দুই প্রান্তে সংযোগ নেই অলস পড়ে আছে পদ্মা সেতুর গ্যাস পাইপলাইন

শামীম রাহমান ও আবু তাহের

পদ্মা সেতুতে গ্যাস পাইপলাইনে ব্যয় প্রায় ২৭৪ কোটি টাকা ছবি: সংগৃহীত

দেশের দক্ষিণ ও দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলে পাইপলাইনের মাধ্যমে গ্যাসের সংযোগ দিতে চায় সরকার। মূল উদ্দেশ্য গ্যাসভিত্তিক বিদ্যুৎ কেন্দ্র, সার কারখানা, বাণিজ্যিক ও শিল্পপ্রতিষ্ঠানগুলোয় গ্যাস সরবরাহ। এ লক্ষ্যে পদ্মা সেতুতে বসানো হয়েছে ৬ দশমিক ১৫ কিলোমিটার গ্যাস পাইপলাইন। ব্যয় হয়েছে ২৭৪ কোটি টাকার বেশি। তবে সেতুর দুই প্রান্তে সংযোগ না থাকায় পাইপলাইনটি কোনো কাজেই আসছে না, দুই বছরের বেশি সময় ধরে অলস পড়ে আছে। 

৩২ হাজার ৬০৫ কোটি টাকা ব্যয়ে নির্মিত পদ্মা সেতুতে যানবাহন চলাচল শুরু হয় ২০২২ সালের ২৬ জুন থেকে। এরও প্রায় তিন মাস আগে সম্পন্ন হয় গ্যাস পাইপলাইনের নির্মাণকাজ। যদিও সেটি রাষ্ট্রায়ত্ত গ্যাস সঞ্চালনকারী সংস্থা গ্যাস ট্রান্সমিশন কোম্পানি লিমিটেডের (জিটিসিএল) কাছে হস্তান্তর করা হয় ২০২৩ সালে। 

এ বিষয়ে জানতে চাইলে বাংলাদেশ সেতু কর্তৃপক্ষের প্রধান প্রকৌশলী কাজী মো. ফেরদাউস বণিক বার্তাকে বলেন, ‘‌নির্মাণকাজ শেষ করে আমরা গ্যাস পাইপলাইনটি জিটিসিএলের কাছে হস্তান্তর করেছি। এটির সব দায়-দায়িত্ব এখন তাদের। তারাই এর রক্ষণাবেক্ষণ করবে। তবে পদ্মা সেতুর ওপরে থাকা গ্যাস পাইপলাইনটির মালিকানা সেতু কর্তৃপক্ষের কাছেই থাকবে। এটি ব্যবহারের জন্য জিটিসিএলের কাছ থেকে ট্যারিফ আদায় করবে সেতু কর্তৃপক্ষ। এজন্য আলাপ-আলোচনা শুরু হয়েছে।’

পদ্মা সেতুর ওপর নির্মিত ৭৬২ মিলিমিটার গ্যাস পাইপলাইনটি এরই মধ্যে জিটিসিএলের নেটওয়ার্কে যুক্ত হয়েছে। এর রক্ষণাবেক্ষণও করছে সংস্থাটি। এখন দক্ষিণাঞ্চলে গ্যাস সরবরাহের জন্য দুই প্রান্তে ১১০ কিলোমিটার দীর্ঘ পাইপলাইন তৈরির উদ্যোগ নেয়া হয়েছে। পরিকল্পনাধীন এ পাইপলাইনটি কুমিল্লার লাঙ্গলবন্দ থেকে শুরু হয়ে মাওয়া এসে যুক্ত হবে পদ্মা সেতুর পাইপলাইনে। সেতু পার হয়ে জাজিরা থেকে লাইনটি টেকেরহাট হয়ে চলে যাবে গোপালগঞ্জ পর্যন্ত। প্রাথমিক প্রাক্কলন অনুযায়ী, এ সঞ্চালন লাইন নির্মাণে খরচ হতে পারে ২ হাজার ৩৬০ কোটি টাকা। বর্তমানে প্রকল্পটি বাস্তবায়নের জন্য একটি সমীক্ষা পরিচালনা করলেও প্রয়োজনীয় অর্থের সংস্থান করতে পাচ্ছে না জিটিসিএল।

জিটিসিএলের ব্যবস্থাপনা পরিচালক শাহনেওয়াজ পারভেজ বণিক বার্তাকে বলেন, ‘সেতু কর্তৃপক্ষ পাইপলাইনটি আমাদের হস্তান্তর করেছে। এখন সেটির যেসব রক্ষণাবেক্ষণের প্রয়োজন হচ্ছে সেগুলো আমরাই করছি।’

তবে পদ্মা সেতুর সংযোগ গ্যাস পাইপলাইনের কাজ কবে নাগাদ শুরু হবে, এমন প্রশ্নে কোনো দিনক্ষণ জানাতে পারেননি জিটিসিএলের ব্যবস্থাপনা পরিচালক শাহনেওয়াজ পারভেজ। তিনি বলেন, ‘‌প্রকল্পটিতে অর্থায়নের জন্য আমরা মন্ত্রণালয়ে পাঠিয়েছিলাম। কিন্তু এখন পর্যন্ত মন্ত্রণালয় থেকে কোনো সাড়া পাওয়া যায়নি। এখন অর্থায়নটাই হলো মূল সমস্যা। এখানে এশীয় উন্নয়ন ব্যাংক (এডিবি) অর্থায়ন করবে, নাকি বাংলাদেশ সরকার করবে, সে সম্পর্কে আমরা কোনো সুনির্দিষ্ট দিকনির্দেশনা পাইনি।’

এমন পরিপ্রেক্ষিতে আপাতত পদ্মা সেতুর ওপর নির্মিত গ্যাস পাইপলাইনটি ব্যবহার করা সম্ভব হচ্ছে না উল্লেখ করে শাহনেওয়াজ পারভেজ বলেন, ‘‌পদ্মা সেতু বা এ ধরনের বড় বড় অবকাঠামো তৈরির ক্ষেত্রে সুদূরপ্রসারী পরিকল্পনা করতে হয়। ভবিষ্যতে পদ্মা সেতুর ওপর দিয়ে গ্যাস সঞ্চালন যেন করা যায়, সে জন্যই এ পাইপলাইনটি তৈরি করে রাখা হয়েছে। এখন লাঙ্গলবন্দ থেকে মাওয়া, মাওয়ার পর পদ্মা সেতু, পদ্মা সেতু পার হয়ে জাজিরা থেকে গোপালগঞ্জ—এ পর্যন্ত গ্যাস সঞ্চালন লাইন হবে। এখন পদ্মা সেতুর ওপরে লাইনটি বানানো আছে। যদি আমরা অর্থায়ন পাই অথবা সরকার যদি প্রকল্পটিতে প্রাধান্য দেয়, তাহলে আমরা দ্রুতই পাইপলাইনটি তৈরি করে ফেলতে পারব।’ 

লাঙ্গলবন্দ-গোপালগঞ্জ পাইপলাইনই নয় কেবল, দেশের দক্ষিণ ও দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলে গ্যাস সংযোগ দিতে জিটিসিএলের আরো পাঁচটি প্রকল্প পরিকল্পনাধীন রয়েছে, যেগুলোয় গ্যাস সরবরাহ করা হবে পদ্মা সেতুর গ্যাস পাইপলাইন দিয়ে। প্রকল্পগুলো হলো পায়রা-বরিশাল ও বরিশাল-খুলনা সঞ্চালন লাইন, টেকেরহাট-ফরিদপুর ও টেকেরহাট-বরিশাল সঞ্চালন লাইন, খুলনা-গোপালগঞ্জ-টেকেরহাট সঞ্চালন লাইন, ভোলা-বরিশাল সঞ্চালন লাইন ও সাতক্ষীরা-খুলনা সঞ্চালন লাইন। প্রকল্পগুলোর মাধ্যমে নির্মাণ করা হবে ৫৮২ কিলোমিটার গ্যাস সঞ্চালন লাইন। খরচ হবে প্রায় সাড়ে ৯ হাজার কোটি টাকা। ২০৩৪ সালের মধ্যে এগুলোর কাজ শেষ করার লক্ষ্য থাকলেও এখন পর্যন্ত কোনোটিতেই অর্থায়ন নিশ্চিত করতে পারেনি জিটিসিএল।

জ্বালানি বিশেষজ্ঞরা যদিও সরকারের এসব গ্যাস পাইপলাইন নির্মাণ পরিকল্পনার কোনো যৌক্তিকতা দেখেন না। এ সম্পর্কে জানতে চাইলে বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের (বুয়েট) অধ্যাপক ম. তামিম বণিক বার্তাকে বলেন, ‘গ্যাসের সঞ্চালন পাইপলাইনের এসব প্রকল্প সরকারের অযৌক্তিক ও সমন্বয়হীন পরিকল্পনা। উন্নয়নকে ঘিরে যদি এসব প্রকল্প নেয়া হয়, তাহলে সমন্বয়ের মাধ্যমে এসব প্রকল্প বাস্তবায়ন করতে হবে। গ্যাসের নতুন সঞ্চালন লাইনে একদিকে যেমন গ্যাস দেয়া যাচ্ছে না, তেমনি সঞ্চালন লাইনের অভাবে বিদ্যুৎ কেন্দ্র বসিয়ে রাখা হচ্ছে। এছাড়া স্থানীয় গ্যাসের উৎসের বাড়তি জোগান নেই। এলএনজিকে কেন্দ্র করে পাইপলাইনে বিপুল অংকের বিনিয়োগ আর্থিকভাবে ফলপ্রসূ হবে না। এতে জ্বালানি বিভাগের চাপ আরো বাড়বে।’

অন্যদিকে দুই বছরের বেশি সময় ধরে পদ্মা সেতুর গ্যাস সঞ্চালন পাইপলাইনটি অলস পড়ে থাকার কারণ হিসেবে প্রকল্পগুলো বাস্তবায়নে সমন্বয়হীনতাকে দায়ী করছেন অবকাঠামো বিশেষজ্ঞরা। এ সম্পর্কে জানতে চাইলে বুয়েটের পুরকৌশল বিভাগের অধ্যাপক ড. হাদিউজ্জামান বণিক বার্তাকে বলেন, ‘আমরা কতটা গ্যাস উৎপাদন করি, কতটা আমদানি করি তার ভিত্তিতে সরবরাহ পরিকল্পনা করা উচিত। দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলে প্রায় এক ডজন অর্থনৈতিক অঞ্চলের কথা বলা হচ্ছে। সেখানে গ্যাস সরবরাহের সক্ষমতা আমাদের রয়েছে কিনা সেটাও দেখা উচিত। সামগ্রিকভাবে আমি বলব, পদ্মা সেতুর গ্যাস পাইপলাইন নির্মাণে সমন্বয় বা পরিকল্পনার ঘাটতি নিঃসন্দেহে আছে। পদ্মা সেতুর গ্যাস পাইপলাইনে আমাদের কিন্তু মোটা অংকের বিনিয়োগ হয়েছে। যদিও এর সুফল প্রলম্বিত হয়ে যাচ্ছে। এর বদলে তাৎক্ষণিকভাবে সুফল পাওয়া যাবে, এমন প্রকল্পে বিনিয়োগ করলে তা বাংলাদেশের অর্থনীতির জন্য বেশি ভালো হতো।’

এই বিভাগের আরও খবর

আরও পড়ুন