বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে পিএইচডি

আইন মেনে না চলা বিশ্ববিদ্যালয় কখনো পিএইচডি চালুর অনুমতি পাবে না

ছবি : বণিক বার্তা

অধ্যাপক ড. বিশ্বজিৎ চন্দ। বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরী কমিশনের (ইউজিসি) সদস্য ও বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে পিএইচডি প্রোগ্রাম চালুর খসড়া নীতিমালা প্রণয়ন কমিটির আহ্বায়ক। বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়গুলোয় পিএইচডি প্রোগ্রাম চালুর উদ্যোগ, নীতিমালার রূপরেখাসহ এ বিষয়ের নানা দিক নিয়ে কথা বলেছেন বণিক বার্তার সঙ্গে। সাক্ষাৎকার নিয়েছেন শফিকুল ইসলাম

পিএইচডি ডিগ্রি বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে প্রেস্টিজিয়াস একটা বিষয় হিসেবে দেখা হয়। পিএইচডি কি আলংকারিক ডিগ্রি?

প্রকৃতপক্ষে পিএইচডি আলংকারিক ডিগ্রি না। কারো জন্য এটা বিলাসিতা। যার প্রয়োজন নেই অর্থাৎ যার পিএইচডি আর কোনো কাজে লাগে না সেটা হতে পারে তার পেশাগত দিক দিয়ে অথবা তিনি কোনো গবেষণার সঙ্গে সম্পৃক্ত না এবং পিএইচডির জন্য একবারই গবেষণা করেছেন এবং সে পর্যন্তই শেষ। এর কোনো প্রায়োগিক দিক যদি তার জন্য না থাকে তার ক্ষেত্রে অবশ্যই আলংকারিক। অন্যথায় এটাকে আলংকারিক বলা যাবে না। কারণ বিশেষ করে যারা উচ্চ শিক্ষার এবং উচ্চতর গবেষণার সঙ্গে আছেন তাদের অধিকাংশ ক্ষেত্রে পিএইচডি আবশ্যিক একটা বিষয়। অন্যথায় অন্য পেশায় যারা আছেন তাদের অনেকের জন্য এটা আলংকারিক হতে পারে।

নতুন জ্ঞান সৃষ্টিতে দেশের প্রচলিত পিএইচডি গবেষণা কতটুকু কাজে আসছে?

পিএইচডি গবেষণা ব্যাপক কাজে আসে। গবেষণার মাধ্যমে অবশ্যই নতুন জ্ঞান সৃষ্টি হয়। এখানে কোনো ব্যক্তি বা পিএইচডি গবেষণার সঙ্গে যারা জড়িত তাদের দুর্বলতাকে আমরা পিএইচডির ওপর দোষ চাপাতে পারব না। তারা যদি সঠিক পন্থায় পিএইচডি অর্জন না করেন সে দোষটা তাদের। আর যারা সঠিক পন্থায় করেন অথবা যে যে প্রক্রিয়া অনুসরণ করে ডিগ্রি নেয়া উচিত সেটা করেন তাদের সঙ্গে তুলনা করা যাবে না। দুই রকমই আছে। একটি হলো যারা প্রকৃত অর্থেই যেভাবে গবেষণা করলে নতুন জ্ঞানের সৃষ্টি হয় এবং সে জ্ঞানকে কাজে লাগাতে হয় সে রকমভাবেই করেন তাদের জন্য পিএইচডি অবশ্যই ভালো এবং সঠিক পথে তারা ডিগ্রিটা নিচ্ছেন। আর কেউ যদি অন্যের ধার করা মাধ্যমে অথবা নিজে না লিখে অন্যকে দিয়ে লিখিয়ে নেন সেসব পিএইডির কোনো মূল্য নেই। ওই ব্যক্তির যদি আত্মমর্যাদাবোধ থাকত তাহলে হয়তো তিনি এটা করতেন না। যার আত্মমর্যাদাবোধ নেই, অন্যকে দিয়ে পিএইচডি থিসিস লেখান, অন্যের লেখা থেকে নকল করেন তাদের পিএইচডি আসলে পিএইচডি না।

দেশে এখন পিএইচডিধারীর সংখ্যা অর্ধ লাখের বেশি। তালিকায় ২০ থেকে ২৪ বছর বয়সসীরাও আছে। বিষয়টি কীভাবে দেখছেন?

দেশের বাইরে আন্ডারগ্র্যাজুয়েট ডিগ্রির পর পিএইচডি করে এমনকি ইংল্যান্ডেও আন্ডারগ্র্যাজুয়েট ডিগ্রির পর পিএইচডি করতে পারে যদি তার সেই যোগ্যতা থাকে। সেক্ষেত্রে হয়তো তাদের ২২-২৩ বছরের মধ্যে পিএইডি সম্পন্ন হতে পারে। কিন্তু বাংলাদেশে সেখানে অনার্স মাস্টার্স না থাকলে পিএইচডিতে ভর্তি হওয়া যায় না। যদি অনার্স, মাস্টার্সের সেশন জট বাদ দিই তাহলে মাস্টার্স শেষ করতে ২২ বছর লাগবেই, যদি কোনো ধরনের সেশন জট না থাকে। তারপর পিএইডি সম্পন্ন করতে তিন-চার বছর লাগবেই। সেক্ষেত্রে ২২-২৪ বছরের মধ্যে যদি পিএইচডি সম্পন্ন করে সেটি নিয়ে প্রশ্ন থেকে যায়। যদি বিদেশে আন্ডারগ্র্যাজুয়েট ডিগ্রির পর পিএইচডি করে তাহলে হয়তো ২২ বছরের মধ্যে সম্ভব।

বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার বয়স তিন দশকেরও বেশি। ইউজিসি এত দীর্ঘ সময় পর কেন মনে করল বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে পিএইচডি ডিগ্রি চালুর অনুমতি দেয়া উচিত?

বেশকিছু বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে গবেষণার পরিবেশ তৈরি হয়েছে। তাই ইউজিসি মনে করেছে এসব বিশ্ববিদ্যালয়ের পিএইচডি চালুর সক্ষমতা রয়েছে। সেজন্য বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে পিএইচডি চালুর উদ্যোগ নিয়েছে ইউজিসি।

আপনি বিশ্ববিদ্যালয়ের সক্ষমতার কথা বললেন। সেই সক্ষমতার মানদণ্ড কী?

প্রথমত বিশ্ববিদ্যালয়ের সুনাম। ওই বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক বা গবেষক যারা তাদের যোগ্যতা। তাদের পিএইচডি করানোর মতো যোগ্যতা বা অভিজ্ঞতা আছে কিনা। পিএইচডি গবেষণা তত্ত্বাবধানের সক্ষমতা আছে কিনা। বিশ্ববিদ্যালয়গুলো যথাযথ আইন মানে কিনা। বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়গুলো অতিরিক্ত ছাত্র ভর্তি করায় কিনা। অর্থাৎ আইন না মানার সংস্কৃতি যে বিশ্ববিদ্যালয়ে আছে সেটাকেও আমরা সঠিক জায়গা মনে করব না। তাদেরকে পিএইচডি চালুর অনুমতি দেয়া হবে না। পাশাপাশি সনদ বিক্রির অভিযোগ যদি থাকে এবং সে অভিযোগ যদি প্রমাণিত হয় তাহলে সেসব বিশ্ববিদ্যালয়কে নীতিমালার বাইরে রাখা হবে। অভিযোগ থাকলে অভিযোগ মিথ্যা প্রমাণিত না হওয়ার আগ পর্যন্ত তাদেরও পিএইচডির নীতিমালার বাইরে রাখা হবে। আইনের প্রতিটা বিষয় যারা মেনে চলেছে তাদের অগ্রাধিকার দেয়া হবে। গবেষণার পরিবেশ এবং তারা যে বিভিন্ন বিষয়ে গবেষণা করেছেন তার প্রমাণ থাকতে হবে। ইউজিসি নিশ্চয়ই এগুলো অবগত আছেন কারা নিয়ম মানে আর কারা নিয়ম মানে না।

পিএইচডি চালুর জন্য যে খসড়া নীতিমালা তৈরি হচ্ছে তার রূপরেখা কেমন হবে?

বাংলাদেশের ভালো প্রতিষ্ঠানগুলো কীভাবে চলছে এবং দেশের বাইরের বিশ্ববিদ্যালয়গুলো কী প্র্যাকটিস করছে-এর সমন্বয়ে নীতিমালা তৈরি হবে। অনিয়ম করে কাউকে পিএইচডি দেয়ার বিষয়গুলো তদারক করা হবে। পিএইচডি দেয়ার ক্ষেত্রে প্রথম বছর অন্তত তাদের যে গবেষণা পদ্ধতি এবং পিএইচডি থিসিস কীভাবে লিখতে হয়- ব্যাপারে ট্রেনিংয়ের ব্যবস্থা করা হবে। প্রথম বছরেই নীতিমালা আলোকপাত করা হবে। পাশাপাশি যাদের দেয়া হবে তাদের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের সুনাম এবং শিক্ষকদের সুনাম, যোগ্যতা, অভিজ্ঞতা, বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষা গবেষণার পরিবেশ, তাদের বর্তমান গবেষণার মান এবং ফল সমাজের জন্য কতটা কাজে লেগেছে এগুলো দেখা হবে। পাশাপাশি ওই বিশ্ববিদ্যালয় নিয়ম মেনে চলছে কিনা। আইনের বাইরে কিছু করছে কিনা। এগুলো বিবেচনা রেখে তাদের পিএইচডি চালুর অনুমতি দেয়া হবে। কমিটির খসড়া নীতিমালার কাজ সম্পন্ন হতে বেশি সময় লাগবে না। সব মিলিয়ে মডিউলসহ দুই-তিন মাস লাগতে পারে।

পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে পিএইচডির নীতিমালা একেক বিশ্ববিদ্যালয়ে একেক রকম কিন্তু বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের জন্য একক নীতিমালা তৈরি হচ্ছে। সব বিশ্ববিদ্যালয়ের জন্য একক নীতিমালা নয় কেনো? বিষয়টা বৈপরীত্য কিনা?

এটা মোটেও বৈপরীত্য না। পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের কোনো সমন্বিত নীতিমালা নেই। কোনো কোনো বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য বলেছেন যে আমাদের জন্য একটা নীতিমালা থাকা আবশ্যক। আমরা পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের সঙ্গে বসে তাদের জন্য একটা সমন্বিত নীতিমালা করতে পারি।

ইউজিসির নীতিমালার অধীনে যে বিশ্ববিদ্যালয়গুলো পড়বে না তারাও হয়তো আসতে চাইবে। এসব বিশ্ববিদ্যালয় পিএইচডির অনুমতি পেলে তখন পিএইচডি ডিগ্রি সহজলভ্য হবে কি?

এটা মোটেও সহজলভ্য হবে না। যেসব বিশ্ববিদ্যালয় আইন মেনে চলে না তারা কখনো পিএইচডি চালুর অনুমতি পাবে না। যদি মনে করা হয় এটা চালু করলে সনদ বাণিজ্যের একটা রাস্তা তৈরি হবে তাহলে বন্ধ করে দেয়া হবে। নীতিমালা এতটাই শক্ত হবে যে যারা নীতিমালার আওতায় পড়বে না তারা কখনো পাবে না। পুরো বিশ্ববিদ্যালয়ে দেয়া হবে না, বরং কিছু ডিপার্টমেন্টকে দেয়া হবে যারা সক্ষম। তাও দেখেশুনে দেয়া হবে তাদের অভিজ্ঞ শিক্ষক আছে কিনা। গবেষণার পরিবেশ আছে কিনা। ঢালাওভাবে কিছু করা হবে না। চাইলেই সবাই আবেদন করতে পারবেন না। অনেকের আবেদনের যোগ্যতাও হয়তো থাকবে না।

বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে পিএইচডি চালু হলে দেশ কতটুকু উপকৃত হবে?

পিএইচডি স্বনামধন্য প্রতিষ্ঠানগুলোই পাবে। যেখানে যোগ্য অভিজ্ঞ শিক্ষকরা তত্ত্বাবধান করতে পারবেন। বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের অনেক শিক্ষক আছেন যাদের অনেক গবেষণামূলক কাজ আছে। তাদের অনেক অভিজ্ঞতাও আছে। সেই সব শিক্ষক যদি সুযোগটা কাজে লাগান আর ভালো গবেষণা করতে চান এমন শিক্ষার্থীদের ভর্তি করানো হয় তাহলে দেশ উপকৃত হবে। পিএইচডিগুলো দেশের সুনাম বৃদ্ধি করবে এবং দেশে নতুন জ্ঞান সৃষ্টির মাধ্যমে নতুন নতুন উদ্ভাবনের দিকে বিজ্ঞান বা আইসিটি রিলেটেড বিষয়গুলোয় গুরুত্বপূর্ণ অবদান রাখবে।

এই বিভাগের আরও খবর

আরও পড়ুন