আইএমএফের শর্ত বাস্তবায়ন

দেশের ব্যাংক খাতের ঋণ শ্রেণীকরণ পদ্ধতিতে বড় পরিবর্তন আসছে

নিজস্ব প্রতিবেদক

ছবি : বণিক বার্তা

ঋণ কর্মসূচির আওতায় তৃতীয় কিস্তির অর্থ ছাড়ের আগে আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিলের (আইএমএফ) রিভিউ মিশনের কাছে ব্যাংক খাতের ঋণ শ্রেণীকরণ পদ্ধতিতে বড় পরিবর্তন আনার প্রতিশ্রুতি দেয় বাংলাদেশ। আগামী বছরের মার্চের মধ্যেই এ পরিবর্তনের প্রতিশ্রুতি বাস্তবায়ন হতে যাচ্ছে বলে অর্থ মন্ত্রণালয় সূত্রে জানা গেছে। আইএমএফের সাম্প্রতিক এক প্রতিবেদনেও বিষয়টি উঠে এসেছে।

অর্থ মন্ত্রণালয় সূত্রে জানা গেছে, নতুন পরিকল্পনা অনুসারে, এ বছরের এপ্রিল-সেপ্টেম্বরে যেসব ঋণের মেয়াদ শেষ হবে সেগুলোর ক্ষেত্রে নির্ধারিত সময়ের সঙ্গে ১৮০ দিন যোগ করে মেয়াদোত্তীর্ণ ঋণ হিসাব করা হবে। এর পর থেকে বছরের শেষ পর্যন্ত যেসব ঋণের মেয়াদ শেষ হবে সেগুলোর ক্ষেত্রে মেয়াদোত্তীর্ণ ঋণ হিসাব করা হবে নির্ধারিত সময়ের সঙ্গে ৯০ দিন যোগ করে। এরপর থেকে ৯০ দিনের গ্রেস পিরিয়ড তুলে দেয়া হবে। আর ২০২৫ সালের মার্চ শেষে ঋণ পরিশোধের নির্ধারিত সময়ের একদিন পর থেকেই তা মেয়াদোত্তীর্ণ হিসেবে গণ্য করা হবে। এরই মধ্যে এ বিষয়ে বাংলাদেশ ব্যাংকের পক্ষ থেকে একটি সার্কুলার জারি করা হয়েছে।

ব্যাংক ঋণ খেলাপি হওয়ার আগের ধাপ ‘ওভারডিউ’ বা ‘মেয়াদোত্তীর্ণ’। কোনো ঋণের কিস্তি পরিশোধ অনিয়মিত হয়ে গেলে সেটি মেয়াদোত্তীর্ণ বলে গণ্য হয়। এ ধরনের ঋণই পরে যুক্ত হয় খেলাপির খাতায়। বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্য বলছে, চলতি বছরের মার্চ শেষে মেয়াদোত্তীর্ণ হওয়া ঋণের পরিমাণ দাঁড়িয়েছে ২ লাখ ৫৭ হাজার ৩৯২ কোটি টাকায়। পরিশোধ বা পুনঃতফসিলের মাধ্যমে নিয়মিত না করা হলে এ ঋণও শিগগিরই খেলাপির খাতায় উঠবে। আবার ঋণ শ্রেণীকরণ পদ্ধতিতে পরিবর্তন এলে এর বড় অংশই খেলাপি হওয়ার শঙ্কা রয়েছে। 

দেশের ব্যাংক খাতে খেলাপির মতো মেয়াদোত্তীর্ণ ঋণের পরিমাণও ব্যাপক মাত্রায় বাড়ছে। কেন্দ্রীয় ব্যাংকের তথ্য পর্যালোচনায় দেখা যায়, ২০২২ সালের মার্চে ব্যাংক খাতে মেয়াদোত্তীর্ণ ঋণের পরিমাণ ছিল ১ লাখ ৮৮ হাজার ৯৭২ কোটি টাকা। ২০২৩ সালের মার্চ শেষে তা বেড়ে ২ লাখ ১৮ হাজার ৬৬৫ কোটি টাকায় দাঁড়ায়। চলতি বছরের একই সময়ে মেয়াদোর্ত্তীর্ণ ঋণ এসে ঠেকেছে ২ লাখ ৫৭ হাজার ৩৯২ কোটি টাকায়।

মেয়াদোত্তীর্ণ ঋণ খেলাপি হয়ে যাওয়া ঠেকাতে প্রতিনিয়ত পুনঃতফসিলের আশ্রয় নিচ্ছে ব্যাংকগুলো। শুধু ২০২২ সালেই রেকর্ড ৬৩ হাজার ৭২০ কোটি টাকার ঋণ পুনঃতফসিল করা হয়। গত বছর পুনঃতফসিল করে মেয়াদ বাড়িয়ে দেয়া ঋণের পরিমাণ আরো বেশি। 

খেলাপি, পুনঃতফসিল ও পুনঃগঠনকৃত ঋণকে ‘স্ট্রেসড’ বা ‘দুর্দশাগ্রস্ত’ হিসেবে দেখায় আইএমএফ। গত বছর শেষে পুনঃতফসিলকৃত ঋণের স্থিতি ৩ লাখ কোটি টাকা ছাড়ায়। আবার স্বাভাবিক প্রক্রিয়ায় আদায় অযোগ্য হওয়ায় ব্যাংকগুলো প্রায় ৬৮ হাজার কোটি টাকার ঋণ অবলোপনও করেছে। সব মিলিয়ে দেশের ব্যাংক খাতের এক-তৃতীয়াংশের বেশি ঋণ এখন অনিশ্চয়তার মুখে। গত মার্চ শেষে দেশের ব্যাংকগুলোর বিতরণকৃত ঋণের স্থিতি ছিল ১৬ লাখ ৪০ হাজার ৮৫৫ কোটি টাকা।

আইএমএফের সঙ্গে পরামর্শক্রমে ঋণ শ্রেণীকরণ ও সঞ্চিতি বিধিমালা শক্তিশালী করার কথা জানিয়েছে বাংলাদেশ। এ বছরের ডিসেম্বরের মধ্যে এটি বাস্তবায়নের লক্ষ্যমাত্রা রয়েছে। পাশাপাশি দুর্দশাগ্রস্ত সম্পদের প্রকৃত চিত্র শনাক্তে আইএফআরএস ৯ (ইন্টারন্যাশনাল ফাইন্যান্সিয়াল রিপোর্টিং স্ট্যান্ডার্ড) গ্রহণের পরিকল্পনা প্রণয়নের প্রতিশ্রুতি দেয়া হয়েছে। আগামী বছরের জুনের মধ্যে এ পরিকল্পনা প্রণয়নের লক্ষ্যমাত্রা রয়েছে। আর ব্যাংক খাতে আইএফআরএস ৯-এর পূর্ণাঙ্গ বাস্তবায়ন করতে হবে ২০২৭ সালের মধ্যে। এটি বাস্তবায়নে আইএমএফের কাছে কারিগরি সহায়তাও চেয়েছে বাংলাদেশ।

জানতে চাইলে অ্যাসোসিয়েশন অব ব্যাংকার্স বাংলাদেশের (এবিবি) সাবেক চেয়ারম্যান আনিস এ খান বণিক বার্তাকে বলেন, ‘আমাদেরকে আন্তর্জাতিক রীতিনীতিতে ফিরে যেতেই হবে। তা না হলে আন্তর্জাতিক আর্থিক ব্যবস্থা থেকে আমরা পিছিয়ে যাব। তবে এটি বাস্তবায়নের আগে আমাদের নিজস্ব বাস্তবতা, মূল্যস্ফীতি ও টাকার অবমূল্যায়নের মতো বিষয়গুলোকে বিবেচনায় নিতে হবে।’

কেন্দ্রীয় ব্যাংকের তথ্যানুসারে, ২০২৪ সালের মার্চ শেষে ব্যাংক খাতে খেলাপি ঋণের পরিমাণ দাঁড়িয়েছে ১ লাখ ৮২ হাজার ২৯৫ কোটি টাকা। এর আগের বছর অর্থাৎ ২০২৩ সালের মার্চ শেষে খেলাপি ঋণ ছিল ১ লাখ ৩১ হাজার ৬২০ কোটি এবং ২০২২ সালের একই সময় শেষে ছিল ১ লাখ ১৩ হাজার ৪৪০ কোটি টাকা। সে হিসাবে দুই বছরের ব্যবধানে খেলাপি ঋণের পরিমাণ বেড়েছে প্রায় ৬১ শতাংশ। আইএমএফের কাছে খেলাপি ঋণ কমিয়ে আনার বিষয়েও প্রতিশ্রুতি দিয়েছে বাংলাদেশ। এক্ষেত্রে সার্বিকভাবে ব্যাংক খাতের খেলাপি ঋণ ৮ শতাংশে নামিয়ে আনার লক্ষ্যমাত্রা রয়েছে। এর মধ্যে ২০২৫-২৬ অর্থবছর শেষে রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংকের খেলাপি ঋণ ১০ শতাংশে এবং বেসরকারি বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলোর খেলাপি ঋণ ৫ শতাংশে নামিয়ে আনার কথা রয়েছে।

ব্যাংক খাতসংশ্লিষ্টরা বলছেন, ঋণ শ্রেণীকরণের ক্ষেত্রে ছাড় দেয়ার কারণে দেশের ব্যাংক খাতে আন্তর্জাতিক হিসাবমান পুরোপুরি বাস্তবায়িত হচ্ছে না। এটি বাস্তবায়ন করা হলে খেলাপি ঋণের পরিমাণ অনেক বেড়ে যাবে। পাশাপাশি বর্তমানে যেসব সম্পদকে ভালো দেখানো হচ্ছে সেগুলোর বড় একটি অংশ মন্দমানে চলে যাবে এবং এর বিপরীতে সঞ্চিতি সংরক্ষণ করতে হবে। এতে ব্যাংক খাতের আয় ও মুনাফাও কমে যাবে। তবে এটি বাস্তবায়িত হলে ব্যাংক খাতের প্রকৃত চিত্র উঠে আসবে, যা দীর্ঘমেয়াদে খাতটির জন্য হবে ইতিবাচক।

বাংলাদেশ সিকিউরিটিজ অ্যান্ড এক্সচেঞ্জ কমিশনের (বিএসইসি) সাবেক কমিশনার ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অ্যাকাউন্টিং অ্যান্ড ইনফরমেশন সিস্টেমস বিভাগের অধ্যাপক ড. মিজানুর রহমান বণিক বার্তাকে বলেন, ‘বর্তমানে বাংলাদেশ ব্যাংকের পক্ষ থেকে বিভিন্ন প্রবিধির মাধ্যমে আইএফআরএস ৯-এর বাস্তবায়নের বিষয়টি স্থগিত রাখা হয়েছে। এর মাধ্যমে দেশের ব্যাংক খাতের সম্পদ, মূলধন ও আয় স্ফীত দেখানো হচ্ছে। এতে ব্যাংক খাতের স্বচ্ছতাও প্রশ্নবিদ্ধ হচ্ছে। বৈশ্বিক আর্থিক ব্যবস্থা ও পুঁজিবাজারের সঙ্গে আমাদের সংযোগ বাড়াতে হলে আর্থিক প্রতিবেদন ও নিরীক্ষায় বৈশ্বিক মান বজায় রাখতে হবে। পুরো বিশ্বেই আইএফআরএস ৯ বাস্তবায়ন করা হয়েছে। এটি একটি বৈশ্বিক চর্চা। তাই আমাদের নিজেদের স্বার্থেই এটি বাস্তবায়ন করতে হবে।’

এই বিভাগের আরও খবর

আরও পড়ুন