রানীতিও ভোটারদের কাছে দায়বদ্ধ সরকারের মাধ্যমেই পরিচালিত হওয়া উচিত। তথাপি বিওইর কর্মক্ষমতার সমালোচনা সত্ত্বেও প্রতিবেদনে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের স্বাধীনতার নীতি নিয়ে কোনো প্রশ্ন উত্থাপন করা হয়নি। বরং আর্থিক নীতির ক্ষেত্রে সরকারের জবাবদিহিতার সঙ্গে রাজনৈতিক চাপমুক্ত সুদের হার নির্ধারণে ব্যাংকের স্বাধীনতাকে সমান্তরালে আনার উপায়গুলোয় মনোনিবেশ করে।

কেন্দ্রীয় ব্যাংকের স্বাধীনতা যে সুরক্ষিত, সে ধারণাটি ১৯৭০-এর দশকে মিল্টন ফ্রিডম্যানের মুদ্রাবাদী পাল্টা বিপ্লব থেকে পাওয়া যায়। যা কেইন্সিয়ান সামাজিক গণতন্ত্রের আধিপত্যের অবসান ঘটায়। 

ফ্রিডম্যান যুক্তি দিয়েছিলেন যে, বাজার অর্থনীতি"বেকারত্বের স্বাভাবিক হারে ‘‌বিপরীতভাবে স্থিতিশীল’। তবে শর্ত থাকে যে বাজারের অংশগ্রহণকারীরা পরিবর্তনশীল মুদ্রাস্ফীতির হার দ্বারা প্রতারিত হয় না। এ যুক্তি মূল্যের স্থিতিশীলতা বজায় রাখার জন্য সামষ্টিক অর্থনৈতিক নীতির পরিধিকে কার্যকরভাবে সংকুচিত করে।

যেহেতু রাজস্ব নীতির মতো আর্থিক নীতিও অর্থনৈতিক কার্যকলাপকে খুব সহজে প্রভাবিত করে। তাই মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণের দায়িত্ব স্বাধীন কেন্দ্রীয় ব্যাংককে দেয়া হয়। কেন্দ্রীয় ব্যাংককে রাজনৈতিক হস্তক্ষেপ থেকে মুক্ত রাখতে হবে এবং নিয়মানুসারে পরিচালনা করতে হবে। রাজনীতিবিদদের অর্থ সরবরাহে কারসাজি করা থেকে বিরত রাখবে। 

ব্যাংকার এবং অর্থনৈতিক-নীতিবিদরা ফ্রিডম্যানের মুদ্রাবাদী ‘গসপেল’কে দ্রুত গ্রহণ করেছিলেন। ১৯৮৪ সালের এক বক্তৃতায় তৎকালীন অর্থমন্ত্রী নাইজেল লসন আগের কেইন্সিয়ান গোঁড়া মনোভাবকে বাস্তববুদ্ধিতে পরিণত করেছিলেন। তিনি জোর দিয়ে বলেন, সামষ্টিক অর্থনৈতিক নীতির উদ্দেশ্য হওয়া উচিত মূল্যস্ফীতিকে জয় করা, তবে প্রবৃদ্ধি ও কর্মসংস্থান অনুসৃত হওয়া উচিত নয়। বিপরীতে ব্যষ্টিক আর্থিক নীতিতে মূল্যস্ফীতিকে চাপে রাখার পরিবর্তে প্রবৃদ্ধি ও কর্মসংস্থানের অনুকূল পরিবেশ সৃষ্টির দিকে গুরুত্ব দেয়া উচিত। 

লসনের বক্তৃতা প্রাক-কেইন্সিয়ান অর্থনীতির ‘ধ্রুপদী দ্বি-বিভাজন’-এর প্রত্যাবর্তনকে উপস্থাপন করেছিল। এটি মূলত প্রকৃত পরিবর্তনশীল (কর্মসংস্থান) এবং নামমাত্র পরিবর্তনশীলকে (যেমন মূল্যস্তর) পৃথক হিসেবে বিবেচনা করে। এ দৃষ্টিভঙ্গি অনুসারে, সরবরাহ দিকের সংস্কারগুলো অর্থনৈতিক গতিশীলতা বৃদ্ধি করবে এবং সুদহার নীতি দামের স্থিতিশীলতা বজায় রাখবে। 

সামষ্টিক অর্থনৈতিক রেকর্ড একটি মিশ্র গল্প বলে। যুদ্ধোত্তর যুগকে দুটি স্বতন্ত্র যুগে ভাগ করা যেতে পারে: কেইন্সিয়ান গোল্ডেন এজ (১৯৪৭-৭৩) এবং মনিটারিজম’স গ্রেট মডারেশন (১৯৯৭-৭৩)। মধ্যবর্তী বছরগুলো বাদ দিয়ে কেইন্সিয়ান যুগে যুক্তরাজ্যের মূল্যস্ফীতি ছিল গড়ে ৪ দশমিক ৫ শতাংশ এবং গড় বেকারত্ব ছিল ২ দশমিক ১ শতাংশ। কেন্দ্রীয় ব্যাংকের ব্যবস্থাপনার অধীনে মূল্যস্ফীতির হার ছিল গড়ে ২ শতাংশের ওপরে এবং গড় বেকারত্ব ছিল ৫ দশমিক ৬ শতাংশ। এ দুই সময়কালে প্রবৃদ্ধির হার ছিল যথাক্রমে ২ দশমিক ৮ শতাংশ ও ২ শতাংশ। 

অন্য কথায়, দুই শাসন ব্যবস্থার অধীনে সামষ্টিক অর্থনৈতিক ফলাফল ছিল সম্পূর্ণ ভিন্ন। অধিকন্তু মাইজারলি সূচক (বেকারত্ব হার ও মূল্যস্ফীতির হার) কেইন্সিয়ান যুগে ছিল ৬ দশমিক ৬ শতাংশ এবং স্বাধীন কেন্দ্রীয় ব্যাংকের যুগে ছিল ৭ দশমিক ৮ শতাংশ। 

নিশ্চিতভাবে বলা যায়, এ উন্নয়নগুলো নীতি বা বাহ্যিক ঘটনার ফল ছিল কিনা তা নির্ধারণ করা অসম্ভব। ১৯৬৮ সালের প্রথম দিকে অর্থনীতিবিদ আরসিও ম্যাথিওস প্রশ্ন তোলেন, কেইন্সিয়ান স্বর্ণযুগের পূর্ণ কর্মসংস্থানের জন্য সরকারি নীতি বা ধর্মনিরপেক্ষ যুদ্ধোত্তর উত্থানকে দায়ী করা উচিত কিনা? এটিও বলা যায় যে, গ্রেট মডারেশনের নিম্ন মূল্যস্ফীতির সঙ্গে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের নীতির কম সম্পর্ক ছিল। যেখানে বিশ্ব শ্রমবাজারে এশিয়া থেকে কোটি কোটি নিম্ন আয়ের শ্রমিক প্রবেশ করেছিলেন। 

কিন্তু যেহেতু আর্থিক নীতি অর্থনৈতিক কর্মদক্ষতাকে উল্লেখযোগ্যভাবে প্রভাবিত করে, তাই এ কথা বলা কঠিন যে রাজস্ব ও মুদ্রানীতিকে পৃথক রাখা উচিত। কেন্দ্রীয় ব্যাংকগুলো বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলোকে যে হারে ঋণ দেয় তার মাধ্যমে অর্থ সরবরাহ নিয়ন্ত্রণ করে। এটি দীর্ঘমেয়াদি সুদহার কাঠামোকে নির্ধারণ করে এবং যে হারে ঋণগ্রহীতারা ঋণ নিতে পারেন, যা পক্ষান্তরে বিনিয়োগ এবং বেকারত্বকে প্রভাবিত করে।

সাধারণভাবে সরকার যেহেতু বিনিয়োগ ও বেকারত্বের জন্য দায়ী, তাই তাকেই আর্থিক নীতি নিয়ন্ত্রণ করতে হবে। তাছাড়া যখন কেন্দ্রীয় ব্যাংকগুলো স্বাধীনতা বজায় রাখতে কঠোর চেষ্টা করে, সত্য এই যে সরকার যেভাবে চায় বাস্তবে সেই স্বাধীনতাই তারা পায়। যদিও অনুমান করা অসম্ভব যে সামষ্টিক অর্থনৈতিক কাঠামো বর্তমানের অস্থিতিশীলতা থেকেই উদ্ভূত হবে, তবুও বলা যায় এ কাঠামো ফ্রিডম্যানাইট আদর্শের সঙ্গে খুব বেশি সাদৃশ্যপূর্ণ হবে না। 

[স্বত্ব: প্রজেক্ট সিন্ডিকেট]

রবার্ট স্কিডেলস্কি: ব্রিটিশ হাউজ অব লর্ডসের সদস্য ও ওয়ারউইক বিশ্ববিদ্যালয়ের রাজনৈতিক অর্থনীতির ইমেরিটাস অধ্যাপক 

ভাষান্তর: দিদারুল হক

এই বিভাগের আরও খবর

আরও পড়ুন