মাধ্যমিক শিক্ষা

ইংরেজি-গণিতে সক্ষমতা বাড়াতে আধুনিক শিক্ষাক্রম ও দক্ষ শিক্ষক প্রয়োজন

ছবি : বণিক বার্তা

বাংলাদেশের টেকসই উন্নয়ন নিশ্চিত করতে অবকাঠামো উন্নয়নের পাশাপাশি শিক্ষার মানোন্নয়নে বিশেষ গুরুত্ব দেয়া প্রয়োজন। দেশটি ২০২৬ সালে চূড়ান্তভাবে উন্নয়নশীল দেশে উন্নীত হবে। দেশের জন্য চ্যালেঞ্জ ও সম্ভাবনা দুটোই নিয়ে আসছে। আসন্ন চ্যালেঞ্জ মোকাবেলায় ও সম্ভাবনাকে কাজে লাগাতে প্রয়োজন দক্ষ মানবসম্পদ। এছাড়া স্মার্ট বাংলাদেশ ভিশন-২০৪১ প্রতিষ্ঠা ও উন্নত বাংলাদেশ বিনির্মাণে স্মার্ট বাংলাদেশ রোডম্যাপ প্রস্তুত করেছে সরকার। সরকারের এ লক্ষ্য সুষ্ঠুভাবে বাস্তবায়নে শিক্ষার গুণগত মানোন্নয়নের বিকল্প নেই। এজন্য সরকারের গৃহীত বিভিন্ন কর্মসূচি সঠিকভাবে বাস্তবায়নে দক্ষ মানবসম্পদ গঠন অপরিহার্য। দক্ষ মানবসম্পদ গঠনে ইংরেজি ও গণিতকে বেশি গুরুত্ব দিতে হবে। দেশের প্রাথমিক ও মাধ্যমিক স্তরেই ইংরেজি ও গণিতে স্নাতক ও স্নাতকোত্তর ডিগ্রিধারী দক্ষ শিক্ষক নিয়োগ নিশ্চিত করতে হবে। ইংরেজি ও গণিতে মেধাবী শিক্ষক আকর্ষণে প্রয়োজনীয় বরাদ্দ বাড়াতে সরকারকে পদক্ষেপ নিতে হবে। প্রয়োজনে শিক্ষা ব্যবস্থাকে ঢেলে সাজাতে হবে। কেননা দেশের শিক্ষা ব্যবস্থার ভিত্তিই হচ্ছে প্রাথমিক ও মাধ্যমিক স্তর। ভিত্তি যত মজবুত হবে কাঠামো তত শক্তিশালী হবে। তখন কাঠামো যেকোনো ভার বহনে সক্ষম হবে। 

যেহেতু আমাদের মাতৃভাষা বাংলা তাই বাংলা ভাষায় পাঠ্যবই পড়তে তেমন অসুবিধা হয় না। কিন্তু ইংরেজি যেহেতু আমাদের মাতৃভাষা নয় এবং গণিত একটি জটিল বিষয় তাই এ দুটো বিষয়ের প্রতি অভিভাবক ও শিক্ষার্থীদের সবসময় ভীতি কাজ করে। এছাড়া এ দুটো বিষয়েই মাধ্যমিকে দক্ষ শিক্ষকের অভাব রয়েছে। যার কারণে বরাবরই এ দুই বিষয়েই শিক্ষার্থীরা পিছিয়ে পড়ছে। ইংরেজি ও গণিতে দক্ষতা অর্জন করতে না পারায় উচ্চশিক্ষা, চাকরি প্রতিযোগিতা ও ব্যবসা-বাণিজ্যে পিছিয়ে পড়ছে। শিক্ষার সামগ্রিক মানোন্নয়নে ও দক্ষ মানবসম্পদ গঠনে এ দুটো বিষয়ে পিছয়ে পড়ার কারণ অনুসন্ধান করতে হবে। সেই অনুসারে প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ নেয়া সরকারেরই দায়িত্ব, যেহেতু শিক্ষা সাংবিধানিকভাবে মৌলিক অধিকার। 

দেশের প্রাথমিক ও মাধ্যমিক স্তরে ইংরেজি পাঠ্যবইটি ইংরেজি ভাষায়ই শিক্ষার্থীদের দেয়া হয়। ইংরেজি যেহেতু আমাদের মাতৃভাষা নয়, তাই বুঝতে কঠিন হওয়ায় এবং দক্ষ শিক্ষকের অভাবে শিক্ষার্থীদের অনেকেই ইংরেজি পড়ার প্রতি আগ্রহ হারিয়ে ফেলে। ফলে শিক্ষার্থীদের মনে ইংরেজি নিয়ে এক ধরনের ভীতি কাজ করে। ইংরেজিকে সহজপাঠ্য করতে ইংরেজি পাঠ্যবইয়ে ইংরেজির পাশাপাশি তার বাংলা অর্থও সংযোজন করা যেতে পারে। তখন শিক্ষার্থীরা ইংরেজি সহজে বুঝতে ও লিখতে পারবে। ইংরেজি পড়ার প্রতি আগ্রহ বাড়বে। মাধ্যমিক পর্যায়ের বিদ্যালয়গুলোয় ইংরেজিতে দক্ষ এবং স্নাতক ও স্নাতকোত্তর ডিগ্রিধারীদের শিক্ষক হিসেবে নিয়োগ দেয়ার ব্যবস্থা করতে হবে। 

এছাড়া গণিত একটি জটিল বিষয়। গণিতে স্নাতক ও স্নাতকোত্তর ডিগ্রিধারী দক্ষ শিক্ষকের অভাব রয়েছে। ফলে শিক্ষার্থী ও অভিভাবকরা বিষয়টি নিয়েও উৎকণ্ঠায় থাকেন। পরীক্ষায় পাস করার জন্য অধিকাংশ শিক্ষার্থীই না বুঝে গণিতকে মুখস্থ করে ও বাজারে প্রচলিত বিভিন্ন গাইড বইয়ের আশ্রয় নেয়। পরীক্ষা শেষে গণিতের সঙ্গে শিক্ষার্থীদের আর সম্পর্ক থাকে না। ফলে তারা গণিতে অদক্ষই থেকে যায়। এভাবে কোনো শিক্ষার্থী পরীক্ষায় পাস করলেও উচ্চ শিক্ষা শেষে তারা বিভিন্ন প্রতিযোগিতামূলক পরীক্ষায় পিছিয়ে পড়ছে। যার কারণে অনেকেই আশানুরূপ চাকরি পাচ্ছে না। অনেকে নিম্ন বেতনের চাকরি করতে বাধ্য হচ্ছেন। 

বণিক বার্তার প্রতিবেদন অনুসারে, দেশের মাধ্যমিক বিদ্যালয়ের ইংরেজি ও গণিত শিক্ষকদের প্রায় ৮৫ শতাংশেরই সংশ্লিষ্ট বিষয়ে স্নাতক বা স্নাতকোত্তর ডিগ্রি নেই। তাহলে আমরা কীভাবে আশা করতে পারি যে মাধ্যমিক একটি শিক্ষার্থী ইংরেজি বা গণিতে ভালো করবে? ইংরেজি ও গণিত দুটো বিষয়ই কঠিন। সেসব বিষয়ে ডিগ্রিধারী অভিজ্ঞ শিক্ষকও নেই। ফলে এ দুই বিষয়ে শিক্ষার্থীরা দুর্বল থাকছে। এর নেতিবাচক প্রভাব পড়ছে উচ্চ শিক্ষা বা চাকরির প্রতিযোগিতায়, যা অত্যন্ত দুঃখজনক। 

আর্থিক ও সামাজিক মর্যাদার বিষয় বিবেচনা করে ইংরেজিতে স্নাতক-স্নাতকোত্তর ডিগ্রিধারী মেধাবী শিক্ষার্থীদের বড় অংশই বর্তমানে শিক্ষকতায় আগ্রহী নন। আর যারা শিক্ষকতায় আসছেন তাদের বেশির ভাগই অন্য কোথাও সুযোগ না পেয়ে আসছেন। বিশেষ করে মফস্বল শহরের বেসরকারি বিদ্যালয়গুলোয় এ সংকট অনেক বেশি।

অনেক সময় দেখা যাচ্ছে, সংশ্লিষ্ট বিষয়ে অনার্স-মাস্টার্স ডিগ্রিধারীরাও ভালো পড়াতে পারছেন না। এর কারণ হলো যারা সবচেয়ে মেধাবী তারা শিক্ষকতায় আসেন না। মাধ্যমিকে ইংরেজি-গণিতে দক্ষ শিক্ষক নিয়োগের পাশাপাশি তাদের আর্থিক ও সামাজিক মান-মর্যাদার বিষয়টি নির্ধারণে উদ্যোগ নিতে হবে সরকারকে। 

বর্তমানে আমরা জাতিসংঘের টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রা (এসডিজি) অর্জনের চ্যালেঞ্জ মোকাবেলার পর্যায়ে রয়েছি। এসডিজি-৪-এ মানসম্মত শিক্ষার ওপর গুরুত্ব দেয়া হয়েছে। মানসম্মত শিক্ষার জন্য অনেকগুলো টুলস রয়েছে, যা বাস্তবায়নের জন্য একান্ত প্রয়োজন একটি সুশৃঙ্খল ও গতিশীল প্রশাসনিক ব্যবস্থাপনা পদ্ধতি, যা আজও দৃশ্যমান নয়। শিক্ষা নিয়ে অনেক আলোচনা-সমালোচনা হয়েছে, শিক্ষা কমিশন গঠিত হয়েছে, যুগান্তকারী শিক্ষানীতি পাস হয়েছে, অনেক শিক্ষানুরাগী তাদের সুচিন্তিত মতামত ব্যক্ত করেছেন। তার পরও আমরা সনাতন শিক্ষা ব্যবস্থাপনা থেকে বের হতে পারিনি। সামাজিক ও আর্থিক বিবেচনায় শিক্ষা পেশায় মেধাবীদের মনোযোগ আকর্ষণ করতে পারিনি। 

ইংরেজি ও গণিতে মানসম্মত শিক্ষক নিশ্চিত করতে হলে অবশ্যই সংশ্লিষ্ট বিষয়ে ডিগ্রিধারী দক্ষ শিক্ষক নিশ্চিত করতে হবে। এ খাতে সরকারের বরাদ্দ বাড়াতে হবে। যেভাবে দেশের শিক্ষা কার্যক্রম চলছে তাতে শিক্ষার্থীদের উচ্চ মাধ্যমিক পাস করেও সঠিকভাবে ইংরেজি বাক্য গঠনে হিমশিম খেতে হচ্ছে। কারণ শিক্ষার্থীরা ইংরেজিতে দক্ষ হয়ে উঠতে পারছে না। বর্তমানে যে কারিকুলাম সেই কারিকুলাম অনুযায়ী পাঠদানে সংশ্লিষ্ট বিষয়ে শুধু ডিগ্রি থাকলেই হবে না, পাঠদানেও প্রশিক্ষণ থাকা জরুরি। তাই এসব বিষয়ে সরকারের ভাবা দরকার। শুধু নতুন নতুন পদ্ধতি চালু করলেই হবে না। এর পাশাপাশি প্রশিক্ষণের মাধ্যমে শিক্ষকেরও দক্ষতা নিশ্চিত করতে হবে। এর পরই তা প্রয়োগ করতে হবে। অন্যথায় শিক্ষার্থীরা সঠিক শিক্ষা থেকে বঞ্চিত হবে। 

বর্তমানে সমাজে শিক্ষকদের বেতন ও সুযোগ-সুবিধা সবচেয়ে কম। তারা সামাজিক মর্যাদার ক্ষেত্রেও পিছিয়ে। এ পেশার সুযোগ-সুবিধাও প্রতিনিয়ত কমছে। এ খাতের সংকট দূর করতে হলে সরকারকে চিত্র পাল্টাতে উদ্যোগ নিতে হবে। মেধাবীদের এ পেশায় আকৃষ্ট করতে বেতন ও সুযোগ-সুবিধা বাড়াতে হবে। শিক্ষকতা পেশায় মেধাবীরা এলেই মানসম্মত শিক্ষা নিশ্চিত হবে। শিক্ষার্থীদের মধ্যে ইংরেজি-গণিতকে সহজপাঠ্য করতে সরকারের সঠিক পরিকল্পনা ও বরাদ্দ বাড়াতে হবে। বিষয়ভিত্তিক স্নাতক ও স্নাতকোত্তর দক্ষ শিক্ষক নিয়োগ নিশ্চিত করতে হবে।

এই বিভাগের আরও খবর

আরও পড়ুন