‘আল-আরাফাহ্ ইসলামী ব্যাংকে নগদ টাকার কোনো সংকট নেই’

আল-আরাফাহ্‌ ইসলামী ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক ও সিইও ফরমান আর চৌধুরী ছবি: নিজস্ব আলোকচিত্রী

ফরমান আর চৌধুরী। দায়িত্ব পালন করছেন আল-আরাফাহ্‌ ইসলামী ব্যাংক পিএলসির ব্যবস্থাপনা পরিচালক ও সিইও পদে। ২০১৮ সালের অক্টোবরে এ পদে যোগ দেন তিনি। দেশী-বিদেশী ব্যাংকে প্রায় চার দশকের ব্যাংকিং অভিজ্ঞতা রয়েছে তার। শরিয়াহভিত্তিক ব্যাংকটির কার্যক্রম, সাফল্য, সম্ভাবনাসহ দেশের ব্যাংক খাত নিয়ে তিনি কথা বলেছেন বণিক বার্তার সঙ্গে। সাক্ষাৎকার নিয়েছেন ইমামূল হাছান আদনান

প্রতিষ্ঠার তিন দশকে পদার্পণ করল আল-আরাফাহ্‌ ইসলামী ব্যাংক পিএলসি। ব্যাংকটির প্রতিষ্ঠার পটভূমি জানতে চাই।

১৯৯৫ সালের ২৭ সেপ্টেম্বর আল-আরাফাহ্ ইসলামী ব্যাংকের কার্যক্রম শুরু হয়েছিল। ইসলামী শরিয়াহভিত্তিক একটি ব্যাংক প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে কিছু ইসলামী চিন্তাবিদ ও ব্যবসায়ী একত্র হয়ে এটি প্রতিষ্ঠা করেন। শুরুতে উদ্যোক্তারা চেষ্টা করেছিলেন ব্যাংকটির নাম ‘হজ্জ ব্যাংক’ রাখার। কিন্তু একটি আর্থিক প্রতিষ্ঠানের নামের সঙ্গে ‘হজ্জ’ শব্দটি যুক্ত থাকায় শেষ পর্যন্ত সেটি হয়নি। পরে ‘হজ্জে’র সঙ্গে সম্পৃক্ত ‘আল-আরাফাহ্‌’ নামে ব্যাংকটির কার্যক্রম শুরু হয়। এরপর ধীরে ধীরে ব্যাংকটি সাফল্যের পথে এগিয়েছে। মাঝে কিছু খারাপ সময়ও গিয়েছিল। কিন্তু সেটি কাটিয়ে উঠে ব্যাংকটি স্থিতিশীল ও সফল ব্যাংক হিসেবে পরিচিতি পেয়েছে।

২৯ বছরে আল-আরাফাহ্‌র বিস্তৃতি ও পরিধি কতটুকু ঘটল?

আল-আরাফাহ্‌ ইসলামী ব্যাংকের নেটওয়ার্ক সারা দেশে বিস্তৃত। বর্তমান ২২৫টি শাখা, ৭৫টি উপশাখা, ৭৫০টির মতো এজেন্ট আউটলেট ও ২৪৫টি এটিএম বুথ নিয়ে আমাদের কার্যক্রম চলছে। আমাদের গ্রাহক সংখ্যা প্রায় ৩৬ লাখ। আমাদের কাছে গ্রাহকদের আমানত রয়েছে ৫১ হাজার কোটি টাকার। আর প্রায় ৪৬ হাজার কোটি টাকার বিনিয়োগ রয়েছে।

আমানত ও বিনিয়োগের মধ্যকার ব্যবধান তো দেখছি বেশ ভালো। তার মানে তারল্যের দিক থেকে আপনারা স্বস্তিতে আছেন?

হ্যাঁ, নগদ তারল্যের দিক থেকে আমরা ভালো আছি। পরিচালনা পর্ষদ ভেঙে দেয়ার পর কিছুটা চাপ তৈরি হয়েছিল। সেটি পরে স্বাভাবিক হয়ে এসেছে। আমানতকারীরা আমাদের ওপর পূর্ণ আস্থা রাখছেন। 

ব্যাংকে করপোরেট সুশাসন ফিরিয়ে আনার ক্ষেত্রে পুনর্গঠিত পর্ষদ কার্যকর ভূমিকা রাখবে বলে মনে করেন কি?

অবশ্যই কার্যকর ভূমিকা রাখবে। তবে আগেও আমাদের ব্যাংকে সুশাসন ছিল না, বিষয়টি তা নয়। আল-আরাফাহ্‌ ইসলামী ব্যাংক পর্ষদের ২০ জন পরিচালকের মধ্যে মাত্র একজন ছিলেন এস আলম গ্রুপসংশ্লিষ্ট। তিনিও ব্যাংকের কোনো কার্যক্রমে অনৈতিক হস্তক্ষেপ করতেন না।

আপনি বলতে চাচ্ছেন, আল-আরাফাহ্‌ ইসলামী ব্যাংকের সঙ্গে এস আলম গ্রুপের যে সংশ্লিষ্টতার কথা আসছে, সেটি মাত্র ৪-৫ শতাংশ?

হ্যাঁ, বিষয়টি তেমনই। এ ব্যাংকের মাত্র ৪-৫ শতাংশ শেয়ার গ্রুটির সঙ্গে সম্পৃক্ত। এ ব্যাংকে কখনো কোনো বেনামী ঋণ অনুমোদন হয়নি। বাংলাদেশ ব্যাংক নিরীক্ষা করেও কিছু পায়নি। এস আলম গ্রুপের কোনো বিরূপ প্রভাব এ ব্যাংকের ওপর ছিল না। আল-আরাফাহ্‌ ইসলামী ব্যাংকের পরিচালনা পর্ষদ ও ব্যবস্থাপনা কর্তৃপক্ষ আগেও স্বাধীনভাবে কাজ করতে পেরেছে।

আপনি বলছিলেন, পর্ষদ ভাঙার পর আমানতকারীদের মধ্যে আতঙ্ক ছিল। কেউ কেউ টাকা তুলে নিয়েছিলেন, আবার পরে ব্যাংকে এসে জমা রেখে গেছেন। এত দ্রুত আস্থা ফিরল কীভাবে?

পরিচালনা পর্ষদ ভাঙার পর গ্রাহকদের মধ্যে একটি নেতিবাচক মনোভাব তৈরি হয়েছিল। এ কারণে কিছু গ্রাহক আমাদের কাছে টাকা তুলতে এসেছিলেন। আমরা সব গ্রাহককেই চাহিদা অনুযায়ী টাকা ফেরত দিয়েছি। ব্যাংকে এসে চাহিদা অনুযায়ী টাকা তুলতে পারেননি, এমন একটি ঘটনাও ঘটেনি। ১০, ২০, ৫০ কোটি, যে যে পরিমাণ আমানতই তুলতে চেয়েছেন, আমরা দিয়েছি। এ কারণে গ্রাহকদের আতঙ্ক কেটে গেছে। এমন ঘটনাও ঘটেছে, একজন গ্রাহক ৫০ লাখ টাকা তুলে বাসায় নিয়ে গেছেন, আবার পরদিন এনে ব্যাংকে জমা দিয়েছেন। আতঙ্কিত গ্রাহকরা মূলত দেখতে চেয়েছেন, আমরা টাকা ফেরত দিতে পারি কিনা? আল-আরাফাহ্ ইসলামী ব্যাংকের ওপর গ্রাহকদের আস্থা অটুট আছে।

বর্তমান পরিস্থিতিতে বিনিয়োগের (ঋণ) ক্ষেত্রে কী ধরনের পদক্ষেপ নিচ্ছেন?

আমাদের পুরনো গ্রাহকরা চলতি মূলধন পাওয়ার ক্ষেত্রে তেমন কোনো প্রতিবন্ধকতার মুখে পড়ছেন না। তবে বিরাজমান পরিস্থিতিতে নতুন বিনিয়োগের ক্ষেত্রে আমরা বাড়তি সতর্কতা অবলম্বন করছি। দেশের পরিবেশ-পরিস্থিতি ও ব্যবসা-বাণিজ্য কিছুটা খারাপ। এ কারণে বিনিয়োগের ক্ষেত্রে আমরা সিলেক্টিভলি এগোচ্ছি। বড়দের ঋণ আর বাড়াচ্ছি না। এসএমই ও কৃষি খাতে বিনিয়োগকে অগ্রাধিকার দেয়া হচ্ছে।

আল-আরাফাহ্ ইসলামী ব্যাংকের বড় গ্রাহক কারা? বিনিয়োগের ক্ষেত্রে কোন খাতকে আপনারা বেশি অগ্রাধিকার দিয়েছিলেন?

দেশের স্বনামধন্য সব বড় শিল্প গ্রুপেই আল-আরাফাহ্ ইসলামী ব্যাংকের বিনিয়োগ রয়েছে। আবুল খায়ের, মেঘনা, সিটি, টিকে, বাদশা, বিএসআরএম, কেএসআরএম, ইবনে সিনা, বিশ্বাস, মন্ডল গ্রুপ, প্রাণ, বসুন্ধরা, ইনসেপ্টা, হেলথকেয়ারসহ বড় সব শিল্প গ্রুপই আমাদের গ্রাহক। তৈরি পোশাক খাত, ভারী শিল্প, ওষুধসহ সব খাতেই আমরা বিনিয়োগ করেছি। আমাদের গ্রাহকদের ঋণ পরিশোধ পরিস্থিতিও ভালো।

এসএমই ও কৃষিতে বিনিয়োগ বাড়াতে কী ধরনের উদ্যোগ নিচ্ছেন?

ব্যাংকের প্রতিটি শাখায় আমরা এসএমই ডেস্ক খুলেছি। এসএমই ফোকাস নারী ও নতুন উদ্যোক্তাদের অর্থায়নে জোর দিয়েছি। আল-আরাফাহ্‌ রুরাল ডেভেলপমেন্ট স্কিম নামে একটি স্কিম আমরা চালু করেছি। এ স্কিমের মাধ্যমে আমরা একেবারেই প্রান্তিক জনগোষ্ঠীর কাছে ঋণ পৌঁছাচ্ছি। ৬৫ হাজার ক্ষুদ্র নারী উদ্যোক্তার মাঝে আমরা ৪২৬ কোটি টাকার মতো ঋণ দিয়েছি। 

দেশে ইসলামী ধারার ব্যাংকিং চালুর পর থেকেই প্রবৃদ্ধির ধারায় ছিল। কিন্তু বর্তমান পরিস্থিতি একেবারেই ভিন্ন। প্রথমবারের মতো এ ধারার ব্যাংকিং বড় ধরনের ধাক্কা খেয়েছে। বিরাজমান পরিস্থিতি উত্তরণে ব্যাংকগুলোর কী ধরনের ভূমিকা নেয়া দরকার বলে মনে করেন?

আমার মনে হয়, যেকোনো ধারার ব্যাংকের জন্য গ্রাহকের আস্থাই সবচেয়ে বড়। যেমন ইসলামী ব্যাংক সব সময়ই গ্রাহকদের আস্থায় ছিল। আশা করছি, শিগগিরই ব্যাংকটি বর্তমান পরিস্থিতি কাটিয়ে ওঠবে। এ ধারার ব্যাংকগুলোও যদি গ্রাহক আস্থায় পৌঁছতে পারে, গ্রাহকদের আস্থা যদি ফেরাতে পারে, তাহলে ব্যাংকগুলো আবারো আগের ধারায় ফিরবে। বাংলাদেশের মানুষ ধর্মভীরু। এ দেশে ইসলামী ধারার ব্যাংকিং হারিয়ে যাবে না। আমরাও ধর্মভীরু মানুষগুলোকে হতাশ করতে চাই না।

৩০ বছরে পদার্পণ উপলক্ষে গ্রাহকদের উদ্দেশে কী বার্তা দিতে চান?

আমি আল-আরাফাহ্ ইসলামী ব্যাংকের সব গ্রাহককে বলতে চাই, আমরা আপনাদের সঙ্গে আছি। আপনাদের অর্ধলাখ কোটি টাকার বেশি আমানত আমাদের কাছে আছে। আমরা আপনাদের এ আমানতের রক্ষক। আপনারা যখন চাইবেন, তখনই আমরা টাকা ফেরত দেব। আমরা আপনাদের নিয়েই এগিয়ে যেতে চাই। আমানতের পাশাপাশি বিনিয়োগের ক্ষেত্রেও আমরা আপনাদের সঙ্গে নিয়েই দেশকে এগিয়ে নিয়ে যাব, ইনশা আল্লাহ।

এই বিভাগের আরও খবর

আরও পড়ুন