সাক্ষাৎকার

বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ে মানবিক, ব্যবসায় শিক্ষা বিষয়গুলো না থাকা শ্রেয়

ছবি : বণিক বার্তা

অধ্যাপক ড. মো. আনোয়ার হোসেন। বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি ক্ষেত্রে বিশেষ অবদানের জন্য পেয়েছেন একুশে পদক। ক্ষুরারোগ, আর্সেনিক বায়োরিমিডেশন ও অ্যান্টিবায়োটিক রেজিস্ট্যান্স গবেষণায় গুরুত্বপূর্ণ অবদান রেখেছেন তিনি। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অণুজীববিজ্ঞান বিভাগের এ অধ্যাপক বর্তমানে যশোর বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ে উপাচার্যের দায়িত্ব পালন করছেন। দেশের বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের নানা দিক নিয়ে কথা বলেছেন বণিক বার্তার সঙ্গে

বিশেষায়িত বিষয়ে দক্ষ স্নাতক তৈরির চিন্তা থেকেই দেশে বিজ্ঞান প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা করা হয়েছিল। সেই প্রচেষ্টা কি সফল হয়েছে?

প্রচেষ্টা যে একেবারে সফল হয়নি সেটা বলব না, তবে লক্ষ্য অর্জন হয়নি এতে কোনো সন্দেহ নেই।

বিজ্ঞান প্রযুক্তি খাতে এসব বিশ্ববিদ্যালয়ের গ্র্যাজুয়েটরা ঠিক কতটুকু ভূমিকা রাখতে পারছেন বলে আপনি মনে করেন?

ধরনের বিশ্ববিদ্যালয় আমেরিকা, জাপান বা ভারতসহ পৃথিবীর প্রায় সব দেশেই আছে। তারা তাদের গবেষণা একাডেমিক কারিকুলাম সেভাবেই তৈরি করে বিশ্ববিদ্যালয়ের মান নির্ধারণ করে। তাদের গ্র্যাজুয়েটরাও সেভাবেই তৈরি হয়। জাতীয় আন্তর্জাতিক ইন্টারেস্ট মিটআপ করার জন্য তারা যোগ্যতা অর্জন করে। কিন্তু আমাদের দেশে আমরা সেটা করতে পেরেছি বলব না, তবে আমরা লক্ষ্যের দিকে এগোচ্ছি। ৯০ দশকের পরে বিজ্ঞান প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের যাত্রা শুরু হয়ে আজকে আমাদের যে পরিমাণ সক্ষমতা অর্জন করার কথা সেটা আমরা করতে পারিনি। তবে বিজ্ঞান প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর মধ্যে দু-একটি বিশ্ববিদ্যালয় গ্র্যাজুয়েটরা দেশ দেশের বাইরে আন্তর্জাতিক টেক জায়ান্ট কোম্পানিগুলোয়ও কাজ করছে।

এসব বিশ্ববিদ্যালয়ে বিজ্ঞানের বাইরের নানা বিষয় পড়ানো হচ্ছে। কোনো কোনো বিশ্ববিদ্যালয়ে অর্ধেকের মতো শিক্ষার্থী বিজ্ঞানের বাইরের বিষয়ের। প্রবণতা কমছে না। বিষয়টিকে কীভাবে দেখছেন?

বিজ্ঞান প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয় তৈরির লক্ষ্য ছিল বিশেষায়িত বিষয়ে উচ্চ দক্ষতাসম্পন্ন মানুষ তৈরি করা, টেকনোলজি ডেভেলপ করা, গবেষণা করে নতুন কিছু উদ্ভাবন করা। কাজগুলো করতে যেয়ে আমরা অনেক সময় মেশিনের মতো হয়ে যাই। সেজন্য সারা বিশ্বে সায়েন্স অ্যান্ড টেকনোলজির পাশাপাশি মানবিক মূল্যবোধের জন্য সোশ্যাল সায়েন্সের কিছু বিষয় ইন্টিগ্রেটেড পার্ট হিসেবে পড়ানো হয়। কিন্তু আলাদা করে বিভাগ খোলার প্রয়োজন আছে বলে আমি মনে করি না। আমাদের দেশে বুয়েটে যে পদ্ধতি অনুসরণ করা হয়, সেটা নিঃসন্দেহে ভালো। সোশ্যাল সায়েন্সের শিক্ষকদের জন্য নন-ডিগ্রি ডিপার্টমেন্ট থাকবে। এজন্য আলাদা করে বিভাগ খুলে মানবিকে যে ডিগ্রিগুলো আমরা দিয়ে থাকি এগুলো আমি সমর্থন করি না। তাতে অর্থের অপচয় অনেক বেশি হয়।

সব বিষয়ের সংমিশ্রণ হলে বিশেষায়িত বিশ্ববিদ্যালয় করার প্রয়োজনীতা রয়েছে কি?

বিশেষায়িত বিশ্ববিদ্যালয়গুলো যে লক্ষ্য উদ্দেশ্য নিয়ে তৈরি করা হয়েছিল সেটি ধরে রাখতে হলে মানবিক, ব্যবসায় শিক্ষা বা আইনের মতো বিষয়গুলো বিজ্ঞান প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ে না থাকাই শ্রেয়। তবে বিজ্ঞান বা প্রকৌশল অনুষদের শিক্ষার্থীদের সোশ্যাল সায়েন্সের বিষয়ে জানার জন্য নন-ডিগ্রি ডিপার্টমেন্ট খোলা যেতে পারে।

বিশেষায়িত বিশ্ববিদ্যালয় নিয়ে কোনো সংস্কারের প্রয়োজন আছে বলে আপনি মনে করেন?

উপাচার্য বা শিক্ষক হিসেবে আমাদেরও কিছু সীমাবদ্ধতা আছে, তবে এখানে যে ধরনের রাজনৈতিক হস্তক্ষেপ হয় সেটা বিশেষায়িত বিশ্ববিদ্যালয়গুলোকে সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত করছে বলে আমি মনে করি। বিজ্ঞান প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়গুলো ঢাকার বাইরে হওয়ায় স্থানীয় রাজনীতি মাঝে মাঝে এমন আকার ধারণ করে যে বিশ্ববিদ্যালয়ের কারিকুলাম চালিয়ে নিয়ে যাওয়া অসম্ভব হয়ে পড়ে। রাজনীতিবিদদের চাপ থাকে নিয়মকানুন না মেনে তাদের লোকজনের চাকরি দিতে হবে, নিয়মকানুন না মেনে তাদের টেন্ডার দিতে হবে, আরএফকিউ দিতে হবে। অনেক সময় উপাচার্যরা চাপে পড়ে এগুলো দিতে বাধ্য হন এবং পরবর্তী সময়ে পত্রপত্রিকায় লেখালেখি হয় উপাচার্যের নামে যে তিনি এগুলো করেছেন। এজন্য আমি মনে করি, বাংলাদেশ সরকারের এদিকে দৃষ্টি দেয়া উচিত। একই সঙ্গে রাজনীতিবিদদেরও দৃষ্টি দেয়া উচিত যে বিশ্ববিদ্যালয়গুলো নিজেদের অঞ্চলে হলেও এটি শুধু সেই অঞ্চলের জন্য না, এটি সারা দেশের, সারা বিশ্বের।

এসব বিশ্ববিদ্যালয়ে কী কী সংকট রয়েছে?

সাধারণ বিশ্ববিদ্যালয়ে যে পরিমাণ বাজেট লাগে, বিজ্ঞান প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ে তার চেয়ে অনেক বেশি বাজেট লাগে। কারণ বিজ্ঞান চর্চা করতে গেলে অনেক বেশি অর্থের প্রয়োজন হয়, বিশেষ করে বায়োটেকনোলজি বা কেমিক্যাল ইঞ্জিনিয়ারিংয়ের মতো বিষয়গুলোয়। সেভাবে আমরা বাজেট পাচ্ছি না। একটা বিভাগ খোলার অনুমতি দেয়া হচ্ছে কিন্তু সেটি পরিচালনা করার জন্য যে পরিমাণ লোকবল প্রয়োজন, যে ল্যাবরেটরি প্রয়োজন, যে অর্থ প্রয়োজন সেটি দেয়া হচ্ছে না।

অনেক ক্ষেত্রেই ছাত্ররাজনীতি এমন একটা অবস্থা তৈরি করে যে বিশ্ববিদ্যালয় পরিচালনার ক্ষেত্রে অনেক অসুবিধা হয়। কারণ তারা বিশ্ববিদ্যালয়কে ধারণ না করে বাইরের মানুষের নির্দেশনায় পরিচালিত হয়। এমন ঘটনা সব বিশ্ববিদ্যালয়ের জন্য একটা মহামারী আকার ধারণ করেছে। বিজ্ঞান প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়গুলোয় বিশ্বের সঙ্গে তাল মিলিয়ে বাংলাদেশের প্রয়োজনে টেকনোলজি ডেভেলপ করবে, দক্ষ মানবসম্পদ তৈরি হবে, সায়েন্টিস্ট হবে, তারা তো রাজনীতি করবে না। তবে পুরোপুরি রাজনীতি বিবর্জিত হোক সেটা আমি চাই না। কিন্তু বর্তমানে যে রাজনীতিটা চলছে সেটা প্রতিষ্ঠানগুলোকে অনেক ক্ষতি করছে বলে আমি মনে করি।

কী কী সম্ভাবনা রয়েছে?

এরই মধ্যে আমাদের বেশ কয়েকটি গবেষণা কোম্পানির সঙ্গে কোলাবরেশন করে বাজারজাত করার জন্য ফিল্ড ট্রায়ালে আছে। এসব বিশ্ববিদ্যালয়ের গ্র্যাজুয়েটরা এরই মধ্যে দেশ বিশ্বের টেক জায়ান্ট কোম্পানিগুলোয় অবদান রাখছে। আশা করি, উপযুক্ত পরিবেশ সৃষ্টি হলে মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর স্মার্ট বাংলাদেশ বিনির্মাণে বিজ্ঞান প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের গ্র্যাজুয়েটরা অগ্রণী ভূমিকা পালন করবে।

আপনার যদি কিছু বলার থাকে...

বিজ্ঞান প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়গুলো যে উদ্দেশ্যে তৈরি করা হয়েছে তা অর্জনের জন্য যে অর্থ বরাদ্দ, লোকবল অবকাঠামো প্রয়োজন, যে পরিবেশ দেয়া দরকার সেটা যদি না দেয়া হয়, তাহলে বিশ্ববিদ্যালয়গুলো চলবে কিন্তু জাতির লক্ষ্য পূরণে তারা ভূমিকা রাখতে পারবে না। বর্তমান বিশ্ব যে গতিতে এগিয়ে চলছে আর আমরা যদি অ্যাডভান্স না হই তাহলে প্রধানমন্ত্রীর যে ভিশন ২০৩১ ২০৪১ এবং শতবর্ষের পরিকল্পনা কখনো বাস্তবায়ন হবে না। স্বপ্ন পূরণের লক্ষ্যে আমাদের সবার কাজ করা উচিত।

এই বিভাগের আরও খবর

আরও পড়ুন