১৯৯১ সালের নির্বাচন: নিন্দিত এরশাদ, নন্দিত এরশাদ

আনিকা মাহজাবিন

ছবি : বণিক বার্তা

দীর্ঘ আন্দোলনের পর গণঅভ্যুত্থানের মুখে ১৯৯০ সালে ক্ষমতাচ্যুত হন তৎকালীন রাষ্ট্রপতি হুসেইন মুহম্মদ এরশাদ। এর পরই কারাবরণ করতে হয় তাকে। এর আগে ক্ষমতায় থাকাকালে দুটি নির্বাচনের আয়োজন করেছিলেন তিনি। দুটি নির্বাচন নিয়েই বেশ প্রশ্ন উঠেছিল। তার পতনের পর ১৯৯১ সালের জাতীয় নির্বাচনটি সুষ্ঠু ও সব মহলে গ্রহণযোগ্য হওয়া নিয়ে বেশ প্রত্যাশা তৈরি হয়। একই সঙ্গে আশঙ্কা তৈরি হয় এরশাদের দল জাতীয় পার্টির ভবিষ্যৎ নিয়েও। 

নির্বাচনে কারাবন্দি অবস্থায় রংপুরের পাঁচটি আসন থেকে ভোটে লড়েন এরশাদ। সবক’টিতেই জয়ী হন তিনি। তার দল জাতীয় পার্টি আসন পায় ৩৫টি। ওই নির্বাচনে মোট ভোটারের ১১ দশমিক ৯২ শতাংশ ভোট দিয়েছিল জাতীয় পার্টিকে। সেবার ১৪০টি আসন পেয়ে ক্ষমতায় আসে বিএনপি। আর আওয়ামী লীগ জয় পায় ৮৮ আসনে। জামায়াতে ইসলামী পেয়েছিল ১৮টি আসন।

হুসেইন মুহম্মদ এরশাদের ক্ষমতাচ্যুতি ও ১৯৯১ সালের নির্বাচন প্রসঙ্গে জানতে চাইলে তার ছোট ভাই এবং জাতীয় পার্টির বর্তমান চেয়ার‍ম্যান গোলাম মোহাম্মদ (জিএম) কাদের বণিক বার্তাকে বলেন, ‘গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠার জন্য রাষ্ট্রপতি জেনারেল এরশাদ ১৯৯০ সালে ক্ষমতা ছেড়ে দেন। যাকে গণঅভ্যুত্থান বলে অপপ্রচার চালানো হয়। সে সময় যাদের স্বার্থে আঘাত লেগেছিল তারাই এরশাদের বিরুদ্ধে আন্দোলন করার জন্য অর্থ প্রদানসহ নানাভাবে সহায়তা করেছিল। এর সঙ্গে সে সময় ক্ষমতার আশপাশে থাকা ব্যক্তিদের একাংশ জড়িত ছিল, সবাই না। তাদের কথা শুনে এরশাদ সরল বিশ্বাসে নির্বাচনের জন্য ক্ষমতা ছাড়েন। ওই মানুষগুলো তাদের কথা তো রাখেইনি উল্টো উনাকে কারাবন্দি করে। এর পরও সেই অবস্থায় তিনি নির্বাচনে যান। পোস্টার লাগানো থেকে শুরু করে কোনো ধরনের প্রচার-প্রচারণা তখন জাতীয় পার্টি করতে পারেনি। এমন পরিস্থিতিতে তিনি পাঁচটি আসনেই জয়ী হন। মূলত এরশাদের জনপ্রিয়তার জন্যই মামলাসহ নানাভাবে তাকে হয়রানি করা হয়।’ 

তিনি আরো দাবি করেন, ‘হুসেইন মুহম্মদ এরশাদ জনমানুষের কাছে বরাবরই জনপ্রিয় ছিলেন। জনগণের কাছে তার গ্রহণযোগ্যতা ছিল আমৃত্যু। শুধু নিজের এলাকা রংপুর নয়, ঢাকা কিংবা সিলেট যখনই যে আসন থেকে নির্বাচনে দাঁড়িয়েছিলেন, সেটিতেই জয়লাভ করেছেন। তবে ক্ষমতা অপব্যবহারকারী কিছু মানুষের কাছে তিনি অপছন্দের ব্যক্তি হয়ে উঠেছিলেন। কিন্তু সাধারণ মানুষের ভালোবাসা সবসময়ই পেয়েছিলেন।’

বাংলাদেশের রাজনৈতিক অর্থনীতির ইতিহাসে এরশাদের শাসনামল তথা আশির দশকটি চিহ্নিত হয়ে আছে ব্যাপকমাত্রার বিরাষ্ট্রীকরণ ও বাজারকেন্দ্রিক উদারীকরণের উত্থানপর্ব হিসেবে। তার আমলে শিল্প উৎপাদনের ভরকেন্দ্র রাষ্ট্রায়ত্ত খাত থেকে সরে আসে ব্যক্তি খাতে। রাষ্ট্রীয় পৃষ্ঠপোষকতায় উত্থান ঘটে এক নব্য ধনিক শ্রেণীর। 

এরশাদ সরকারের আমলে প্রধানমন্ত্রীর দায়িত্ব পালন করা মওদুদ আহমদ এ নিয়ে পরে লিখেছিলেন, ‘এরশাদ দেশের অর্থনৈতিক নীতিমালাকে উদারপন্থী করে তোলেন। সে সময় সরকারি নিয়ন্ত্রণ ও বিধিনিষেধ তুলে নেয়া এবং নিয়ন্ত্রণহীনতা অর্থনীতির মূল নিয়ামক হয়ে দাঁড়ায়।’ 

একের পর এক রাষ্ট্রায়ত্ত শিল্পপ্রতিষ্ঠানকে ব্যক্তিমালিকানায় ছেড়ে দিয়েছিলেন হুসেইন মুহম্মদ এরশাদ। প্রত্যক্ষদর্শী অর্থনীতিবিদদের ভাষ্যমতে, শিল্প খাতের দ্রুত ও বাছবিচারহীন বিরাষ্ট্রীয়করণ করতে গিয়ে সে সময় জনগণের সম্পদ নামমাত্র মূল্যে শিল্পপতিদের হাতে তুলে দেয়া হয়েছিল। এতে শিল্প খাতের অগ্রগতির বদলে শিল্পপতিদের পকেট ভারী হয়েছিল বেশি। অনেক ক্ষেত্রে দেখা যায়, শিল্পপ্রতিষ্ঠানের মালিকানা হস্তান্তরকালীন মূল্য পরিশোধের পর কিস্তিতে প্রদেয় মূল্যের এক টাকাও পরিশোধ করেননি শিল্পপতিরা। ১৯৮৭ সালের ৩০ জুনের এক হিসাব অনুযায়ী, ১৯৭৭ থেকে ১৯৮৬ সাল পর্যন্ত বিরাষ্ট্রীয়কৃত ৪৮২টি শিল্প ইউনিটের ৪০ শতাংশেরই কিস্তিমূল্য পরিশোধ হয়নি।

শিল্পায়নকে গতিশীল করতে বেসরকারি খাতে ঋণের প্রবাহ বাড়ানো হয়। এজন্য সে সময়কার সরকারি দুটি ব্যাংক পূবালী ও উত্তরা ব্যাংককে বিরাষ্ট্রীয়করণের পাশাপাশি নতুন বেশকিছু বেসরকারি ব্যাংককেও কার্যক্রম চালানোর অনুমোদন দেয়া হয়। ঋণের প্রবাহ অবাধ ও সহজ হয়ে পড়ায় ব্যাংক খাতে ঋণ খেলাপের মাত্রা দাঁড়ায় আশঙ্কাজনক পর্যায়ে। এর সুযোগ নিয়ে গোটা ব্যাংক খাতকে কুক্ষিগত করে ফেলে অল্প কয়েকটি পরিবার বা প্রতিষ্ঠান, যাদের প্রায় সবক’টিই ছিল ঋণখেলাপি। সে সময় অর্থনৈতিক সংস্কারের মূল সুফলগুলো ভোগ করেছেন মূলত ক্ষমতার কাছাকাছি থাকা ব্যক্তিরাই। 

বিশেষজ্ঞরা বলছেন, এরশাদ সরকারের সংস্কার কর্মসূচি আর্থিক খাতের অগ্রাধিকারগুলোকে রীতিমতো বদলে দিয়েছিল। শিল্পায়নে ঋণপ্রবাহ বাড়াতে স্থাপন করা হয় বিশেষায়িত ব্যাংক। বিতরণকৃত ঋণের টাকা আদায়ের বদলে নতুন করে ঋণ বিতরণের ওপর জোর দিয়ে সাজানো হয় ব্যাংক খাতের প্রণোদনা কর্মসূচি। এতে বিনিয়োগ ও শিল্পায়ন বাড়লেও আর্থিক খাতে শুরু হয় বিশৃঙ্খলা। ওই সময়ই দেশের আর্থিক খাতের জন্য দুরারোগ্য ব্যাধি হয়ে দেখা দেয় ঋণ খেলাপ। ১৯৯০ সালের ৩০ জুনের এক হিসাব অনুযায়ী, সে সময় ব্যক্তি খাতে বিশেষায়িত ব্যাংকগুলোর মোট ঋণ খেলাপের পরিমাণ ছিল ১ হাজার ১০০ কোটি টাকা। সে সময় ঋণগ্রহীতাদের ৯৬ শতাংশই চিহ্নিত হয়েছেন খেলাপি হিসেবে। 

তবে তার বেশকিছু সংস্কার কর্মসূচি এক সময় বেশ প্রশংসাও পেয়েছিল। আশির দশকে গৃহীত বিভিন্ন সংস্কার কর্মসূচির মধ্যে সবচেয়ে উচ্চাভিলাষী ধরা হয় স্থানীয় সরকার ব্যবস্থার বিনির্মাণকে। ‘স্থানীয় সরকার অধ্যাদেশ ১৯৭৬’-এ সংশোধনী এনে ১৯৮০ সালে চালু করা হয় ‘স্বনির্ভর গ্রাম সরকার’ ব্যবস্থা। এর মধ্য দিয়ে নির্বাচিত জনপ্রতিনিধিদের হাতে নিজ নিজ এলাকায় গৃহীত সরকারি উন্নয়ন প্রকল্পে পূর্ণ নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠার ক্ষমতা তুলে দেয়া হয়। একই সঙ্গে খুলে যায় গ্রামীণ উন্নয়ন ও পরিকল্পনা বাস্তবায়নের পথও। 

মেজর (অব.) মনজুর কাদের জাতীয় পার্টির আমলে পানিসম্পদ উন্নয়ন প্রতিমন্ত্রীর দায়িত্ব পালন করেছিলেন। সে সময়কার পটভূমি সম্পর্কে জানতে চাইলে বণিক বার্তাকে তিনি বলেন, ‘এরশাদ মূলত উন্নয়নের রাজনীতিতে গুরুত্ব দিয়েছিলেন। কিন্তু শুধু উন্নয়ন দিয়ে তো রাজনীতি হয় না। ক্ষমতা গ্রহণের পর প্রথমদিকে সবার সঙ্গে আলোচনা করে সিদ্ধান্ত নিতেন জেনারেল এরশাদ। কিন্তু সময় যত গড়াতে থাকে, ততই তার মধ্যে নিজে একা সিদ্ধান্ত নেয়ার প্রবণতা বৃদ্ধি পেতে থাকে। সেই সঙ্গে বাড়তে থাকে ক্ষমতাকে আঁকড়ে ধরে রাখার প্রবণতাও। ১৯৮৬ সালের নির্বাচনের পর তিনি আরো পাঁচ বছর ক্ষমতা ধরে রাখতে চাইলেন। জেনারেল এরশাদের মূল সমস্যা হলো তিনি একাই ক্ষমতা উপভোগ করতে চাইতেন। এরশাদের ক্ষমতা যত দীর্ঘায়িত হয়েছে, তার সাইকোফ্যান্সিটাও তত বেড়েছে।’

হুসেইন মুহম্মদ এরশাদ ক্ষমতা গ্রহণের পর ১৯৮৬ সালে প্রথমবারের মতো জাতীয় সংসদ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়। সে নির্বাচনে আওয়ামী লীগ ও জামায়াতে ইসলামী অংশ নিলেও আন্দোলনের মুখে পরের বছরই ভেঙে যায় এ সংসদ। এরপর ১৯৮৮ সালে পুনরায় নির্বাচন দেন তিনি। কিন্তু মূলধারার দলগুলোর বয়কটের মুখে সেটিও বেশিদিন টেকেনি। আওয়ামী লীগ, বিএনপি ও বামপন্থী দলগুলোর সম্মিলিত গণআন্দোলনের মুখে ১৯৯০ সালের ৬ ডিসেম্বর ক্ষমতা ছেড়ে দেন হুসেইন মুহম্মদ এরশাদ। আর তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে পঞ্চম জাতীয় সংসদ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয় ১৯৯১ সালের ২৭ ফেব্রুয়ারি।

এই বিভাগের আরও খবর

আরও পড়ুন