গভর্ন্যান্স অ্যাডভোকেসি ফোরাম আয়োজিত সংলাপে বক্তারা

ক্ষমতার বিকেন্দ্রীকরণে স্থানীয় সরকারকে সংস্কারের বিকল্প নেই

নিজস্ব প্রতিবেদক

রাজধানীর সিরডাপ মিলনায়তনে গতকাল স্থানীয় সরকার ব্যবস্থার সংস্কার বিষয়ে জাতীয় সংলাপ আয়োজন করে গভর্ন্যান্স অ্যাডভোকেসি ফোরাম ছবি: নিজস্ব আলোকচিত্রী

কেন্দ্রীভূত ক্ষমতার কারণে স্থানীয় সরকার অনেকটাই অকার্যকর হয়ে আছে। ফলে জাতীয় বাজেটের ৫০ শতাংশ স্থানীয় সরকার ব্যবস্থায় ব্যয় হলেও আদতে সেখানে স্থানীয় সরকারের কোনো নিয়ন্ত্রণ থাকে না। এ অবস্থায় ক্ষমতার বিকেন্দ্রীকরণ করতে হলে স্থানীয় সরকার ব্যবস্থা সংস্কার করা ছাড়া বিকল্প নেই বলে মত দিয়েছেন বিভিন্ন শ্রেণী-পেশার প্রতিনিধি ও বিশেষজ্ঞরা। 

গতকাল রাজধানীর সিরডাপ মিলনায়তনে ‘গণতান্ত্রিক বিকেন্দ্রীকরণ ও জনআকাঙ্ক্ষার আলোকে স্থানীয় সরকার সংস্কার’ শীর্ষক এক জাতীয় সংলাপে তারা এ মতামত তুলে ধরেন। দি এশিয়া ফাউন্ডেশনের সহযোগিতায় গভর্ন্যান্স অ্যাডভোকেসি ফোরাম এ সংলাপ আয়োজন করে। এতে মিডিয়া পার্টনার ছিল বণিক বার্তা। 

সংলাপে ২২টি সংস্কার প্রস্তাব তুলে ধরেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের লোকপ্রশাসন বিভাগের অধ্যাপক ড. মোবাশ্বের মোনেম। এর মধ্যে স্বল্পমেয়াদি প্রস্তাব ১০টি ও মধ্যমেয়াদি ১২টি। স্বল্পমেয়াদি সংস্কার প্রস্তাবের মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলো সংসদ সদস্যদের স্থানীয় সরকার প্রতিষ্ঠানে উপদেষ্টার ভূমিকাসংবলিত বিধান বাতিল করা; আইন অনুযায়ী উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তার ভূমিকা ও সাচিবিক দায়িত্ব পালন কার্যকর করা; উপজেলা ভাইস চেয়ারম্যানদের ভূমিকা, দায়দায়িত্বের বিভাজন সুনির্দিষ্ট ও কার্যকর করা; স্থানীয় সরকার প্রতিষ্ঠানে বর্তমানে নির্বাচিত নারী প্রতিনিধিদের ভূমিকা ও দায়দায়িত্ব সুস্পষ্ট করা এবং স্থানীয় সরকারের মডেল ট্যাক্স শিডিউল হালনাগাদ করা।

মধ্যমেয়াদি প্রস্তাবের মধ্যে রয়েছে স্থানীয় সরকারের যেসব আইনে ওভারল্যাপিং ও অস্পষ্টতা আছে, তা দূর করার জন্য কার্যকর ব্যবস্থা গ্রহণ; আইন অনুযায়ী স্থানীয় সরকার প্রতিষ্ঠানের অধীনে রাষ্ট্রের সেবামূলক কার্যক্রমগুলো (শিক্ষা, স্বাস্থ্য, কৃষি ইত্যাদি) ন্যস্ত করার বিধান পূর্ণাঙ্গভাবে কার্যকর করা; স্থানীয় সরকারের সর্বস্তরে এক-তৃতীয়াংশ আসন সংরক্ষণ করে ঘূর্ণায়মান পদ্ধতিতে নারী প্রতিনিধিদের সরাসরি নির্বাচনের বিধান করা ও জেলা প্রশাসকের কার্যালয়কে জেলা পরিষদ কার্যালয়ে রূপান্তর করা এবং জেলা পরিষদের সাচিবিক সহায়তার দায়িত্ব ডেপুটি কমিশনার বা জেলা নির্বাহী কর্মকর্তাকে দেয়া। 

মধ্যমেয়াদি সংস্কারের প্রস্তাবে আরো বলা রয়েছে—ডেপুটি কমিশনারের নেতৃত্বে জেলা পর্যায়ে কর পর্যালোচনা ও সংগ্রহ কার্যক্রম পরিচালনা এবং পর্যায়ক্রমে ডিজিটাল পদ্ধতিতে কর সংগ্রহের কাজ বাস্তবায়নের ব্যবস্থা করা; জেলা পরিষদকে জেলার অর্থনৈতিক উন্নয়ন কার্যক্রমের মূল কেন্দ্র হিসেবে গড়ে তোলা এবং বড় প্রকল্প গ্রহণের লক্ষ্যে তাদের প্রকল্পের আকার নির্দিষ্ট করে দেয়া। 

গভর্ন্যান্স অ্যাডভোকেসি ফোরামের সমন্বয়কারী ও ওয়েভ ফাউন্ডেশনের নির্বাহী পরিচালক মহসিন আলীর সঞ্চালনায় অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথি ছিলেন স্থানীয় সরকার, পল্লী উন্নয়ন ও সমবায় মন্ত্রণালয়ের উপদেষ্টা হাসান আরিফ। তিনি বলেন, ‘উপমহাদেশে ১০০ বছরের বেশি সময় ধরে স্থানীয় সরকারের কাঠামো চালু থাকলেও এখনো আমরা একে শক্তিশালী করে তুলতে পারিনি। আইনে অনেক কিছু থাকলেও আমরা সেসব কার্যকর করতে পারিনি। স্থানীয় সরকারকে কার্যকর করতে নির্বাচিত প্রতিনিধিদের রাজনৈতিক সদিচ্ছা দৃঢ় হতে হবে।’

স্থানীয় সরকার উপদেষ্টা মনে করেন, ‘সংস্কারের দাবিগুলো উত্থাপন করা দরকার নির্বাচিত সরকারের কাছে। অন্তর্বর্তী সরকার একটি সংস্কার করলে পরবর্তী সময়ে তারা তা অব্যাহত রাখবেন কিনা সে নিশ্চয়তা নেই। তাই যারা জনপ্রতিনিধি হবেন, ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত হবেন, তাদের প্রতিশ্রুতিবদ্ধ করতে হবে।’

স্থানীয় সরকার, পল্লী উন্নয়ন ও সমবায় মন্ত্রণালয়ের সচিব আবু হেনা মোরশেদ জামান বলেন, ‘আমরা সংস্কার চাই, নাকি কাঠামোগত বিপ্লব চাই, সেটা সুস্পষ্ট করতে হবে। সামনে এগোতে হলে সরকারি-বেসরকারি উভয় পক্ষকে একসঙ্গে কাজ করে যেতে হবে।’

দি এশিয়া ফাউন্ডেশনের কান্ট্রি রিপ্রেজেন্টেটিভ কাজী ফয়সাল বিন সেরাজ বলেন, ‘আমরা এ ধরনের কাজ বাস্তবায়নকারী সংস্থাগুলোকে ৭০ বছর ধরে সহায়তা করে আসছি। আজকের এ আয়োজনও অনুপ্রেরণামূলক। বিকেন্দ্রীকরণ ও স্থানীয় সরকার সংস্কার বিষয়ে আরো কী কাজ করা যায়, সে বিষয়ে দি এশিয়া ফাউন্ডেশন আরো ভাবনাচিন্তা করবে।’

স্থানীয় সরকার বিভাগের সাবেক অতিরিক্ত সচিব স্বপন কুমার সরকার বলেন, ‘স্থানীয় সরকার নির্বাচন সুষ্ঠুভাবে করতে হবে এবং জাতীয় নির্বাচনের আগে এ নির্বাচনের ব্যবস্থা করতে হবে।’

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের লোকপ্রশাসন বিভাগের অধ্যাপক ড. ফেরদৌস আরফিনা ওসমান বলেন, ‘৫৩ বছর ধরে স্থানীয় সরকারের বিকেন্দ্রীকরণ হয়নি। আসলেই কোনো সরকারই এটা চায়নি। সংসদ সদস্যদের উপদেষ্টার ভূমিকা দিয়েই কেন্দ্রীয় ক্ষমতাকে স্থানীয় সরকারে পোক্ত করা হয়েছে। স্থানীয় প্রশাসনকে জবাবদিহি করতে হবে স্থানীয় জনপ্রতিনিধিদের কাছে।’

বাংলাদেশ সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী ও লিড বাংলাদেশের প্রধান নির্বাহী আব্দুল্লাহ আল নোমান বলেন, ‘আমাদের মতো তৃতীয় বিশ্বের দেশগুলোয় নিজেদের বাস্তবতায় ভাবতে হবে। জনপ্রশাসন ও স্থানীয় সরকারকে আলাদা করতে হবে। প্রয়োজনে প্রশাসন থেকে প্রেষণে স্থানীয় সরকারে কর্মকর্তারা যেতে পারেন।’

ডেমোক্রেসি ওয়াচের প্রতিষ্ঠাতা চেয়ারপারসন তালেয়া রেহমান বলেন, ‘আমরা অনেক দিন ধরে স্থানীয় সরকার সংস্কারের এসব দাবি তুলে ধরে আসছি। এবার যেন গভর্ন্যান্স অ্যাডভোকেসি ফোরামের দাবিগুলো বাস্তবায়ন হয়।’

এনআরডিএসের নির্বাহী পরিচালক আব্দুল আউয়াল বলেন, ‘বিকেন্দ্রীকরণের জন্য প্রয়োজন রাজনৈতিক সদিচ্ছা। এসডিজি অর্জনে অচিরেই কৃষি, শিক্ষা, স্বাস্থ্যসহ সব সেবা স্থানীয় সরকারে হস্তান্তর করতে হবে।’

মহসিন আলী বলেন, ‘স্বাধীনতার পর থেকে স্থানীয় সরকার ব্যবস্থা শক্তিশালীকরণে বিভিন্ন পদক্ষেপ নেয়া হলেও দুর্নীতি, স্বেচ্ছাচারিতার কারণে সেগুলো কার্যকর হয়নি। আমাদের স্থানীয় প্রতিনিধি দলপুষ্ট হওয়ায় দলের এজেন্ডা বাস্তবায়নে ব্যতিব্যস্ত থাকেন, পক্ষান্তরে জনআকাঙ্ক্ষার বিষয়গুলো পেছনে পড়ে যায়।’

অনুষ্ঠানে অন্যদের মধ্যে বক্তব্য রাখেন কেয়ার বাংলাদেশের থ্রিভ অ্যাক্টিভিটির চিফ অব পার্টি আমানুর রহমান, মানুষের জন্য ফাউন্ডেশনের সিনিয়র কোঅর্ডিনেটর জিয়াউল করিম, অ্যাকশনএইড বাংলাদেশের ডেপুটি ম্যানেজার অমিত রঞ্জন দে ও জাতীয় নাগরিক কমিটির সদস্য মুনিরা শারমিন।

এই বিভাগের আরও খবর

আরও পড়ুন