বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে পিএইচডি

তিন মাসের মধ্যেই আসছে বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে পিএইচডি চালুর নীতিমালা

ফিচার প্রতিবেদক

ছবি : বণিক বার্তা

দেশের উচ্চশিক্ষার চাহিদা পূরণে তিন দশক আগে চালু হয় বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়। লক্ষ্য ছিল বেসরকারি পর্যায়ে মানসম্মত উচ্চশিক্ষা সম্প্রসারণ। অপূর্ণতা থাকলেও যে লক্ষ্য নিয়ে বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের যাত্রা তার অনেকটাই ছুঁতে পেরেছে প্রথম সারির বেশকিছু বিশ্ববিদ্যালয়। আন্তর্জাতিক র‌্যাঙ্কিংয়ে দ্রুতই জায়গা করে নেয় উচ্চশিক্ষা খাতের এ শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলো। বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষা ও গবেষণার মান আন্তর্জাতিক স্ট্যান্ডার্ড ধরে রাখায় দ্রুত জনপ্রিয় হয়ে ওঠে শিক্ষার্থী ও অভিভাবকদের কাছে। তবে এ তিন দশকেরও বেশি সময়ে এসব বিশ্ববিদ্যালয়ে শুধু স্নাতক ও স্নাতকোত্তর ডিগ্রি দেয়ার অনুমতি থাকলেও পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের মতো পিএইচডি (ডক্টরেট অব ফিলোসফি) ও মাস্টার অব ফিলোসফি (এমফিল) ডিগ্রি দেয়ার অনুমতি দেয়নি বিশ্ববিদ্যালয়ের সর্বোচ্চ তদারক সংস্থা বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরী কমিশন (ইউজিসি)। বিভিন্ন সময়ে বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্যরা বিভিন্ন ফোরামে পিএইচডি চালুর অনুমতি দেয়ার দাবি জানিয়ে এলেও আমলে নেয়নি ইউজিসি। পক্ষে বিপক্ষে নানা সংলাপের পর অবশেষে দেশের বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়েও পিএইচডি ও এমফিল ডিগ্রি চালুর ব্যাপারে নীতিগত সিদ্ধান্ত নিয়েছে ইউজিসি। নীতিমালা প্রণয়ন করতে সম্প্রতি ছয় সদস্যের কমিটি গঠন করা হয়েছে। 

ইউজিসি সূত্রে জানা গেছে, আগামী দুই-তিন মাসের মধ্যেই বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে পি‌এইচডি চালুর খসড়া নীতিমালা তৈরি হবে। একাধিক বিশেষজ্ঞ প্যানেল গঠনের মাধ্যমে তৈরি হবে এ নীতিমালা। ইউজিসির বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় বিভাগের দায়িত্বপ্রাপ্ত সদস্য অধ্যাপক বিশ্বজিৎ চন্দকে নীতিমালা প্রণয়ন কমিটির আহ্বায়ক করা হয়েছে। কমিটির অন্য সদস্যরা হলেন ইউজিসি সদস্য অধ্যাপক হাসিনা খান, নর্থ সাউথ বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক ডিন ও বর্তমানে উত্তরা ইউনিভার্সিটির সহ-উপাচার্য অধ্যাপক গৌর গোবিন্দ গোস্বামী, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের ইনস্টিটিউট অব বাংলাদেশ স্টাডিজের (আইবিএস) সাবেক পরিচালক ও গ্রিন ইউনিভার্সিটির কলা অনুষদের ডিন অধ্যাপক মো. শহীদুল্লাহ, ইউজিসির পরিচালক (বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়) ওমর ফারুখ।

যা বলছেন উপাচার্যরা

বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে পিএইচডি চালু হলে উচ্চশিক্ষা খাতে ঠিক কেমন প্রভাব ফেলবে জানতে চাইলে ইউনাইটেড ইন্টারন্যাশনাল ইউনিভার্সিটির (ইউআইইউ) উপাচার্য অধ্যাপক ড. মো. আবুল কাশেম মিয়া বলেন, ‘আমরা অনেক দিন ধরে এর অপেক্ষায় ছিলাম। আরো আগেই দরকার ছিল। বিশ্ববিদ্যালয়ের সবচেয়ে বড় সংকট হলো যোগ্য শিক্ষকের অভাব। বিদেশে যারা পিএইচডি করতে যায় তাদের অনেকেই ওই পরিবেশ ও সমাজে অভ্যস্ত হয়ে গেলে, নিজেরা চাইলেও পারিবারিক বা অন্যান্য কারণে দেশে ফেরে না। এতে ভালো শিক্ষার্থীরা বিদেশে চলে যাচ্ছে, দেশে ফিরছে খুব কম। মানসম্মত পিএইচডি যদি আমরা চালু করতে পারি এ সংকট কেটে যাবে। গত কয়েক বছর ধরে পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের চেয়েও অনেক বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় ভালো করছে। 

আমরা যদি গুণগত পিএইচডি দিতে পারি, তাহলে যোগ্য শিক্ষক সংকটও কমে আসবে। শুধু পিএইচডি চালু করলেই হবে না এর মান ধরে রাখতে সরকার, ইউজিসি ও বিশ্ববিদ্যালয় সবাইকেই শক্ত অবস্থানে থাকতে হবে।’ 

ড্যাফোডিল ইন্টারন্যাশনাল ইউনিভার্সিটির উপাচার্য অধ্যাপক ড. এম লুৎফর রহমান বলেন, ‘পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয় যেদিন চালু হয়, সেদিনই পিএইচডি চালু করতে পারে। বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে পিএইচডি চালু হতে যাচ্ছে, এতে আমরা আনন্দিত। তবে নীতিমালা তৈরি হলে সব বিশ্ববিদ্যালয় হয়তো পারবে না। যারা নীতিমালা অনুযায়ী যোগ্য, শুধু তারাই হয়তো পারবে। তবে যত দ্রুত নীতিমালাটি হবে ততই ভালো। কয়েকটি ইউনিভার্সিটি এখন ম্যাচিউর্ড অবস্থায় আছে, তারা পিএইচডি চালুর সক্ষমতা রাখে। পৃথিবীর বহু দেশ আছে, যেদিন বিশ্ববিদ্যালয় অনুমোদন হয় তখন থেকেই পিএইচডি করাতে পারে। যেমন ভারতেও আছে, আমাদের পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়েও আছে। বেসরকারিতে এ বিষয়ে আস্থার সংকট থাকায় নীতিমালা হচ্ছে। এটি সুষ্ঠুভাবে হওয়া উচিত, যাতে সবাই হুমড়ি খেয়ে না পড়ে। যাদের সামর্থ্য আছে, সব সুযোগ-সুবিধা আছে, শুধু তারাই যেন অনুমোদন পায়।’ 

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের (ঢাবি) ব্যবসায় প্রশাসন ইনস্টিটিউটের (আইবিএ) নবনিযুক্ত পরিচালক, নর্দান ইউনিভার্সিটি বাংলাদেশের ট্রাস্টি বোর্ডের চেয়ারম্যান ও নর্দান ইউনিভার্সিটি অব বিজনেস অ্যান্ড টেকনোলজি খুলনার সাবেক উপাচার্য অধ্যাপক ড. আবু ইউসুফ মো. আবদুল্লাহ বলেন, ‘বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় দেশের অর্থনীতি এবং চাকরির বাজারে গ্র্যাজুয়েটরা গুরুত্বপূর্ণ অবদান রাখছে। বিশ্ব রÅvংকিংয়ে জায়গা করে নিয়েছে বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়। রাষ্ট্রের অর্থে পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয় করছে, কিন্তু সেখানে ১০ জন ফুল ব্রাইট প্রফেসর নেই। পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয় হওয়ার কারণেই সেখানে পিএইচডি ডিগ্রি দেয়ার সক্ষমতা আছে, কিন্তু ব্র্যাক ইউনিভার্সিটি ও নর্থ সাউথ ইউনিভার্সিটিতে ২০০-২৫০ জনের মতো পিএইচডিধারী আছেন। বিশ্বের স্বনামধন্য বিশ্ববিদ্যালয় থেকে গবেষকরা আসেন। এটা চিন্তা করলেই খারাপ লাগে যে এসব বিশ্ববিদ্যালয় পিএইচডি দিতে পারছে না। পিএইচডি দিতে না পারার কারণে দেশ পিছিয়ে যাচ্ছে। গবেষণার কাজ হচ্ছে না। এটি একটি আমলাতান্ত্রিক জটিলতা। যুগ যুগ ধরে আমরা ভোগান্তির শিকার হচ্ছি। কিছু ক্রাইটেরিয়া ঠিক করে দিলেই হয়। এ নিয়ে আমাদের এত কথা বলতে হয় দেখে খারাপ লাগছে। আমার কাছে মনে হয় এটি বৈষম্য। এতে দেশ, জাতির ক্ষতি হয়। অনেক আগেই বিষয়টি সমাধান হওয়া উচিত ছিল।’ 

ইউনিভার্সিটি অব এশিয়া প্যাসিফিকের (ইউএপি) উপাচার্য অধ্যাপক কামরুল আহসান বলেন, ‘ইউজিসির উদ্যোগকে সাধুবাদ জানাই। বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের জন্য এটি একটি মাইলফলক হবে। শিক্ষকরা যদি গবেষণা না করেন, তাহলে নতুন জ্ঞান কীভাবে সৃষ্টি হবে। জ্ঞানের বিকাশ হলে পাঠ্যবিষয় ও লার্নিং প্রক্রিয়ায় বড় ভূমিকা পালন করে। গবেষণার সুযোগ তৈরি হলে শিক্ষার্থীদের মধ্যে যাদের গবেষণা করার প্রবণতা আছে, তাদের জন্য আমরা ক্ষেত্র তৈরি করে দিতে পারি। পিএইচডি শুধু ওয়ান ওয়ে রুট না যে শুধু শিক্ষক ও শিক্ষার্থীর মধ্যেই সীমাবদ্ধ থাকে। জার্নাল প্রকাশনার মাধ্যমে একটি বিশ্ববিদ্যালয় পরিচিতি লাভ করে যে ওমুক বিশ্ববিদ্যালয়ে এ ধরনের গবেষণা হচ্ছে। বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় পিএইচডি গবেষণার সুযোগ পেলে বাংলাদেশে গবেষণার মান ও কাঠামোগত বিষয়টি আরো শক্তিশালী হবে। পিএইচডি পর্যায়ে গবেষণা শুরু হলে আমরা বিদেশী সহায়তাও পাব, কারণ সবারই একটি ইন্টারন্যাশনাল অ্যাডভাইজরি কাউন্সিল রয়েছে এবং এর সদস্যরা বিদেশী এমন বিশ্ববিদ্যালয়ের সঙ্গে জড়িত যেখানে গবেষণা একটি মূল প্রতিপাদ্য বিষয়। আমাদের রিসার্চ কালচার বলতে গেলে নতুন, তাই তারা এটাকে আরো শক্তিশালী করবে। এটিও নতুন সম্ভাবনা তৈরি করছে। শুধু মৌলিক গবেষণা না প্রায়োগিক গবেষণার সুযোগ পেলে ইন্ডাস্ট্রি ও একাডেমির কোলাবরেশন আরো বাড়বে।’

এই বিভাগের আরও খবর

আরও পড়ুন