বেসরকারি খাতে ন্যূনতম মাসিক মজুরি

সবচেয়ে বেশি স মিলে, সর্বনিম্ন হোটেল-রেস্তোরাঁয়

শেখ তৌফিকুর রহমান ও আনিকা মাহজাবিন

ছবি : বণিক বার্তা

মাসে বেতন মোটে ৪ হাজার টাকা। সংসারের প্রয়োজন মেটাতে গিয়ে প্রায়ই হিসাব মেলাতে পারেন না রবিউল (ছদ্মনাম)। কাজ করেন মিরপুর বেনারসি পল্লীর একটি নামকরা রেস্টুরেন্টে। বছর পঁয়ত্রিশের এ যুবক প্রতি মাসে বাড়িতে টাকা পাঠাতে পারবেন কিনা, তা নির্ভর করে রেস্টুরেন্টের ক্রেতাদের দেয়া টিপসের ওপর। 

রবিউলের মতো দেশের হোটেল-রেস্তোরাঁ শ্রমিক-কর্মচারীদের সবার গল্প কম-বেশি একই রকম। দেশের বেসরকারি খাতে মজুরি সবচেয়ে কম হোটেল-রেস্তোরাঁর শ্রমিক-কর্মচারীদেরই। সরকারের পক্ষ থেকে তাদের সর্বনিম্ন মজুরি নির্ধারণ করা আছে ৩ হাজার ৭১০ টাকা, যা ৩১ ডলার ৪৪ সেন্টের সমপরিমাণ (ডলারের বিনিময় হার ১১৮ টাকা ধরে)। শ্রম ও কর্মসংস্থান মন্ত্রণালয়ের তথ্য অনুযায়ী, সরকার গঠিত বোর্ড হোটেল-রেস্তোরাঁ শ্রমিকদের জন্য এ পরিমাণ সর্বনিম্ন মজুরি নির্ধারণ করে ঘোষণা দিয়েছিল ২০১৭ সালের মার্চে। এরপর আর তাদের মজুরি-ভাতা মূল্যায়ন-পুনর্মূল্যায়নের কোনো উদ্যোগ নেয়া হয়নি। 

সরকার নির্ধারিত মজুরি অনুযায়ী, একজন হোটেল-রেস্তোরাঁ শ্রমিকের সর্বনিম্ন বার্ষিক মজুরি দাঁড়ায় ৪৪ হাজার ৫২০ টাকায়, যা বর্তমান বিনিময় হারে ৩৭৭ ডলার ২৯ সেন্ট। বিশ্বব্যাংকের ২০২২ সালের নির্ধারিত সীমা অনুযায়ী, কারো দৈনিক আয় ২ ডলার ১৫ সেন্টের নিচে হলে তিনি দারিদ্র্যসীমার নিচে বসবাস করছেন বলে ধরে নেয়া হয়। আর নির্ধারিত সর্বনিম্ন মজুরিসীমা অনুযায়ী বাংলাদেশে হোটেল-রেস্তোরাঁ শ্রমিকদের সর্বনিম্ন দৈনিক মজুরি দাঁড়ায় ১ ডলার ৩ সেন্টের সমপরিমাণে।  

শ্রম ও কর্মসংস্থান মন্ত্রণালয়ের তথ্য অনুযায়ী, শ্রম আইন ২০০৬-এর ভিত্তিতে প্রতি পাঁচ বছর অন্তর বিভিন্ন খাতের ন্যূনতম মজুরি ঘোষণা করতে পারে সরকার। মন্ত্রণালয় এ পর্যন্ত ৪৩টি শিল্প খাতে ন্যূনতম মজুরি হার নির্ধারণ ও পুনর্নির্ধারণ করেছে। এর মধ্যে গত ১০ বছরে ঘোষণা হয়েছে ৩৩টি মজুরি কাঠামো। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, দেশের মূল্যস্ফীতি বিবেচনায় এসব মজুরি কাঠামোর এখনো অনেকটাই সেকেলে পর্যায়ের। এ মজুরি দিয়ে বিভিন্ন খাতের শ্রমিকরা যেমন কর্মজীবনে দুর্বিষহ সংগ্রাম করছেন, তেমনি পরিবার ও ভবিষ্যৎ নিয়ে পড়েছেন অনিশ্চয়তায়।

বর্তমানে দেশে ন্যূনতম মাসিক মজুরি সবচেয়ে বেশি নির্ধারণ করা রয়েছে স মিল বা করাত কলে। আর সবচেয়ে কম নির্ধারিত রয়েছে হোটেল ও রেস্তোরাঁ খাতে। ২০২২ সালের জুনে স মিলের শ্রমিক-কর্মচারীদের জন্য ন্যূনতম মজুরি নির্ধারণ করা হয় ১৭ হাজার ৯০০ টাকা, যা ১৫১ ডলার ৬৯ সেন্টের সমপরিমাণ। 

বাংলাদেশ স মিল শ্রমিক ফেডারেশনের সাধারণ সম্পাদক রজত বিশ্বাস বণিক বার্তাকে বলেন, ‘স মিল খাতের নতুন মজুরি কাঠামো ২০২২ সালে ঘোষণা হয়। তবে বর্তমান দ্রব্যমূল্য, মূল্যস্ফীতি হিসাব করলে এটা খুবই কম। দ্রব্যমূল্যের সঙ্গে সমন্বয় করে আমরা মহার্ঘ্য ভাতার কথা বলছি। আবার যে মজুরি কাঠামো ঘোষণা করা হয়েছে, সেটিও সবখানে কার্যকর না। ঢাকাসহ বড় বড় শহরে এ কাঠামো কার্যকর আছে। তবে মফস্বল অঞ্চলে তা মোটেও কার্যকর নয়। যদিও শ্রমিকদের কর্মক্ষেত্রে নিরাপত্তাহীনতা বেশি। বিশেষ করে স মিলের কর্মচারীরা প্রচণ্ড ঝুঁকির মধ্যে কাজ করেন। বিভিন্ন পরিসংখ্যানের মধ্য দিয়ে আমরা জেনেছি ৬০ শতাংশ শ্রমিক অঙ্গহানিসহ বিভিন্ন ক্ষয়ক্ষতির শিকার হন।’ 

রজত বিশ্বাসের সঙ্গে আলোচনার সূত্র ধরে কথা হয় মতিউর রহমান নামে এক স মিল কর্মচারীর সঙ্গে। শ্রীমঙ্গলের একটি স মিলে কাজ করছেন তিনি। বর্তমানে মাসিক ১৩ হাজার টাকা চুক্তিতে প্রতিষ্ঠানটিতে কর্মরত রয়েছেন তিনি। যদিও সরকার নির্ধারিত মজুরি কাঠামো অনুযায়ী তার বেতন ১৭ হাজার ৯০০ টাকা হওয়ার কথা। 

নিজের অভিজ্ঞতা তুলে ধরে মতিউর রহমান বণিক বার্তাকে বলেন, ‘প্রতিষ্ঠানের মালিক মাসে আমাকে ১৩ হাজার টাকা দেন। তবে প্রতিষ্ঠানের পক্ষ থেকে মাঝে মাঝে নাশতা করানো হয়। তাছাড়া কিছু বকশিশও পেয়ে থাকি। সরকার যে মজুরি কাঠামো নির্ধারণ করেছে, সেটা এখনো আমি পাচ্ছি না। তবে বেতন বাড়ানোর বিষয়ে মিল মালিকের সঙ্গে কথাবার্তা চলছে।’

বেসরকারি খাতে ন্যূনতম মজুরির দিক থেকে স মিলের পরই রয়েছে নির্মাণ ও কাঠ শ্রমিকরা। তাদের ন্যূনতম মাসিক মজুরি ধরা হয়েছে ১৬ হাজার ২৪০ টাকা (১৩৭ ডলার ৬২ সেন্ট)। 

জাহাজ ভাঙা শিল্পে শ্রমিকদের ন্যূনতম মজুরি ১৬ হাজার টাকা (১৩৫ ডলার ৬০ সেন্ট)। আর কর্মচারীরা পান ১৫ হাজার ১০০ টাকা (প্রায় ১২৮ ডলার)। 

জাহাজ ভাঙা শ্রমিক ট্রেড ইউনিয়নের আহ্বায়ক তপন দত্ত বণিক বার্তাকে বলেন, ‘বাংলাদেশের মজুরি বোর্ড যখন জাহাজ ভাঙা শিল্পের জন্য ৮ ঘণ্টা অনুযায়ী সর্বনিম্ন মজুরি ১৬ হাজার টাকা নির্ধারণ করেছিল, তখন সেটা কম ছিল না। এছাড়া সপ্তাহে সর্বোচ্চ ১২ ঘণ্টা ওভার টাইম করার আইন ছিল। কিন্তু ইয়ার্ড মালিকরা সে মজুরি তো বাস্তবায়ন করেননি। এমনকি শ্রম আইনে বলা নিয়মগুলোও তারা মানেননি।’

শ্রম ও কর্মসংস্থান মন্ত্রণালয়ের তথ্য অনুযায়ী, সবচেয়ে বেশি সর্বনিম্ন মজুরি পরিশোধকারী খাতগুলোর মধ্যে রাবার শিল্পের শ্রমিক-কর্মচারীদের জন্য নির্ধারিত সর্বনিম্ন মজুরি ১২ হাজার ৯১০ টাকা। গার্মেন্ট শিল্পে শ্রমিকদের জন্য তা ১২ হাজার ৫০০ টাকা। এ শিল্পে কর্মচারীদের জন্য নির্ধারিত সর্বনিম্ন মজুরি ১২ হাজার ৮০০ টাকা।

আন্তর্জাতিক শ্রম সংস্থার (আইএলও) সর্বশেষ প্রতিবেদন অনুযায়ী এশিয়া-প্রশান্ত মহাসাগরীয় অঞ্চলের দেশগুলোর মধ্যে ন্যূনতম মজুরি সবচেয়ে কম বাংলাদেশে। শুধু তা-ই নয়, এ অঞ্চলের মধ্যে একমাত্র বাংলাদেশেই খাতভিত্তিক ন্যূনতম মজুরি আন্তর্জাতিক দারিদ্র্যসীমার নিচের স্তরের চেয়েও কম।

দেশে সবচেয়ে কম সর্বনিম্ন মজুরি পরিশোধকারী খাতগুলোর মধ্যে হোটেল-রেস্তোরাঁর পরই রয়েছে দর্জি কারখানা, ম্যাচ কারখানা, অটোমোবাইল ওয়ার্কশপ, বেকারি, বিস্কুট ও কনফেকশনারি ইত্যাদি। এর মধ্যে দর্জি কারখানার শ্রমিক-কর্মচারীরা পান ৪ হাজার ৮৫০ টাকা, যা ৪১ ডলার ১০ সেন্টের সমান। ম্যাচ কারখানার শ্রমিক-কর্মচারী পান ৪ হাজার ৫৬০ টাকা (৩৮ ডলার ৬৪ সেন্ট)। অটোমোবাইল ওয়ার্কশপের শ্রমিক ও কর্মচারীরা পান যথাক্রমে ৫ হাজার ৯৩০ টাকা (৫০ ডলার ২৫ সেন্ট) ও ৭ হাজার ৬১০ টাকা (৬৪ ডলার ৪৯ সেন্ট)। বেকারি, বিস্কুট ও কনফেকশনারি শ্রমিক ও কর্মচারীরা পান যথাক্রমে ৫ হাজার ৯৪০ টাকা (৫০ ডলার ৩৩ সেন্ট) ও ৬ হাজার ৫০০ টাকা (৫৫ ডলার ৮ সেন্ট)।

এছাড়া বিড়ি শিল্পে শ্রমিকদের লেবেল প্যাকিংসহ প্রতি হাজার সাধারণ বিড়ি তৈরির জন্য ৪৫ টাকা ও ফিল্টারযুক্ত বিড়ির জন্য ৯০ টাকা সর্বনিম্ন মজুরি নির্ধারণ করা হয়েছে। চা বাগানগুলোর শ্রমিকদের মজুরি দেয়া হয় দৈনিক ভিত্তিতে। এক্ষেত্রে তাদের দৈনিক সর্বনিম্ন মজুরি ১৭০ টাকা (১ ডলার ৪৪ সেন্ট)। আর বাগানের কর্মচারীদের মজুরি হয় মাসিক ভিত্তিতে। এক্ষেত্রে সর্বনিম্ন নির্ধারিত মজুরি ১০ হাজার ২০ টাকা (৮৪ ডলার ৯১ সেন্ট)।

শ্রমিক নেতাদের ভাষ্যমতে, বেসরকারি খাতের সর্বোচ্চ কিংবা সর্বনিম্ন কোনো মজুরিই শ্রমিকদের মর্যাদাপূর্ণ জীবনযাপনের জন্য যথেষ্ট নয়। এ বেতন কাঠামোয় শ্রমিক-কর্মচারীদের চাহিদা পূরণ হচ্ছে না। এখন জরুরি ভিত্তিতে জাতীয় ন্যূনতম শ্রমিক মজুরি কাঠামো প্রয়োজন। 

এ বিষয়ে গার্মেন্ট শ্রমিক সংহতির সভাপ্রধান তাসলিমা আক্তার বণিক বার্তাকে বলেন, ‘বাংলাদেশ নিম্ন মধ্যম আয়ের দেশ থেকে মধ্যম আয়ের দেশে উত্তরণ ঘটলেও সাধারণ মানুষ এর সুফল পাচ্ছে না। এখানে সবচেয়ে বেশি বঞ্চিত হচ্ছে শ্রমিক-কর্মচারীরা। অথচ এ শ্রমিকরাই বাংলাদেশের উন্নয়নের প্রতিনিয়ত শ্রম দিচ্ছে যাচ্ছে। এখানে প্রধান বাধা হলো মজুরি কাঠামো। এ কাঠামোয় যে মজুরি দেয়ার কথা বলা হয়, তা দিয়ে কোনোভাবেই একজন শ্রমিকের মর্যাদাপূর্ণ জীবনযাপন করা সম্ভব না। যেখানে গার্মেন্ট কর্মীদের শ্রমে একটি টেকসই খাত বাংলাদেশে তৈরি হয়েছে, অথচ তারাও মর্যাদাপূর্ণ মজুরি পাচ্ছেন না; সেখানে অন্যদের মজুরির কথা তো ভাবাও যায় না। অথচ সরকার সরকারি কর্মকর্তা-কর্মচারীদের বেতন বাড়িয়েই চলেছে। এখন একটি জাতীয় ন্যূনতম বেতন কাঠামো ভীষণ জরুরি হয়ে পড়েছে, যার জন্য আমাদের সবাইকে সম্মিলিতভাবে কাজ করতে হবে।’

সার্বিক বিষয়ে জানতে চাইলে শ্রম ও কর্মসংস্থান প্রতিমন্ত্রী মো. নজরুল ইসলাম চৌধুরী বণিক বার্তাকে বলেন, ‘আস্তে আস্তে আমরা পুরো শ্রম আইনে পরিবর্তন আনছি। আগামী সংসদে শ্রম আইন পরিবর্তন করে পাস করব। ওখানে শ্রম মজুরি কাঠামোয় যেসব পরিবর্তন প্রয়োজন সেগুলো যাচাই-বাছাই সাপেক্ষে আমরা পরিবর্তন করব।’

এই বিভাগের আরও খবর

আরও পড়ুন