এক্সপ্রেসওয়ের কাজ বন্ধ রেখে আদালতে তিন ঠিকাদার

সুদের কিস্তি পরিশোধে ব্যর্থতা থেকেই জটিলতার সূত্রপাত

শামীম রাহমান

গতি হারিয়েছে ঢাকা এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ের নির্মাণকাজ ছবি: নিজস্ব আলোকচিত্রী

ঢাকা এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ের নির্মাণকাজ প্রায় পাঁচ মাস ধরে গতি হারিয়েছে। আগামী ৩০ জুন প্রকল্পটি শেষ করার জন্য মেয়াদ নির্ধারিত থাকলেও চার ভাগের এক ভাগ কাজই এখনো বাকি। মাঠপর্যায়ে নির্মাণকাজ বন্ধ রেখে এখন আদালতে ব্যস্ত সময় পার করছেন প্রকল্পের তিন ঠিকাদার। মূলত ঋণের বিপরীতে প্রদেয় সুদের একটি কিস্তি পরিশোধে ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান ইতাল-থাইয়ের ব্যর্থতা থেকেই এ জটিলতার সূত্রপাত।

ঢাকার হযরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর থেকে যাত্রাবাড়ীর কুতুবখালী পর্যন্ত প্রায় ২০ কিলোমিটার দীর্ঘ উড়ালসড়কটি নির্মাণে থাইল্যান্ডভিত্তিক ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান ইতাল-থাই ডেভেলপমেন্ট কোম্পানির সঙ্গে চুক্তি করে বাংলাদেশ সরকার। ২০১১ সালের ১৯ জানুয়ারি হওয়া ওই চুক্তি অনুযায়ী, সরকারি-বেসরকারি অংশীদারত্ব পদ্ধতিতে এক্সপ্রেসওয়ের নকশা প্রণয়ন ও অবকাঠামো নির্মাণের জন্য ১ দশমিক ১৩ বিলিয়ন ডলার বিনিয়োগ করবে ইতাল-থাই। অন্যদিকে জমি অধিগ্রহণ, প্রকল্প এলাকায় বিভিন্ন পরিষেবা লাইন স্থানান্তর এবং ক্ষতিগ্রস্তদের পুনর্বাসনে বাংলাদেশ সরকার বিনিয়োগ করছে ৪ হাজার ৯১৭ কোটি টাকা। ঢাকার প্রথম দ্রুতগতির উড়ালসড়কটি বাস্তবায়নের জন্য গঠন করা হয়েছে ‘ফার্স্ট ঢাকা এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ে’ নামে একটি কোম্পানি। শুরুতে এ কোম্পানির শতভাগ মালিকানা ছিল ইতাল-থাইয়ের হাতে।

প্রকল্পটি বাস্তবায়ন হচ্ছে বাংলাদেশ সেতু কর্তৃপক্ষের তত্ত্বাবধানে। সংস্থাটির তথ্য বলছে, অর্থের অভাবে শুরু থেকেই প্রকল্পের কাজ ঠিকমতো এগিয়ে নিতে পারছিল না ইতাল-থাই। পরে ২০১৯ সালে এক্সিম ব্যাংক চায়না ও ইন্ডাস্ট্রিয়াল অ্যান্ড কমার্শিয়াল ব্যাংক অব চায়নার (আইসিবিসি) কাছ থেকে ৮৬১ মিলিয়ন ডলার ঋণ নেয় প্রতিষ্ঠানটি। ঋণের সুদহার ৭ শতাংশ, যা পরিশোধ করতে হবে ১৭ বছরে। আর এ ঋণের বিনিময়ে ইতাল-থাই এক্সপ্রেসওয়ে কোম্পানির ৪৯ শতাংশ শেয়ার চীনের ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান শ্যাংডং সিএসআই (৩৪ শতাংশ) ও সিনোহাইড্রো করপোরেশনের কাছে ১৫ শতাংশ বিক্রি করে দেয়। বর্তমানে ইতাল-থাইয়ের কাছে ফার্স্ট ঢাকা এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ে কোম্পানির ৫১ শতাংশ শেয়ার রয়েছে।

চীনের এক্সিম ব্যাংক ও আইসিবিসির সঙ্গে করা ঋণ চুক্তি অনুযায়ী, ঢাকা এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ে নির্মাণের জন্য এখন পর্যন্ত ১২ কিস্তিতে ৪৬৭ দশমিক ৩২ মিলিয়ন ডলার ছাড় করা হয়েছে। এর বিপরীতে ২০২৩ সালের জুলাই পর্যন্ত নিয়মিত সুদ পরিশোধ করে এসেছে তিন ঠিকাদার। তবে চলতি বছরের জানুয়ারিতে সুদের একটি কিস্তি পরিশোধে ব্যর্থ হয় ইতাল-থাই। এখান থেকেই শুরু হয় জটিলতা। সুদ পরিশোধে ব্যর্থ হওয়ায় চলতি বছরের জানুয়ারি থেকে ঋণের টাকা ছাড় করা বন্ধ রেখেছে এক্সিম ব্যাংক ও আইসিবিসি। ফলে অর্থ সংকটের কারণে এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ের কাজ এখন বলতে গেলে প্রায় বন্ধ।

চীনের ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানগুলো বলছে, চুক্তি অনুযায়ী এক্সিম ব্যাংক ও আইসিবিসি চায়, ইতাল-থাই তাদের শেয়ার শ্যাংডং ও সিনোহাইড্রোর কাছে হস্তান্তর করুক। অন্যথায় ঋণের অর্থ আর ছাড় করবে না ব্যাংক দুটি। অন্যদিকে ফার্স্ট ঢাকা এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ে কোম্পানির শেয়ার হস্তান্তর ঠেকাতে আদালতের দ্বরস্থ হয়েছে ইতাল-থাই। এর পরিপ্রেক্ষিতে প্রধান বিচারপতি ওবায়দুল হাসানের নেতৃত্বাধীন আট সদস্যের আপিল বিভাগের পূর্ণাঙ্গ বেঞ্চ ৩০ মে পর্যন্ত কোম্পানির শেয়ার হস্তান্তরের ওপর স্থিতাবস্থা বজায় রাখার আদেশ দিয়েছেন।

ইতাল-থাইয়ের আইনজীবীদের দাবি, অসৎ উদ্দেশ্যে চীনের দুই ব্যাংক ঋণের অর্থ ছাড় করা বন্ধ রেখেছে। এ বিষয়ে জানতে চাইলে ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানটির আইনজীবী মোহাম্মদ ইমতিয়াজ ফারুক বণিক বার্তাকে বলেন, ‘‌আমার ধারণা, ঋণদাতা ব্যাংকগুলোর অসৎ উদ্দেশ্য আছে। তারা হয়তো আমাদের টাকা দেবে না। সেজন্য আমরা আমেরিকার একটি ব্যাংকের সঙ্গে আলাপ-আলোচনা শুরু করেছি। তারা আমাদের ৫০০ মিলিয়ন ডলার ঋণ দেয়ার প্রতিশ্রুতিও দিয়েছে। ওই টাকা এনে আমরা এ প্রকল্প থেকে চীনের দুই ব্যাংককে বিদায় করে দেব। এটাই আমাদের পরিকল্পনা।’

প্রকল্পের কাজে ধীরগতির জন্য চীনের দুই ব্যাংককে দায়ী করে তিনি বলেন, ‘‌ওরা একটা অজুহাত পেলেই টাকা ছাড় বন্ধ করে দেয়। তাদের কারণেই প্রকল্পটি পিছিয়ে যাচ্ছে। এজন্যই আমরা ঋণদাতা ব্যাংকগুলোকে পরিবর্তন করে নিতে চাই।’

কিস্তি পরিশোধে ব্যর্থতার বিষয়ে জানতে চাইলে ইতাল-থাইয়ের আইনজীবী ইমতিয়াজ ফারুক বলেন, ‘এটাকে আসলে কিস্তি মিস করা বলা যায় না। কারণ ঋণদাতার তো পেমেন্ট করার কথা। তারা যখন পেমেন্ট করেনি তখন আমরা বলেছি, কিস্তির টাকা তোমরা ওখান খেকে অ্যাডজাস্ট করে নাও। এখানে আগে কন্ট্রাক্টর নিজের টাকা দিয়ে কাজ করে। যখন করা শেষ হয়, তারপর ঋণদাতা ব্যাংকের অ্যাডভাইজার এটা সার্টিফাই করে। তারপরে গিয়ে বিল সাবমিট হয়। এখানে অ্যাডাভাইজার কিন্তু আমাদের সার্টিফাই করেই দিয়েছে। তারা যদি ঋণের টাকা থেকে সুদের কিস্তি কেটে রাখে, তাহলে তো কিস্তি বাকি থাকার কথা না।’ এর পরও শ্যাংডং ও সিনোহাইড্রো হাতিরঝিল অংশের কাজ বন্ধ করে দিয়ে ইতাল-থাইয়ের ওপর চাপ প্রয়োগ করছে বলে দাবি করেন তিনি।

সরকারি-বেসরকারি অংশীদারত্বের ভিত্তিতে ঢাকা এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ে নির্মাণে ব্যয় হচ্ছে ৮ হাজার ৯৪০ কোটি টাকা। তিন ধাপে বাস্তবায়ন হচ্ছে নির্মাণকাজ। প্রথম ধাপ বিমানবন্দর-বনানী অংশের অগ্রগতি ৯৯ দশমিক ৮৭ শতাংশ। দ্বিতীয় ধাপ বনানী-মগবাজার অংশের অগ্রগতি ৭৮ দশমিক ৭৬ শতাংশ। শেষ ধাপ মগবাজার-কুতুবখালী অংশের অগ্রগতি ১২ দশমিক শূন্য ৫ শতাংশ। চলতি বছরের এপ্রিল পর্যন্ত প্রকল্পটির সার্বিক অগ্রগতি হয়েছে ৭৪ দশমিক ২৩ শতাংশ। বর্তমানে এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ের বিমানবন্দর থেকে কারওয়ান বাজার পর্যন্ত অংশে যানবাহন চলাচল করছে। তবে কোম্পানির মালিকানা নিয়ে ঠিকাদারদের চলমান বিরোধের কারণে প্রকল্পটির নির্মাণকাজে দেখা দিয়েছে ধীরগতি। অর্থের অভাবে বিভিন্ন পয়েন্টে প্রকল্পের কাজ বর্তমানে বন্ধ রয়েছে। 

চীনের ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান শ্যাংডং সিএসআইয়ের আইনজীবী মেহেদী হাসান চৌধুরীর দাবি, চুক্তি অনুযায়ী ফার্স্ট ঢাকা এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ে কোম্পানির শেয়ার শ্যাংডং ও সিনোহাইড্রো পেয়ে যাবে। এ সম্পর্কে তিনি বণিক বার্তাকে বলেন, ‘চীনের দুই ব্যাংকের (এক্সিম ও আইসিসি) সঙ্গে ইতাল-থাইয়ের করা চুক্তি অনুযায়ী, তারা প্রতি বছর দুবার সুদের কিস্তি পরিশোধ করবে। এর মধ্যে যদি কোনো কিস্তি পরিশোধে ব্যর্থ হয়, তাহলে নোটিস করা হবে। নোটিসের পাঁচদিন পরও যদি কিস্তি পরিশোধ না হয়, তাহলে ইতাল-থাই তাদের হাতে থাকা কোম্পানির শেয়ার শ্যাংডং সিএসআই ও সিনোহাইড্রো করপোরেশনের কাছে হস্তান্তর করে দেবে। ২০২০ সালে এ চুক্তি হয়েছে। চুক্তির বোর্ড অব রেজ্যুলেশন করা আছে। ইতাল-থাই তখনই শেয়ার ট্রান্সফার ফর্মে স্বাক্ষর করে দিয়েছে। এফিডেভিটও করেছে।’ 

আইনজীবী মেহেদী হাসান চৌধুরী বলেন, ‘চুক্তিতে স্পষ্ট বলা আছে, ইতাল-থাইয়ের অপরিশোধিত কিস্তি পরিশোধ করবে শ্যাংডং ও সিনোহাইড্রো এবং ইতাল-থাইয়ের শেয়ার শ্যাংডং-সিনোহাইড্রোর কাছে চলে আসবে। এ বিষয়ে বাংলাদেশ সরকারেরও অনুমোদন আছে। আর ইতাল-থাই তো নিজেই শেয়ার ট্রান্সফারের ফর্মে ২০২০ সালে স্বাক্ষর করে রেখেছে। তাই ইতাল-থাইয়ের কাছে থাকা ফার্স্ট ঢাকা এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ে কোম্পানির শেয়ার হস্তান্তরে কোনো বাধা নেই। আমরা আশা করছি, শেয়ার হস্তান্তরে আদালতের স্থিতাবস্থা ৩০ মের পর তুলে নেয়া হবে।’

এদিকে কাজ বন্ধ থাকালেও সার্বিকভাবে প্রকল্পটির ওপর এর প্রভাব পড়বে না বলে আশাবাদ ব্যক্ত করেছেন ঢাকা এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ে প্রকল্পের প্রকল্প পরিচালক এএইচএমএস আকতার। বণিক বার্তাকে তিনি বলেন, ‘আমরা আশা করছি, ঠিকাদারদের মধ্যকার চলমান বিরোধ দ্রুতই নিষ্পত্তি হয়ে যাবে। চার-পাঁচ মাস ধরে কাজ কিন্তু একেবারে বন্ধ হয়ে যায়নি। সীমিত পরিসরে কাজ হয়েছে। তাছাড়া এ প্রকল্পের ঠিকাদাররা আন্তর্জাতিক মানসম্পন্ন। তারা চাইলে বাড়তি জনবল দিয়ে দিন-রাত ২৪ ঘণ্টা কাজ করে অগ্রগতি এগিয়ে নিতে পারবেন।’

এই বিভাগের আরও খবর

আরও পড়ুন